চট্টগ্রাম :: চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের দুটি এলইডি প্রকল্পে নজিরবিহীন অনিয়ম ও জালিয়াতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হবার পর নিজেকে রক্ষা করতে চসিকের টাকায় বিভিন্ন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছেন অনিয়মের অভিযোগ উঠা প্রকল্প প্রকৌশলী পরিচালক ঝুলন কুমার দাস। নিজের বিরুদ্ধে উঠা অনিয়ম দূর্নীতির বিষয়ে ব্যাখা দিতে সিটি করপোরেশনের অর্থে গণমাধ্যমে এমন বিজ্ঞাপন দেওয়া নজিরবিহীন বলছেনসংশ্লিষ্টরা।
জাইকার অর্থায়নে নগরীতে চলমান এলইডি প্রকল্পের কাজে মানহীন ক্যাবেল ও পোল ব্যবহার করার বিষয়টি চসেকের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উঠে আসলেও এবার পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে ‘ মানহীন ক্যাবেলকে ‘ মানসম্মত বলে প্রমাণ করার চেষ্টা শুরু করেছেন তিনি। একইভাবে ভারতীয় এলওসি ফান্ডের নতুন এলইডি প্রকল্পের অনিয়ম ও দূর্নীতির বিষয়টি গণমাধ্যমের মিথ্যাচার বলে উল্লেখ করা হয়েছে বিজ্ঞাপনে। অথচ গেল একবছর ধরে ২৬১ কোটি টাকার এলইডি প্রকল্পটির অনুমোদিত ডিপিপি পরিবর্তন, চারটি প্যাকেজকে এক প্যাকেজে করে দরপত্র আহ্বান, এইচটিএমএস লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে সুবিধা দেবার অভিযোগ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
দৈনিক আমাদের সময়, আজকের পত্রিকা, দৈনিক আজাদী, দৈনিক পূর্বদেশ, দৈনিক পূর্বকোণ, দৈনিক চট্টগ্রাম প্রতিদিন , যমুনা টেলিভিশন, চ্যানেল ২৪, ডিবিসি নিউজ, বাংলাদেশ পোস্ট, বাংলা নিউজ ২৪, দৈনিক নয়া শতাব্দী, দৈনিক এই বাংলা, দৈনিক জাগরণ, মহানগর নিউজসহ দেশের অন্তত পঞ্চাশটি গণমাধ্যমে এলওসি ফান্ডের এলইডি প্রকল্পে কালোতালিকাভুক্ত আফতাব আহমেদের এইচটিএমএস লিমিটেডকে কাজ দেবার বিষয়ে দরপত্রের শর্ত পরিবর্তন, ক্রুটিপূর্ন মুল্যায়ন, মানহীন লাইটের ব্র্যান্ডকে পছন্দের শীর্ষে রাখা, দরপত্রের নথি গোপন, পিপিআর বিধিমালা লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে ধরে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
মুল্যায়ন কমিটির বেশ কয়েকজন সদস্য দরপত্রে এইচটিএমএস লিমিটেড ও এসপিএলের অংশ নেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করলেও; নতুন প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করে সমালোচনা থেকে বের হবার কুটকৌশল নিয়েছেন প্রকৌশলী ঝুলন কুমার দাস। এরআগে দরপত্রের নথি গোপন করার অভিযোগ এনে চসিকের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম দুইবার শোকজ করেছিলেন প্রকল্প পরিচালক ঝুলন কুমার দাসকে। শোকজের জবাব সন্তোষজনক না হলেও বিধি অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হয় নি। এখন সিটি করপোরেশনের টাকায় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে নিজের অনিয়ম, দূর্নীতি জায়েজ করার কূটকৌশল নিয়েছেন ঝুলন কুমার দাস।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, অনিয়মের মাধ্যমে জাইকার এলইডি প্রকল্পের কাজ পেয়েছিলেন আফতাব আহমেদের প্রতিষ্ঠান এইচটিএমএস লিমিটেড। কাজটি চলমান থাকলেও ক্রুটিপূর্ণ -মানহীন ক্যাবেল ব্যবহারের বিষয়টি উঠে আসে খোদ সিটি করপোরেশনের গঠন করা তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনেও। কিন্তু তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন দেবার পরে ক্যাবেলের নমুনা নিজ উদ্দ্যেগে চুয়েটের ল্যাবে পরীক্ষা করে নতুন রিপোর্ট জমা দিয়েছিলেন তিনি। নিজের উদ্দ্যেগে নতুন ল্যাব টেস্ট রিপোর্ট তৈরি করা; প্রকল্প পরিচালকের