পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন সামরিক শাসন চলছে। আদিবাসীদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত করার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। সেখানে এমন কোনো পরিবার নেই যারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না।
আজ মঙ্গলবার(০৯ আগস্ট) আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস। সে উপলক্ষে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আয়োজিত কেন্দ্রীয় কর্মসূচিতে এ কথা বলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান সন্তু লারমা। এর আয়োজন করে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম। এবারের আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসের প্রতিপাদ্য ‘প্রথাগত জ্ঞান সংরক্ষণ ও প্রসারে আদিবাসী নারী সমাজের ভূমিকা’।
করোনার কারণে টানা দুই বছর আদিবাসী দিবসের প্রকাশ্য অনুষ্ঠান বন্ধ ছিল। এবারে তাই শহীদ মিনারে আদিবাসী দিবসের অনুষ্ঠান ঘিরে ছিল উচ্ছ্বাস।
সরকারি হিসাবে, দেশে মোট ৫০টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যা সাড়ে ১৬ লাখের বেশি। যদিও এসব জাতির মানুষেরা দাবি করেন, প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে বেশি। প্রতিবছর এ দিবসে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ একত্র হন, তাদের অধিকার আদায়ের কথা বলেন। এবারও তারা উচ্চকিত ছিলেন অধিকারের প্রশ্নে।
আজ বক্তৃতায় সন্তু লারমা সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি সরকারকে দুর্নীতিগ্রস্ত এবং সাম্প্রদায়িক হিসেবে আখ্যায়িত করেন। সন্তু লারমা বলেন, সরকার উন্নয়নের গালভরা বুলি দিচ্ছে। কিন্তু পাহাড়ি বা সমতলে উন্নয়ন কার জন্য হচ্ছে? উন্নয়নের নামে আসলে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের অস্তিত্ব বিলুপ্ত করার চেষ্টাই চলছে। পাহাড়ের রাস্তাঘাট করা হচ্ছে পর্যটনের জন্য। এতে পাহাড়ি মানুষের কোনো স্বার্থ নেই।
সন্তু লারমা বলেন, সরকার আদিবাসীদের সর্বস্বান্তকরণের চেষ্টা করছে। আর সব ক্ষেত্রে প্রতারণা করে চলেছে।
জেএসএস সভাপতি সন্ত লারমা বলেন, ১৯৭২ সালে যখন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান রচিত হয়েছিল, সেখানেই ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের অধিকার হরণ করা হয়েছিল। অধিকার হরণের এই প্রক্রিয়া এখনো চলছে।
দুই দশকের সশস্ত্র লড়াই শেষে ১৯৯৭ সালে সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি করে সন্তু লারমার দল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)। সেই চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে নানা সময় হতাশার কথা বলেছেন জেএসএসের পক্ষে চুক্তি স্বাক্ষরকারী সন্তু লারমা।
আজও তিনি বলেন, সরকার চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি শুধু নয়, কোনো আন্তরিকতাও দেখাচ্ছে না।
সন্তু লারমা বলেন, ‘আপনারা ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতায় আছেন। এর আগেও ক্ষমতায় ছিলেন। কিন্তু পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে কার্যকর কিছু করেননি।’
১৯৭২ সালে যখন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান রচিত হয়েছিল, সেখানেই ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের অধিকার হরণ করা হয়েছিল। অধিকার হরণের এই প্রক্রিয়া এখনো চলছে।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম দিনব্যাপী এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠান থেকে অধিকার রক্ষায় ১১ দফা দাবি জানিয়েছেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নেতারা।
