সুমিত রায়
ইউরোপের সবচেয়ে খারাপ দুঃস্বপ্ন সত্যি হতে চলেছে। শীতকাল চলে আসছে, কিন্তু এদিকে তাদের বৃহত্তম গ্যাস পাইপলাইন, নর্ড স্ট্রিম ১ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এটি ছিল ইউরোপের বিরুদ্ধে ভ্লাদিমির পুতিনের তুরুপের তাস, যে তাসটিকে তিনি জুলাই মাসে পাইপলাইনটি প্রথম বন্ধ হবার আগে ব্যবহার করেছিলেন। রাশিয়া জানিয়েছে, তারা মেরামতের কাজ করছে বলে পাইপলাইনটি বন্ধ আছে। ১০ দিন পরে গ্যাস প্রবাহ আবার শুরু হয়েছিল, কিন্তু এখন রাশিয়ার বিদ্যুৎ কোম্পানি গাজপ্রম নর্ড স্ট্রিম ১-কে আবার বন্ধ করে দিয়েছে। তাদের অজুহাত সেই জুলাই মাসের অজুহাতের মতই, মেরামত কাজ চলছে। গাজপ্রম বলছে এটা সাময়িক। তারা বলছে যে, পাইপলাইনটি তিন দিন পরে পুনরায় চালু হবে। কিন্তু ইউরোপ রাশিয়ার ওপর আস্থা রাখতে পারে না। কেন?
নর্ড স্ট্রিম ১ ইউরোপ ও রাশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বড় গ্যাস পাইপলাইন। এটি ৫৫ বিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস পরিবহন করে। এই গ্যাস প্রবাহকে বন্ধ করে দেয়া মানে হলো ইউরোপকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করা। আর পুতিন সেটাই করতে চাইছেন। ইউরোপ রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর তিনি তাদের গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিতে শুরু করেন। প্রথমে গ্যাস প্রবাহকে পূর্ণ ক্ষমতার ৪০%-এ হ্রাস করা হয়েছিল এবং জুলাই থেকে এটি ২০% করা হয়েছে। তাহলে ইউরোপ কী করেছে? তারা তাদের গ্যাসের মজুদ পূরণ করতে শুরু করেছে। তারা গ্যাসের কনজাম্পশন বা হ্রাস করেছে এবং গ্যাসের সাপ্লাইকে তাদের গ্যাসের স্টকে নিয়ে এসেছে। কিন্তু সেই প্রক্রিয়া এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের গ্যাস স্টোরেজের ধারণক্ষমতার ৭৯% পূর্ণ হয়েছে, জার্মানির ক্ষেত্রে পূর্ণ হয়েছে ৮৩%। বাকি অংশ পূরণ করার জন্য তাদেরকে নর্ড স্ট্রিম ১ থেকে গ্যাস প্রয়োজন। ভ্লাদিমির পুতিন এটা জানেন। তাই তিনি তুরুপের তাসটা খেললেন, পাইপলাইন বন্ধ করে দিলেন।
এর ফলে ইউরোপের কী হবে? এখনকার জন্য ইউরোপের গ্যাসের রিজার্ভ পর্যাপ্ত হওয়াই উচিত। ইউরোপের তাপমাত্রা এখনও উচ্চ, গরম ঋতু এখনও শেষ হয়নি, যার ফলে জার্মান কর্মকর্তারা মনে করছেন তাদের অবস্থা গতবারের চেয়ে ভাল। জার্মান এনার্জি রেগুলেটরের প্রেসিডেন্ট ক্লাউস মুলার বলছেন, “নতুন করে এই মেইন্টেইনেন্স বা মেরামতের জন্য রাশিয়ার প্রযুক্তিগত প্রয়োজনীয়তা আমরা আসলেই বুঝতে পারছি না। কিন্তু এরই মধ্যে জার্মানি এখন আরও ভালোভাবে প্রস্তুত। আমরা স্টোরেজ ফ্যাসিলিটিগুলোকে আরও ভালভাবে পূরণ করেছি, আমরা নরওয়ে, হল্যান্ড, বেলজিয়াম থেক ও সেই সাথে শীঘ্রই ফ্রান্স থেকে গ্যাস পাচ্ছি। আমরা গ্যাস সাশ্রয় করছি এবং এ ক্ষেত্রে, আমি মনে করি, আমরা আপাতত এই সমস্যা মোকাবেলা করতে সক্ষম হব।”
