উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে রেলে যে বিপুল বিনিয়োগ হচ্ছে, রেলের আয়–ব্যয়ের হিসাবের সময় তা বিবেচনায় নেওয়া হয় না। শুধু দৈনন্দিন পরিচালনায় যে ব্যয় হয়, সেটা বাদ দিয়ে মুনাফা হিসাব করা হয়। এতেই দেখা যাচ্ছে, স্বাধীনতার পর কখনোই মুনাফা করতে পারেনি রেলওয়ে। বর্তমানে বছরে লোকসান দাঁড়িয়েছে গড়ে দুই হাজার কোটি টাকা। রেলওয়ের হিসাবে, ২০২০-২১ অর্থবছরে সংস্থাটি লোকসান দিয়েছে ১ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরে লোকসান হয়েছে ২ হাজার ৮৭ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ সালে লোকসান ছিল ১ হাজার ৭৫১ কোটি টাকা। আর এই লোকসানের দায় আওয়ামী লীগ কি এড়াতে পারবে, তাই নিয়েই আজকের এই প্রতিবেদন।
ব্যর্থতাকে লুকিয়ে সাফল্যের প্রচার
২০০৯ সালের পর ১৪৮টি নতুন ট্রেন চালু করা হয়েছে—এটি রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সাফল্য হিসেবে প্রচার করা হয়। কিন্তু বর্তমানে তালিকায় থাকা ৯২টি ট্রেন যে বন্ধ হয়ে গেছে—এ তথ্য চেপে রাখছে রেলওয়ে। রেলওয়ের তথ্য অনুসারে, বর্তমান রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম ২০১৮ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর ৯টি নতুন আন্তনগর ট্রেন চালু করেছেন। এর মধ্যে মন্ত্রীর নিজ জেলায় দুটি ট্রেন রয়েছে। এগুলো হচ্ছে পঞ্চগড় থেকে রাজশাহী পর্যন্ত বাংলাবান্ধা এক্সপ্রেস এবং ঢাকা থেকে পঞ্চগড় পর্যন্ত পঞ্চগড় এক্সপ্রেস।
কাগজে-কলমে রেল দেখাচ্ছে সারা দেশে ৩৬৮টি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করছে। কিন্তু বাস্তবে চলছে ২৭৬টি। অর্থাৎ ৯২টি ট্রেনের চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বন্ধ হওয়া ট্রেনগুলোর প্রায় সব কটিই মেইল, লোকাল ও কমিউটার। যাত্রাপথে এসব ট্রেন প্রায় সব স্টেশনে থামে।
নিম্ন আয়ের মানুষ, অফিসগামী ব্যক্তি ও গ্রাম থেকে শহরের বাজারে টুকটাক পণ্য পরিবহনের প্রধান ভরসা হিসেবে পরিচিত এসব ট্রেন। বন্ধ ট্রেনের কোনো কোনোটি কয়েক বছর ধরে চলছে না। কিছু ট্রেন বন্ধ আছে করোনা মহামারির পর। কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষ এসব বন্ধ ট্রেনের বিষয়টি পুরোপুরি চেপে যাচ্ছে।
রেলওয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, ইঞ্জিন-কোচের স্বল্পতা এবং প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাবে ট্রেনগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আর যেসব ট্রেন চলাচল করছে, সেগুলোও সক্ষমতার চেয়ে কম কোচ নিয়ে চলছে। এতে যাত্রীও কম যাতায়াত করতে পারছে। ইঞ্জিন, রেল অবকাঠামো ও লোকবল ব্যবহার করে কম কোচ নিয়ে চলাচলের কারণে তুলনামূলকভাবে পরিচালন ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে। বর্তমানে ট্রেন পরিচালনায় প্রত্যেক যাত্রীর পেছনে কিলোমিটারপ্রতি প্রায় আড়াই টাকা খরচ হয়। আয় এর অর্ধেকের মতো।
বর্তমানে রেলে আন্তনগর ট্রেনের সংখ্যা ১০৪। এর মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম পথের সোনার বাংলা ও সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেন দুটি সর্বোচ্চ ২২টি কোচ নিয়ে চলাচল করার সক্ষমতা আছে। কিন্তু এ দুটি ট্রেন চলছে ১৪টি কোচ নিয়ে। একইভাবে মেইল, লোকাল ও কমিউটার ট্রেনগুলোও সক্ষমতার অর্ধেক বা এরও কম কোচ নিয়ে চলাচল করছে।
অথচ ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার গঠনের পর রেলের উন্নয়নে প্রায় ৯২ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এর মধ্যে রেললাইন, সেতু, ভবন নির্মাণ এবং ইঞ্জিন-কোচ ক্রয়ে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৬৭ হাজার কোটি টাকা, যার অর্ধেকের বেশি বিদেশ থেকে ঋণ হিসেবে নেওয়া। আর দৈনন্দিন পরিচালনা, বেতন-ভাতাসহ রাজস্ব খাতে এ সময় আরও প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে।
আওয়ামী লীগের দায়টা কোথায়?