তাদের দাবিগুলো হলোঃ-
১. আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারসহ ‘আদিবাসী’দের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে।
২. ‘আদিবাসী’দের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও ভূমির অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
৩. ‘আদিবাসী’ নারীর অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
৪. পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। এ লক্ষ্যে সময়সূচিভিত্তিক রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে। ভূমি কমিশন আইন অবিলম্বে কার্যকর করতে হবে।
৫. সমতল অঞ্চলের ‘আদিবাসী’দের পৃথক মন্ত্রণালয় ও ভূমি কমিশন গঠন করতে হবে।
৬. ‘আদিবাসী’দের ভূমিতে তাদের স্বাধীন পূর্ব সম্মতি ছাড়া ইকোপার্ক, সামাজিক বনায়ন, টুরিজম, ইপিজেড বা অন্য কোনো প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা চলবে না।
৭. ‘আদিবাসী’দের ওপর সব নিপীড়ন-নির্যাতন বন্ধ করাসহ সব মিথ্যা মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ২০০৭ সালে গৃহীত ‘আদিবাসী’ বিষয়ক ঘোষণাপত্র ও আইএলও ১৬৯
নম্বর কনভেনশন অনুসমর্থন ও আইএলও কনভেনশন ১০৭ বাস্তবায়ন করতে হবে।
৯. জাতীয় সংসদে ‘আদিবাসী’দের জন্য বিশেষ কোটা সংরক্ষণ বা আসন বরাদ্দ রাখতে হবে।
১০. সরকারি প্রথম শ্রেণিতে পূর্বের মতো ‘আদিবাসী কোটা’ সংরক্ষণ করতে হবে এবং অন্যান্য চাকরিসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির কোটা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
১১. রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস’ উদ্যাপন করতে হবে।
এর আগে সকালে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ। এ সময় তিনি বলেন, ‘পার্বত্য চুক্তির পরিণতি এখনো দৃশ্যমান হয়নি। সমতলে আদিবাসী হত্যার বিচার হয়নি। আদিবাসী বলা যাবে না বলে যে সার্কুলার জারি করা হয়েছিল তারা কারা? তারা বলছে আদিবাসীর সংখ্যা কমছে। কিন্তু আদিবাসীর সংখ্যা কমছে না, এরা লুণ্ঠিত হয়ে চলে গেছে।’
আদিবাসী নারী পরিষদের সভাপতি বাসন্তী মুর্মু বলেছেন, ‘পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীদের জন্য জাতীয় সংসদে দুটি সংরক্ষিত আসন বরাদ্দ রাখতে হবে।’
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘আদিবাসীর পরিবর্তে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী শব্দের ব্যবহার “অবমাননাকর”। আদিবাসীদের সমস্যা সামাজিকভাবে সমাধান করা সম্ভব নয়। তাদের সমস্যা সমাধান করতে হবে রাজনৈতিকভাবে।’
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, আজকে যারা বলেন—আদিবাসী বললে সংবিধান লঙ্ঘন হবে, তারা আসলে সংবিধান বোঝেন না। এ সময় আদিবাসীদের রক্ষায় সরকারের প্রতি আহ্বানও জানান তিনি।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, ‘বৈষম্যহীন রাষ্ট্রের জন্য আমরা দেশ স্বাধীন করেছিলাম। আজ বৈষম্য হচ্ছে। আমাদের আন্দোলনের মাধ্যমে আমাদের অধিকার আদায় করতে হবে।’
অনুষ্ঠানে মানবাধিকারকর্মী খুশী কবির বলেন, ‘আদিবাসীদের নিয়ে যে সার্কুলার জারি করা হয়েছে, তা মেনে নেওয়া যাবে না। আদিবাসীদের জয় অবশ্যই হবে।’
বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, শাসকেরা আদিবাসীদের নাগরিক বলে মনে করে না। আদিবাসীরাও মানুষ, তাদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে।
অনুষ্ঠান শেষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আদিবাসী কালচারাল ফোরাম। এরপর একটি র্যালি নিয়ে শহীদ মিনার থেকে দোয়েল চত্বর, টিএসসি হয়ে আবার শহীদ মিনারে গিয়ে শেষ হয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৪৭
আপনার মতামত জানানঃ