ঠিক আছে শেষ অংশটাই তার বক্তব্যের মূল অংশ, “আমরা “আপাতত” এই সমস্যা মোকাবেলা করতে সক্ষম হব।” তার কথা শুনে মনে হচ্ছে না যে, এটা একটা সলিড এনার্জি স্ট্র্যাটেজি। প্রকৃতপক্ষে ইউরোপের বিকল্প প্রয়োজন। তারা আসন্ন শীতকালে রাশিয়ান গ্যাস সরবরাহের উপর নির্ভর করতে পারে না। যদি তারা তা করে তবে ঘাটতি দেখা দেবে। সুতরাং তাদের কাছে কী কী বিকল্প রয়েছে? ইউরোপীয় ইউনিয়ন জরুরি ভিত্তিতে হস্তক্ষেপ অর্থাৎ এমারজেন্সি ইনটারভেনশনের প্রস্তাব দিয়েছে। এই পরিকল্পনার দুটি অংশ আছে। এর তাৎক্ষণিক লক্ষ্য বা ইমিডিয়েট গোল হল এনার্জি বিলগুলো কমিয়ে আনা। আর দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য বা লং টার্ম গোল হল শক্তি বাজার বা এনার্জি মার্কেট যেভাবে কাজ করে তা পরিবর্তন করা। প্রথমটি, অর্থাৎ ইমিডিয়েট গোল নিয়ে আগে আলোচনা করা যাক, যা হলো এনার্জি বিলগুলো কমিয়ে আনা। ইউরোপীয় গ্যাসের দাম অনেক বেড়ে গেছে আর বাড়ছেই। এই দাম গত বছরের তুলনায় ১২ গুণ বেশি। আগস্টে ইউরোর মুদ্রাস্ফীতি সর্বকালের সর্বোচ্চ ৯.১%-এ পৌঁছেছে। এই দুটি সমস্যার জন্যই একই কারণকে দায়ী করা যেতে পারে, আর তা হচ্ছে রাশিয়ার গ্যাস-ওয়ারফেয়ার। এই সংকট সমাধানের জন্য ইউরোপের কাছে লিমিটেড কিছু বিকল্প আছে, একে একে আলোচনা করা যাক… .
১। প্রথমত, ইউরোপ এনার্জি কস্টকে ক্যাপ করতে বা সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দিতে পারে। স্পেন ও পর্তুগাল ইতিমধ্যে তা করে ফেলেছে। তারা শক্তির খরচ কত বেশি হতে পারে তার উপর একটি আইনী সীমা স্থাপন করেছে। কিন্তু এখানে একটাই সমস্যা। কৌশলটিকে অবশ্যই প্যান-ইউরোপ, অর্থাৎ সমগ্র ইউরোপের ক্ষেত্রে হতে হবে। যদি তা না হয় তবে সরবরাহকারীরা কেবল সেই সব দেশে গ্যাস রপ্তানি করবে যেসব দেশে এনার্জির প্রাইসে ক্যাপ বসানো, অর্থাৎ গ্যাসের মূল্যের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করা হয়নি।
২। দ্বিতীয় বিকল্পটি হলো গ্যাস আমদানির ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করা। ইউরোপ রাশিয়ান গ্যাস আমদানির মূল্য সীমিত করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কিন্তু এখানেও সমস্যাটা আবার স্পষ্ট। রাশিয়া কেন এই ধরনের সীমিতকরণে সম্মত হবে? তারা বরং তাদের অতিরিক্ত গ্যাসকে পুড়িয়ে ফেলবে। প্রকৃতপক্ষে, তারা ইতিমধ্যেই এটি করছে। ফিনল্যান্ডের কাছে একটি রাশিয়ান গ্যাস প্ল্যান্ট বিপুল পরিমাণে প্রাকৃতিক গ্যাস পোড়াচ্ছে, এর মূল্যও নেহাৎ কম নয়। প্রতিদিন সেখানে প্রায় ১০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের গ্যাস পোড়ানো হচ্ছে।