বিপুল এ ব্যয়ের পরও ট্রেন বন্ধ হওয়া, ইঞ্জিন-কোচের সংকট কমছে না। এর পেছনে বেশ কিছু কারণের কথা বলছেন রেলের কর্মকর্তারা। এগুলো হচ্ছে রাজনৈতিক বিবেচনায় উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া। অর্থাৎ ইঞ্জিন-কোচ সময়মতো না কিনে নতুন নতুন রেললাইন নির্মাণ ও মেরামতে অধিক ব্যয় করা।
ইঞ্জিন-কোচের সংকট জেনেও মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের অনুরোধে নতুন নতুন আন্তনগর ট্রেন চালু করা। অবকাঠামো ও ইঞ্জিন-কোচ কেনার প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতি। এর ফলে দিন দিন লোকসানের বোঝাও ভারী হচ্ছে সরকারি এই সংস্থার।
এ ছাড়া দ্রুতযান ও পদ্মা এক্সপ্রেস দুটি ট্রেনের সর্বশেষ গন্তব্য দিনাজপুর থেকে পঞ্চগড়ে নেওয়া হয়েছে। এর বাইরে স্থানীয় সংসদ সদস্যদের তদবির এবং প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া প্রতিশ্রুতির পরিপ্রেক্ষিতে কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস, ঢাকা-রাজশাহী পথে বনলতা এক্সপ্রেস, ঢাকা-বেনাপোল পর্যন্ত বেনাপোল এক্সপ্রেস চালু হয়েছে।
ঢাকা-নিউ জলপাইগুড়ি পথে মিতালী এক্সপ্রেস ট্রেন গত ১ জুন থেকে চালু হয়েছে। তবে এই ট্রেনের জন্য কোনো ইঞ্জিন-কোচ নেই রেলের। বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী এই রেলপথের উদ্বোধন করেছেন বলে দুই দেশই এই ট্রেনের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। এ জন্য আপাতত ভারতের ইঞ্জিন-কোচ দিয়ে ট্রেনটি চলাচল করছে।
অপরিকল্পিত উন্নয়ন
রেলের প্রতিটি ট্রেন কখন, কতগুলো কোচ নিয়ে চলবে এবং ইঞ্জিনের ব্যবহার কীভাবে হবে—এর বিস্তারিত নিয়ে ‘টাইম-টেবিল’ বই ছাপানো হয়। হালনাগাদ বই অনুসারে, রেলে যাত্রীবাহী ট্রেনের সংখ্যা ৩৬৮। রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানান, সব কটি ট্রেন নিরবচ্ছিন্নভাবে চালাতে হলে তিন হাজারের বেশি কোচ দরকার। ইঞ্জিন দরকার ৫০০–এর মতো। কিন্তু রেলে বর্তমানে ইঞ্জিন আছে ২৬৩টি। আর কোচের সংখ্যা সাকল্যে ১ হাজার ৬০০।
ইঞ্জিনের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল ধরা হয় ২০ বছর। আর কোচের ৩৫ বছর। রেলের হিসাবেই ৬৭ শতাংশ ইঞ্জিন এবং ৪৭ শতাংশ কোচ আয়ুষ্কাল পেরিয়েছে। ৯৫টি ইঞ্জিন কেনা হয়েছে স্বাধীনতার আগে। এগুলোর কোনো কোনোটির বয়স ৬৬ বছর পর্যন্ত। পুরোনো বলে ইঞ্জিন-কোচের মেরামতও দরকার হয় হামেশা। ফলে মজুতে থাকা ইঞ্জিন-কোচের একটা অংশ সব সময় মেরামত কারখানায় থাকে। মেরামতকাজে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যয়ে ২০২০ সালে একটি ইঞ্জিন মেরামত করার তিন মাসের মধ্যে তা পুনরায় বিকল হয়ে যায়। এ নিয়ে কিছুদিন হইচই হওয়ার পর বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে যায়।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, পাবনা থেকে ঢালারচর পর্যন্ত প্রায় পৌনে দুই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন রেললাইন নির্মাণের পর মাত্র একটি ট্রেন চলাচল করে। গোপালগঞ্জে নতুন রেললাইন নির্মাণ ও ফরিদপুরে পুরোনো রেলপথ সংস্কারে খরচ হয়েছে ২ হাজার ১০০ কোটি টাকা।
২০০৯ সালের পর আওয়ামী লীগের টানা তিন মেয়াদের শাসনামলে ৮৪টি নতুন ইঞ্জিন কেনা হয়েছে। এর মধ্যে ভারত থেকে অনুদান হিসেবে পাওয়া গেছে পুরোনো ১০টি ইঞ্জিন। ২০১৩ সালে ৬০০ কোটি টাকায় চীন থেকে ২০ সেট ডেমু কেনে রেল। ডেমুর সঙ্গে ইঞ্জিনও রয়েছে। এর প্রায় সব কটিই এখন অচল অবস্থায় পড়ে আছে। এ সময়ে বিভিন্ন প্রকল্পের অধীনে কোচ কেনা হয়েছে ৫২০টি।
গত এক দশকে ইন্দোনেশিয়া থেকে দুই দফায় ৩৫০টি কোচ কেনা হয়েছে। কিন্তু দুই দফার কোচ একটির সঙ্গে অন্যটির জোড়া দেওয়ার (কাপলিং) পদ্ধতি আলাদা। ফলে একটি ট্রেনের কোচ খারাপ হয়ে গেলে বিকল্প হিসেবে লাগানো যায় না। আবার দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ১০টি ইঞ্জিন কেনা হয়েছে ২০১৮ সালে। এসব ইঞ্জিন ঢাকা-চট্টগ্রাম ছাড়া অন্য পথে চলতে পারবে না বলে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কারণ, এসব ইঞ্জিনের ওজন বেশি। আর রেলের বেশির ভাগ লাইন দুর্বল।
রেলের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, সারা দেশে রেললাইন যদি দুর্বলই হয়, তাহলে হাজার হাজার কোটি টাকা কোথায় খরচ হলো? আর এত টাকা খরচ করে ট্রেন বন্ধ হবে কেন? তাহলে দেশের মানুষ বিনিয়োগের কী সুফল পেল? এসব জবাব চাওয়া উচিত।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫২৫
আপনার মতামত জানানঃ