অনিয়ম, দূর্নীতিকে প্রতিষ্ঠিত করেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা যায়, ভারতীয় এলওসি ( লাইন অব ক্রেডিট) ফান্ডের আওতায় ‘মর্ডারনাইজেশন অব সিটি স্ট্রিট লাইট সিস্টেম এট ডিফরেন্ট এরিয়া আন্ডার চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন’ শীর্ষক এলইডি বাতি স্থাপনের প্রকল্পটি ২০১৯ সালের ৯ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত একনেক সভায় অনুমোদন পেয়েছিলো। প্রকল্পটির একাধিকবার মেয়াদ বাড়ানো হয়। ২০২১ সালের ৩ নভেম্বর চসিক প্রকল্পের দরপত্র আহবান করলে তাতে তিনটি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়।
দরপত্রের পর অনুষ্ঠিত মূল্যায়ন কমিটির বৈঠকে বিশেষজ্ঞদের চোখে দরপত্রে বেশকিছু মারাত্মক ত্রুটি ধরা পড়ে।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পিপিআর বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ইয়াজদানী বলেন, প্রাক্কলন ছাড়াই প্রকল্পটি তৈরি করা হয়েছে। একনেকে অনুমোদন পাওয়া চারটি লটকে এক লটে এনে দরপত্র দেওয়া হয়েছে, যা সরকারি ক্রয়বিধির লঙ্ঘন। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদিত দরপত্র পরিবর্তন করে প্রকল্প পরিচালক নিজের ইচ্ছেমতো শর্ত তৈরি করে দরপত্র আহবান করেছেন। প্রধানমন্ত্রী এলইডি বাতির জন্য বিদেশি চারটি ব্র্যান্ড অনুমোদন দেন। সেগুলো হলো- ক্রি, ওসরাম, ফিলিপস ও ট্রিডনিক। কিন্তু ২০২১ সালের ৩ নভেম্বর দরপত্রের জন্য তৈরি করা নথিতে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদিত চারটি ব্র্যান্ড থেকে ফিলিপস ও ট্রিডনিককে বাদ দিয়ে নতুন করে সিঅউল ও লুমিলেডস নামের নতুন দুটি ব্র্যান্ডের নাম সংযোজন করেন প্রকল্প পরিচালক ও চসিকের বিদ্যুৎ উপবিভাগের তত্তাবধায়ক প্রকৌশলী ঝুলন কুমার দাশ। এতে সরকারি ক্রয়াদেশের (পিপিআর) গুরুতর লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে চসিকের ওই বিদ্যুৎ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।’
অভিযোগ ওঠে, নিজের পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দিতেই একনেকে অনুমোদিত ব্র্যান্ড বাদ দিয়ে অখ্যাত ব্র্যান্ড যুক্ত করে দেন ঝুলন দাশ। প্রকল্পটির কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের আন্তর্জাতিক যেকোনো দরপত্রের শতভাগ কাজ সমাপ্তের অভিজ্ঞতা (FAC) সনদপত্র থাকতে হবে বলে উল্লেখ ছিল। এইচটিএমএস লিমিটেডকে সুবিধা দিতে সেই শর্তও কাটাছেঁড়া করে দরপত্রে বলা হয়েছে, ৭৫ শতাংশ কাজ সমাপ্তের অভিজ্ঞতা থাকলেই চলবে। কারন এইচটিএমএস জাইকা প্রকল্পের ৭৫ শতাংশ কাজ সম্পন্ন করেছিলো। কিন্তু সব পরিকল্পনা ভেস্তে যায় গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হবার কারনে। বিপত্তির মুখে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কালোতালিকাভুক্ত আফতাব আহমেদের ‘এইচটিএমএস লিমিটেড’ বাদ দিয়ে গোপনে এনার্জি প্যাক নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে দরপত্রে সংযুক্ত করা হয়। যদিও এনার্জিপ্যাক স্মার্ট এলইডি লাইট স্থাপনের কোন প্রকল্পের কাজ কখনোই করেনি। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন এনার্জি প্যাকে কর্মরত তিনজন কর্মকর্তা। দরপত্রে অংশ নেয়া ভারতের শাপোর্জি পালনজি লিমিটেড কিভাবে এনার্জিপ্যাককে স্থানীয় ঠিকাদার হিসেবে অথোরাইজড লেটার দিয়েছে সেই প্রশ্নও সামনে এসেছে।
