তেলের বাড়তি দর সরকারকে রাজনৈতিকভাবেও চাপে ফেলেছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ক্রমাগত আক্রমণের মুখে সরকারের দৃশ্যত কোনো শক্তিশালী জবাব নেই। এই পরিস্থিতি আগামী জাতীয় নির্বাচনে সরকারকে চাপে ফেলতে পারে-এমন আশঙ্কা করছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরাই।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সতর্ক করে দিয়েছেন, তেলের দাম বাড়ানোর কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। তেলের দাম বাড়ানোর দুই দিন পরই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, বিশ্ববাজারে কমলে দেশেও কমবে তেলের দাম।
অর্থমন্ত্রী বলেছেন, বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমছে এবং বাংলাদেশ কম দামে কেনা শুরু করেছে। তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ অবশ্য জানিয়েছেন, তেলের দাম কমাতে দুই মাস সময় লাগতে পারে।
জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি বিএনপির ট্রামকার্ড
বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে ঢাকায় আয়োজিত এক সমাবেশ থেকে বিরোধী দল বিএনপি নেতারা সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবী করেছেন। তারা বলেছেন সরকার তাদের দাবিতে কান না দিলে বিএনপি রাস্তায় জোরদার আন্দোলন শুরু করবে।
বিএনপির সমাবেশ কেন্দ্র করে বিপুর সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে।
জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, সরকারের দমনপীড়নের প্রতিবাদে দুই দিনের কেন্দ্রীয় কর্মসূচি ঘোষণা করে বিএনপি। দুই দিনের আজ প্রথম দিন।
গতকাল বিএনপি মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর তার ভাষণে মানুষকে “রাজপথ দখলের” আন্দোলনে শরিক হওয়ার আহ্বান জানান। “এখন লড়াই রাজপথ দখলের … রাজপথেই দাবী আদায়ের আন্দোলনের ফয়সালা হবে।” তবে এই মুহূর্তে হরতাল বা অবরোধের মত কোনো কর্মসূচি নেওয়ার সম্ভাবনা নাকচ করেছেন বিএনপি মহাসচিব।
সমাবেশে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির আহ্বায়ক আব্দুস সালাম বক্তব্য বলেন, আজকের সমাবেশে কয়েক লাখ নেতাকর্মী উপস্থিতি হয়েছেন। পল্টন, ফকিরাপুল, কাকরাইল, বিজয়নগর এলাকায় লোকে লোকারণ্য হয়ে গেছে। এই সমাবেশ থেকে শুরু হবে সরকার পতনের আন্দোলন। সরকার মনে করেছিল, আব্দুর রহিম, নূরে আলমকে হত্যা করে আন্দোলন দমানো যাবে। আজকের সমাবেশ প্রমাণ করে, নেতাকর্মীরা জীবন দিতে প্রস্তুত আছেন। তবু এই অবৈধ সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামিয়ে ছাড়বেন।
বেলা ১টা ৫০ মিনিটে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে বিএনপির ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর মহানগর শাখার আয়োজনে সমাবেশ শুরু হয়। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আবদুস সালাম সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন। বক্তব্য রাখেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু এবং আরও কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা।
সকাল থেকেই দল ও সহযোগী সংগঠনের হাজার হাজার নেতাকর্মী জড়ো হয়ে সড়কের একপাশে অবস্থান নেয়। এর ফলে বিজয়নগর ক্রসিং থেকে ফকিরাপুল পর্যন্ত রাস্তার অপর পাশ দিয়ে যানবাহন চলাচল করে।
সমাবেশস্থলের আশেপাশ বাড়তি পুলিশ মোতায়েন করা হয়। প্রিজন ভ্যান, জলকামান, সাজোয়া যানসহ পোশাকধারী পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোষাকের পুলিশও দায়িত্ব পালন করে।
আজ শুক্রবার গণমাধ্যমকে মির্জা ফখরুল বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার যতদিন ক্ষমতায় থাকবে মানুষের দুর্ভোগ তত বাড়বে বলে মন্তব্য করে সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, জ্বালানি তেল, পানি, বিদ্যুৎ, নিত্যপ্রয়োজনীয় সব কিছুর দাম বেড়েছে। সরকারের দুর্নীতি আকাশচুম্বী। সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থ হয়েছে।