৩। তৃতীয় বিকল্পটি হচ্ছে অপ্রত্যাশিত কর বা উইন্ডফল ট্যাক্স। উইন্ডফল গেইন বা অপ্রত্যাশিত লাভ হচ্ছে একটি অস্বাভাবিকভাবে উচ্চ বা প্রচুর আয়, যে হঠাৎ এবং/অথবা অপ্রত্যাশিত, যা প্রায়শই কোন ভূ-রাজনৈতিক অশান্তি, যুদ্ধ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে যা চাহিদার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং/অথবা সরবরাহে বাধা সৃষ্টির ফলে ঘটে। এখন ইউরোপের অনেক কোম্পানী ও ইন্ডাস্ট্রিতে ঠিক তাই হয়েছে। আর এই অপ্রত্যাশিতভাবে উচ্চ উইন্ডফল গেইনের ওপর ধার্যকৃত করকে বলে উইন্ডফল ট্যাক্স, যা এই লাভবান কোম্পানি বা ইন্ডাস্ট্রিগুলোর ওপর আরোপ করা হয়। উইন্ডফল গেইন করা ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর মধ্যে আছে ইউরোপের বিগ অয়েল কোম্পানিগুলো। এদের আয় থেকে ইউরোপ উইন্ডফল ট্যাক্সের মাধ্যমে একটা অংশ নিতে পারে। এই করও এই কোম্পানিগুলো সহজেই বহন করতে পারে। নরওয়ের সংস্থা একুইনোর গত মাসে ৩ বিলিয়ন ডলার লভ্যাংশ দিয়েছে। ফ্রান্সের টোটালএনার্জির আয় তিনগুণ হয়ে গেছে। সুতরাং উইন্ডফল ট্যাক্স ইউরোপের জন্য একটি কার্যকর বিকল্প হবে। ইউরোপ এই অতিরিক্ত অর্থ ভোক্তাদের জন্য এনার্জির দামে ভর্তুকি দিতে ব্যবহার করতে পারে।
এগুলোই এখন ইউরোপের ইমিডিয়েট গোল। আর ইউরোপের জন্য লং টার্ম গোলগুলো কী? এটা এখন অনেক বেশি জটিল। এই মুহূর্তে ইউরোপের বিদ্যুৎ বাজার বা ইলেক্ট্রিসিটি মারকেট পাইকারি দামের উপর ভিত্তি করে চলছে। এর মানে হল, সব ধরণের প্রোডিউসার এখানে বিড করছে, যাদের মধ্যে আছে নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট, উইন্ডমিল, গ্যাস প্ল্যান্ট – সবই। কিন্তু বিদ্যুতের চূড়ান্ত মূল্য ঠিক হয়ে গ্যাসের উপর ভিত্তি করে। এখন সধারণত গ্যাসই হচ্ছে এনার্জির সবচেয়ে ব্যয়বহুল উৎস। তাহলে কেন ইউরোপ এমন একটা চাপের সিস্টেম তৈরি করবে যেখানে সবচেয়ে বেশি দামী এনার্জি গ্যাসই বিদ্যুতের চুড়ান্ত মূল্য নির্ধারণ করে দেয়? কেন ইউরোপ এমনটা করবে, যেখানে গ্রিন এনার্জি অনেক সস্তা, যেখানে বায়ু থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ গ্যাস দিয়ে উৎপাদিত বিদ্যুতের থেকে সস্তা? কেন এত কিছুর পরও এগুলো একই দামে বিক্রি হয়? এর ব্যাখ্যা কী?