সুত্রমতে, ভারতের শাপোর্জি পালনজি লিমিটেডও বিহার রাজ্যে রাজগীড় স্টেডিয়ামের কাজ সম্পন্ন করতে না পারার কারণে রাজ্য সরকারের নিষিদ্ধ তালিকায় রয়েছে। এছাড়া, ভারতের ব্যাংলোরে তিন লক্ষ এইইডি লাইট স্থাপনের কাজ করতে না পারার কারণে এসপিসিএল’এর কার্যাদেশ বাতিল করা হয়েছে ২০২১ সালের ৩রা ডিসেম্বর।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন ইনস্টলেশন অব জিআইপি পুল (বৈদ্যুতিক খুঁটি) অ্যান্ড এলইডি লাইট ওয়েরিং প্রকল্পের প্রায় ৪৮ কোটি টাকার কাজ চলমান রয়েছে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কর্পোরেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে। গত দেড় বছর ধরে চলমান এ প্রকল্পের যন্ত্রপাতি ব্যবহারে জালিয়াতির আশ্রয় নেবার অভিযোগ উঠে সিটি কর্পোরেশনের বিদ্যুৎ বিভাগের বিরুদ্ধে । সরেজমিনে দেখা যায়, চট্টগ্রাম নগরজুড়ে ডিজিটাল আলোকায়ন চার স্তরের সকল যন্ত্র ও লাইট ইউরোপের ভালো ব্র্যান্ডের সরবরাহ করার কথা বললেও মূলত সেসব জিনিস আনা হচ্ছে ভারত থেকে।
জাইকার এই প্রকল্পের আওতায় নগরজুড়ে ডিজিটাল আলোকায়ন করতে লাগানো হয়েছে ৪০০ মিটার গ্যালভেনাইজড আয়রন (জিআই) পুল। স্থান ও এলাকার ধরন অনুসারে প্রতিটি পুল ৩০ মিটার উচ্চতার স্থাপন করার কথা থাকলেও প্রায় ২০০ মিটার পুল স্থাপন করা হয়েছে প্রতিটি মাত্র ২০ মিটার উচ্চতার। প্রতিটি ৩০ মিটার উচ্চতার পুলের মূল্য বাবদ কর্পোরেশন থেকে বিল তোলা হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার টাকা। ১০ মিটার কম উচ্চতায় বানানো ২০০ মিটার পুলে প্রতিটিতে টাকা সাশ্রয় হয় ১০ হাজার করে। সে হিসেবে ২০০ মিটার পুলে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে ২০ লাখ টাকা।
এতো অনিয়ম ও ধারাবাহিক দূর্নীতি করে স্বেচ্ছাচারিতায় লিপ্ত হয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের একটি সিন্ডিকেট। নিজেদের দূর্নীতি আড়াল করার কৌশল হিসেবে দরপত্রের নথি পরিবর্তন করেই ক্ষান্ত হননি প্রকল্প পরিচালক ঝুলন কুমার দাশ। বরং গণমাধ্যমে সাপাই বিজ্ঞাপন দিয়ে অনিয়মকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন তিনি। সিটি করপোরেশনের অর্থে নিজের পক্ষে অভিযুক্ত ব্যক্তি বিজ্ঞাপন দিতে পারেন কিনা; সেই প্রশ্নের উত্তরে সুশাসন নিয়ে কাজ করা সংস্থা সনাকের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আকতার উল কবির বলেন, ‘ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন যে অনিয়মের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। গণমাধ্যমের চাপে প্রকল্প পরিচালককে দরজার বাইরে তালা লাগিয়ে অফিস করার দৃশ্য দেখেছি, সিএনজি নিয়ে পালিয়ে যেতেও দেখা গেছে-সেই কর্মকর্তার পক্ষে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন বিজ্ঞাপন দিয়ে অর্থ খরচ করে বুঝিয়ে দিলেন দুর্নীতির সব কুশীলব একই সুতোয় বাঁধা। ‘
চসিকের জনসংযোগ শাখায় যোগাযোগ করে জানা যায়, মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর অনুমোদনক্রমে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ভাবমূর্তি রক্ষায় এমন বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে। কিন্তু অনিয়মের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তির পক্ষ নিয়ে গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা কতটুকু নৈতিক সেই বিষয়ে জানতে ভারতে অবস্থানরত চসিকের মেয়রের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয় নি। ‘
তবে এরআগে মেয়র একটি স্থানীয় দৈনিকের প্রতিবেদককে এনার্জি প্যাক এই দরপত্রে অংশ নেয় নি; এইচটিএমএস লিমিটেড অংশ নিয়েছে বলে জানিয়েছিলেন। চসিকের বিজ্ঞাপনে মেয়রের দেয়া সেই বক্তব্য প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
আপনার মতামত জানানঃ