চট্টগ্রাম নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মিথ্যা মামলা দায়ের, মিথ্যা প্রতিবেদন ও মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদানের দায়ে পতেঙ্গা থানার দুই এসআইয়ের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। আদালত মামলাটি গ্রহন করে অভিযুক্ত এসআই সুবীর পাল এবং এসআই আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ারা জারি করেছেন।
মঙ্গলবার (১৩ সেপ্টেম্বর) সকালে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জুয়েল দেবের আদালতে এই মামলাটি করেন শিশু আদালত এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ চট্টগ্রামের বিচারক ফেরদৌস আরা।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭-এর পিপি খন্দকার আরিফুল আলম মামলার আবেদনের সত্যতা গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, এক শিশুর বিরুদ্ধে থানায় মিথ্যা মামলা, মিথ্যা পুলিশের রিপোর্ট ও সাক্ষী দেওয়ায় এসআই আনোয়ার হোসেন ও সুবীর পালের বিরুদ্ধে আদালতে মামলার করেছেন বিচারক। পেনাল কোডের ১৭৭, ১৮১, ১৯৩ ও ২১১ ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছে।
আদালতের বেঞ্চ সহকারী সৈয়দ নুর-এ খোদা বলেন, শিশুর বিরুদ্ধে থানায় মিথ্যা মামলা, মিথ্যা পুলিশের রিপোর্ট ও সাক্ষী দেওয়ায় এসআই আনোয়ার হোসেন ও সুবীর পালের বিরুদ্ধে আদালতে মামলার করেছেন বিচারক। আদালত মামলাটি গ্রহণ করে দুই জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন।
আদালত সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের ২১ এপ্রিল চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকার বাটারফ্লাই পার্ক থেকে মো. নাজমুল হাসান জুয়েল নামে এক শিশুকে স্বর্ণ পাচারের অভিযোগে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তার কাছ থেকে দুটি সোনার বার উদ্ধার করা হয় বলে অভিযোগ এনে সেই শিশুর বিরুদ্ধে পতেঙ্গা থানায় মামলা দায়ের করেন এস আই আনোয়ার হোসেন। এই মামলার তদন্তের দায়িত্ব পান একই থানার এস আই সুবীর পাল। তিনি তদন্ত শেষে শিশু নাজমুলকে অভিযুক্ত করে একই বছরের ৩ অক্টোবর আদালতে চার্জশিট জমা দেন। কিন্তু অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় চলতি বছরের ৪ সেপ্টেম্বর শিশুটিকে খালাস দেন আদালত।
অভিযোগে জানা যায়, শিশুটির এক আত্মীয় এএইচএম সুমন শুল্ক বিধান না মেনে দুটি সোনার বার নিয়ে আসেন বাহরাইন থেকে। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকায় বিমানবন্দরে ব্যাগেজ পরিদর্শক ওই ব্যক্তিকে (সুমন) আটক করেন। পরবর্তীতে শুল্ক পরিশোধ করে বৈধ সোনার বার দুটি নিজ হেফাজতে নিয়ে শিশু নাজমুলের কাছে হস্তান্তর করেন ওই প্রবাসী। কিন্তু এক শিশু অবৈধভাবে সোনার বার বহন করছে এমন খবরে তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ওই শিশুকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। পরে উদ্ধারকৃত সোনার বার দুটির মধ্যে একটি দাবি করে শিশুকে ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেয় পুলিশ। শিশুটির মা সোনার বারের বৈধ কাগজপত্র দেখালেও প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় অহেতুক মামলা দায়ের করে পুলিশ।
উদ্ধারকৃত সোনার বার দুটির মধ্যে একটি দাবি করে শিশুকে ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেয় পুলিশ। শিশুটির মা সোনার বারের বৈধ কাগজপত্র দেখালেও প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় অহেতুক মামলা দায়ের করে পুলিশ।
এই মামলার বিচার চলাকালে আদালত জানতে পারে মামলাটিকে সত্য প্রামাণিত করতে মামলা দায়েরকারী এস আই মামলার সমর্থনে আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্য দেন। ডি.ডব্লিউ-২ কর্তৃক দেওয়া সোনার বারের কাগজপত্র উপস্থাপন করা সত্ত্বেও তা আমলে না নিয়ে মামলা দায়ের করেন এস আই আনোয়ার। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট রাজস্ব অফিস হতে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ না করে মামলার বাদী পুলিশ কর্মকর্তাকে বাঁচানোর জন্য মিথ্যা প্রতিবেদন দাখিল করে তদন্তকারী কর্মকর্তা সুবীর পাল। প্রকৃত সত্য জানার পরও মিথ্যা প্রতিবেদনের স্বপক্ষে শপথ গ্রহণপূর্বক আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করেন তিনি। এ মামলায় শিশুটি সম্পূর্ণ নির্দোষ হওয়া সত্ত্বেও ২০১৯ সালের ২২ এপ্রিল তারিখ থেকে ১ মাস ৬ দিন শিশুটি জেল হাজতে আটক থাকার পর একই বছর ২৮ মে জামিন পান।
ওই ঘটনায়, মিথ্যা মামলা দায়ের, মিথ্যা প্রতিবেদন দাখিল এবং মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করায় মামলার বাদী এস আই আনোয়ার হোসেন এবং মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সুবীর পালের বিরুদ্ধে মঙ্গলবার মামলার আবেদন করেন শিশু আদালতের বিচারক।
বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, জনগণের জানমাল ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান, অপরাধ প্রতিরোধ ও দমনে প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে। শুধু আইন পরিপালন নিশ্চিত করা আর অপরাধ প্রতিরোধ বা দমনই নয়, দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রাখতে পুলিশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
বাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বলা হয়। এই বিভাগ যেকোনো দেশ ও জাতির একটি স্থায়ী সম্পদ। তারা আইন ও নীতি-নৈতিকতার ব্যাপারে উচ্চতর স্থানে থাকার কথা। অথচ সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে পুলিশের কিছু সদস্য বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
অপরাধবিজ্ঞানীরা মনে করেন, ‘পুলিশে জবাবদিহিতার অভাবেই এ পরিস্থিতি। এটি কমাতে হলে দায়িত্বশীল অফিসারদেরও জবাবদিহিতা ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে।’
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এ অন্যায় অনৈতিক কাজের কারণেই সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ও অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তারা বলেন, অপরাধী যেই হোক, অপতৎপরতা-অনৈতিক থেকে পুলিশ বিভাগকে মুক্ত করার জন্য শক্তিশালী জবাবদিহির ব্যবস্থা এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ছাড়াও যুগোপযোগী আইনেরও প্রয়োজন। প্রয়োজন আইনের সংস্কার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীরা যদি অনৈতিক কাজ করে আর শাস্তি যদি ১০০ টাকা হয় অপরাধ দমন তো হবেই না, বরং উৎসাহিত হবে। আর অপরাধ দমনের দায়িত্বে নিয়োজিতদের মধ্যে যারা নিজেরাই অপরাধে লিপ্ত হয়, তাদের শাস্তি অধিকতর কঠোর হওয়া দরকার।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৪০
আপনার মতামত জানানঃ