এটা হয় কারণ ইউরোপে গ্রিন এনার্জিকে বেশি দামে বিক্রি করে একে বেশি উৎসাহিত করা হয়। গ্রিন এনার্জির প্রোডিউসাররা যদি গ্যাস থেকে আসা বিদ্যুতের মত উচ্চমূল্যে তাদের গ্রিন এনার্জি বিক্রি করতে পারে তবে তাদের হাতে বেশি প্রোফিট আসবে, আর বেশি প্রোফিট এলে তারা বেশি ইনভেস্ট করতে পারবে। আর এভাবেই ধীরে ধীরে গ্রিন এনার্জি অন্যান্য এনার্জিকে রিপ্লেস করবে। এটাই ছিল ইউরোপের প্ল্যান। এজন্য ইলেক্ট্রিসিটির বাজার আসলে নিয়ন্ত্রিত হয় গ্যাসের দ্বারা, এটার মূল্য যা হয় তাই হয় অন্যান্য সকল ধরণের এনার্জির মূল্য। তবে আজকের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। গ্রিন এনার্জি এখনও ২০২১ সালের মতোই সস্তা আছে, তবে গ্যাসের দাম গেছে ১২ গুণ বেড়ে। এর মানে হলো, এক ইউনিট সোলার এনার্জি তৈরি করতে যদি এক ডলার লাগে, তাহলে গ্যাস এনার্জি তৈরি করতে ১২ ডলার লাগছে। এখন স্বাভাবিকভাবে এই দুটি ইউনিটের আলাদা খরচ থাকা উচিত। কিন্তু ইউরোপে তা হয় না। ইউরোপে চূড়ান্ত মূল্য গ্যাস দ্বারাই নির্ধারিত হয়। মানে সোলার এনার্জির দাম ১ ডলার, আর গ্যাস এনার্জির দাম ১২ ডলার হলে আপনাকে ১২ ডলার দিয়েই যেকোন রকম এনার্জি কিনতে হবে। এখানেই ইউরোপের সমস্যাটা। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ৯ই সেপ্টেম্বরে তাদের এটি নীতির পরিবর্তন করার আশা করছে। জ্বালানি কর্মকর্তারা একটি বিশেষ সভা আহ্বান করবেন। তারা কিছু বড় সংস্কার ঘোষণা করবে বলে আশা করা হচ্ছে। কিন্তু তা কত বড়? এটা নির্ভর করে তারা ইউরোপ কতটা একতাবদ্ধ তার ওপর।
রাশিয়ার ক্ষেত্রে বলা যায় যে, তারা শীঘ্রই তাদের এই গ্যাস ওয়ারফেয়ার শেষ করছে না, কারণ তাদের কোন লস নেই আসলেই। গাজপ্রম পোস্ট করে বলছে যে গত ছয় মাসে তারা ৪১ বিলিয়ন ডলার মুনাফা করেছে। কল্পনা করুন, ৪১ বিলিয়ন ডলার! এটা হলো রাশিয়ান গ্যাস বয়কট করার ফল। বাস্তবতা হচ্ছে, পুতিনের এখানে ইউরোপের চেয়ে অনেক বেশি সুবিধা রয়েছে। আগে ভাবা হয়েছিল যে, গ্যাস বাণিজ্য একটি দুই ধাঁর বিশিষ্ট তরবারি। মানে যদি ইউরোপের রাশিয়ান গ্যাসের প্রয়োজন হয়, তবে রাশিয়ারও ইউরোপীয় অর্থের প্রয়োজন হবে, আর তাই কেউ একপাক্ষিকভাবে লাভবান হবেনা, দুই পক্ষই চাপে থাকবে। কিন্তু এখন বোঝা যাচ্ছে পরিস্থিতি পুরো ভিন্ন। গ্যাসের দাম এতটাই বেশি যে এই পাইপলাইন শাটডাউন পুতিনকে সত্যিই কোনরকম আঘাত করবে না। তিনি মার্চ থেকে মোট ধারণক্ষমতার মাত্র ৪০% সরবরাহ করছিলেন, তবুও গ্যাজপ্রম ৪১ বিলিয়ন ডলার লাভ করেছিল। সুতরাং FGM-148 Javelin, M142 HIMARS, Fifth-generation fighter যত যুদ্ধাস্ত্রের কথাই বলুন না কেন, আসলে এই যুদ্ধের সবচেয়ে বড় অস্ত্র হলো এনার্জি!
আপনার মতামত জানানঃ