দাম কমানোর উপায় খুঁজছে সরকার
জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির যৌক্তিকতা প্রচারে মন্ত্রিসভা নির্দেশ দিলেও সরকার এখন দাম কমানোর উপায় খুঁজছে। এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন-বিপিসি ও পেট্রোবাংলাকে উদ্যোগ নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।
গত ৫ আগস্ট মধ্যরাত থেকে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ৩৪ টাকা এবং পেট্রল ও অকটেনের দাম যথাক্রমে ৪৪ ও ৪৬ টাকা করে বাড়ানোর প্রতিক্রিয়ায় তীব্র সমালোচনার মুখে পিছু হটার এই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
জ্বালানি বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে বলেন, ‘জ্বালানি তেলের দাম কমানোর প্রস্তাবনা তৈরি করতে এরই মধ্যে বিপিসি ও পেট্রোবাংলাকে নির্দেশ দিয়েছে সরকার। জ্বালানি বিভাগের দেয়া এই নির্দেশনায় আমদানি খাতে ভ্যাট ও ট্যাক্স কতটা কমিয়ে কীভাবে তা জনগণের সহ্যসীমায় রাখা যায়, তার বিস্তারিত তুলে ধরতে বলা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘এই প্রস্তাবনা বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে উপস্থাপন করা হবে। এরপর তিনি তা অনুমোদন দিলে এনবিআরের কাছে পাঠানো হবে।’
তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে দায়ী সরকার
তেলের মূল্য বৃদ্ধির দায় নিজেরা না নিয়ে তা জাতীয় রাজস্ব বিভাগের (এনবিআর) ওপর চাপাচ্ছে জ্বালানি বিভাগ। জ্বালানি তেল ও এলএনজি আমদানি বাবদ উচ্চহারের ট্যাক্স ও ভ্যাট বাবদ সরকার বড় আকারের রাজস্ব আদায় করে। জ্বালানি আমদানির ভ্যাট ও ট্যাক্স কমানোর মাধ্যমে বিপিসির লোকসান কমাতে ২০২১ সালেই জ্বালানি বিভাগ এনবিআরকে চিঠি লেখে।
এতে বলা হয়, ‘এনবিআর আমদানি ট্যাক্স কমালে একদিকে যেমন বিপিসির লোকসান ঠেকানো যাবে, তেমনি লোকসান এড়াতে মূল্য বাড়ানোর ঝুঁকিও নিতে হবে না। ফলে জনগণের ওপর বাড়তি দরের চাপ সামলানো যাবে ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে।’
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ জানিয়েছে, সব রকমের কর প্রত্যাহার করলে, প্রতি লিটার ডিজেলের মূল্য কম করে হলেও ৩৬ টাকা কমানো সম্ভব।
ফার্নেস অয়েল, জেট ফুয়েল, ডিজেল ও অকটেনের আমদানির ওপর কাস্টমস শুল্ক ও অন্যান্য কর বাবদ রাজস্ব কর্তৃপক্ষটি প্রায় ৩৪ শতাংশ কর আদায় করে।
এর মধ্যে কাস্টমস শুল্ক হলো ১০ শতাংশ, ভ্যাট বা মূসক ১৫ শতাংশ, অগ্রিম কর ২ শতাংশ এবং অগ্রিম আয়কর ২ শতাংশ। এখন ১১৪ টাকার প্রতি লিটার ডিজেল থেকে ৩৬ টাকা কর আদায় করছে সরকার।
জ্বালানি বিভাগের সেই কর্মকর্তা বলেন, জ্বালানি বিভাগের এই চিঠির কোনো উত্তরই দেয়নি জাতীয় রাজস্ব বিভাগ। উল্টো বিপিসির হিসাবে জমা থাকা উদ্বৃত্ত টাকা নিয়ে নেয় সরকার। এই টাকা না নিলে অন্তত ২১ মাস লোকসান দিয়ে আগের দামেই তেল বিক্রি করতে পারত বিপিসি।
বিপিসির হিসাব অনুযায়ী ২০১৩-২০১৪ অর্থবছর থেকে সংস্থাটি শুল্ক, কর ও লভ্যাংশ বাবদ সরকারি কোষাগারে ৫৬ হাজার ৩০৯ কোটি টাকা জমা দিয়েছে। ২০২০ এবং ২০২১ অর্থবছরে সরকারের কোষাগারে ৯ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে বিপিসি।
অবশ্য বিপিসির চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ বুধবার সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, ২০১৪ সাল থেকে সাত বছর মুনাফা করলেও তার আগের ১৪ বছর টানা লোকসান করেছে বিপিসি। মুনাফার টাকায় সেই সব লোকসান সমন্বয়ও করা যায়নি।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪০৮
আপনার মতামত জানানঃ