সরকারের সব কর্মকাণ্ড জনগণের বা ভোক্তাদের কল্যাণ নিশ্চিত করবে এবং তাদের স্বার্থের অনুকূলে থাকবে বা সাংঘর্ষিক হবে না। এই মানদণ্ডে হিসাব করলে এভাবে জ্বালানির বেপরোয়া ও ক্ষমতাবহির্ভূতভাবে মূল্যবৃদ্ধিতে আমরা হতবাক। এর আগে উত্তরোত্তর গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি, জ্বালানি তেলের প্রতি লিটারে ১৫ টাকা মূল্যবৃদ্ধি, অন্যদিকে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টিও অপেক্ষাধীন—এর মধ্যে জ্বালানি তেলের প্রায় ৫০ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধিতে সরকারের একটি অবিশ্বাস্য চারিত্রিক দিক ওঠে এসেছে। যার মধ্য দিয়ে বলা যায়, সরকার এখন আর জনগণের কল্যাণ নিয়ে ভাবে না। কারণ, সরকারের ভেতরে অসাধু একটি ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি কাজ করছে। এতে সাধারণ মানুষ অনেক বেশি আতঙ্কিত ও হতভম্ব।
কোনো ধরণের গণশুনানি, পূর্বালোচনা ছাড়াই হঠাৎ ঘোষণায় জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে সরকার। ডিজেল ও কেরোসিন লিটারে ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ৮০ থেকে ১১৪ টাকা, অকটেন লিটারে ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ৮৯ থেকে ১৩৫ টাকা, পেট্রল লিটারে ৪৪ টাকা বাড়িয়ে ৮৬ থেকে ১৩০ টাকা করা হয়েছে।
রাত ১২টা থেকে কার্যকর হয়েছে জ্বালানি তেলের নতুন দাম। এর আগে, আগের দামে তেল পেতে পেট্রল পাম্পে হুমড়ি খেয়ে পড়েন মোটরসাইকেল চালকেরা। এদিকে, জ্বালানি তেলের দাম যে পরিমাণে বাড়ানো হয়েছে, তাতে যাত্রীদের ওপর চাপ বিপুলভাবে বাড়বে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রমেশ ঘোষ। তিনি বলেছেন, এর আগে এক দফায় জ্বালানি তেলের দাম এতটা বাড়ানোর নজির আছে কি না, তা মনে পড়ছে না।
জ্বালানির দাম বাড়ানোর এই হারকে অস্বাভাবিক আখ্যায়িত করেছেন শ্যামলী পরিবহনের স্বত্বাধিকারী রমেশ ঘোষ। দ্রব্যমূল্যের ওপরও এর প্রভাব পড়বে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
শুক্রবার রাতে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে সরকার। ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪ টাকা, পেট্রোলের দাম ৪৪ টাকা বাড়িয়ে ১৩০ টাকা এবং অকটেনের দাম ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা করা হয়েছে। রাত ১২টার পর থেকেই নতুন এই দাম কার্যকর হয়েছে।
সরকার এর আগে গত নভেম্বরে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়েছিল। তখন দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল লিটারপ্রতি ৮০ টাকা। ডিজেলের দাম বাড়ানোর পর বাসভাড়া বাড়ানো হয় প্রায় ২৭ শতাংশ, যা তেলের দাম বাড়ানোর হারের চেয়ে অনেক বেশি। একইভাবে তখন লঞ্চভাড়া বাড়ানো হয় ৩৫ শতাংশ।
সবমিলে বছরে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) বিক্রি করা মোট জ্বালানি তেলের ৬৫ শতাংশ ব্যবহার করে পরিবহন খাত। প্রায় ১৬ শতাংশ ব্যবহৃত হয় কৃষি খাতে। শিল্প খাতে ৭ ও বিদ্যুৎ খাতে ১০ শতাংশ তেল ব্যবহৃত হয়।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর কারণে নতুন করে বাস, লঞ্চ ও ট্রাকভাড়া বাড়বে। প্রাইভেট কারের মালিক ও মোটরসাইকেলের চালকদের খরচও বাড়বে। ব্যয় বাড়বে কৃষি খাতে, যা বাড়িয়ে দেবে পণ্যের দাম।
এদিকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর খবর শোনার পরই আতঙ্কিত মানুষ ফিলিং স্টেশনে ছুটে গেছেন। প্রথম আলোর প্রতিবেদকেরা বিভিন্ন ফিলিং স্টেশনে রাত ১২টার আগে তেল নিতে যানবাহনের দীর্ঘ সারি দেখতে পেয়েছেন।
বিদ্যুতের দামও বাড়ানোর ইঙ্গিত
সরকারি কোম্পানিগুলোর আবেদনের পর গত ৫ জুন বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) গ্যাসের দাম বাড়িয়ে দেয়। পাইকারি পর্যায়ে বাড়ানো হয় প্রায় ২৩ শতাংশ। বাসাবাড়িতে দুই চুলার গ্যাস বিল ৯৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ৮০ টাকা করা হয়।
ঢাকা ওয়াসা গত ৮ জুলাই পানির দাম ৫ শতাংশ বাড়িয়েছে, যা ১ সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর হবে। দাম আরও বাড়ানোর চেষ্টা করছে ওয়াসা। কৃষি মন্ত্রণালয় গত সপ্তাহে ইউরিয়া সারের দাম প্রায় ৩৮ শতাংশ বাড়িয়েছে। ৬ টাকা বাড়িয়ে প্রতি কেজিতে নতুন দর নির্ধারণ করা হয়েছে ২২ টাকা।
জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ শুক্রবার তাঁর বাসায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম আরেক দফা বাড়ানোরও ইঙ্গিত দিয়েছেন। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর একটি প্রস্তাব ইতিমধ্যে বিইআরসিতে প্রক্রিয়াধীন।
বিপাকে কৃষকেরা
এদিকে ডিজেলের দাম বাড়ার কারণে কৃষি এখন কঠিন অবস্থায় পড়ে গেল বলে মনে করছেন এ অঞ্চলের অনেক কৃষক। সেচের পেছনে আরও ৫০ শতাংশ খরচ বৃদ্ধি পাবে জানিয়ে অধিকাংশ কৃষক বলছেন, এমনিতেই কৃষকের মূলধনের সংকট, তার ওপর হঠাৎ জ্বালানি তেলের একসঙ্গে এত বেশি দাম বাড়ার ধাক্কা সামলানো তাদের জন্য কষ্টসাধ্য।
তেলের দাম বাড়ার কারণে চলতি মূলধনের সঙ্গে আরও মূলধন যোগ করতে হবে উল্লেখ করে তারা জানান, বাড়তি বিনিয়োগের বোঝা টানা তাদের জন্য অনেকটাই অসম্ভব।
কৃষকরা জানান, আগে শ্যালোমেশিনে এক ঘণ্টা সেচ দিতে ১০০ টাকা লাগলেও এখন এর পেছনে ব্যয় হবে ১৫০ টাকা। নিশ্চিতভাবে এই দাম বাড়ার বড় একটা প্রভাব পড়বে উৎপাদন ব্যয়ে। শেষমেশ চালের বাজারে গিয়ে ঠেকবে এর প্রভাব।
‘ভোক্তার অধিকার তছনছ’
বাজারে এখন চাল, ডাল, তেল, চিনি, সাবান, টুথপেস্টসহ প্রায় সব পণ্যের দাম বেশি। গত মে মাসের পর ডলারের দাম ৮৬ থেকে ১০৮ টাকায় উঠে যাওয়ায় আমদানি করা সব পণ্যের দাম বাড়ছে। এমন অবস্থায় জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি মানুষকে বড় সংকটে ফেলবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, আইএমএফের ঋণ পাওয়ার শর্ত ছিল ঘাটতি সমন্বয়। দাম বাড়িয়ে ঘাটতি সমন্বয় করতে গিয়ে জনগণের ওপরের যে আঘাত হানা হয়েছে, তা সিডর–আইলার মতো ঘূর্ণিঝড়কে হার মানায়।
এম শামসুল আলম বলেন, দুর্নীতি ও অপচয় বন্ধ করেও ঘাটতি সমন্বয় করা যেত। সরকার সেই পথে হাঁটেনি। জ্বালানি তেলের দাম গণশুনানি করে বাড়ালে তা সহনীয় থাকত। এখন যে ‘টর্নেডো’ চালিয়ে দেওয়া হলো, তাতে ভোক্তার অধিকার তছনছ হয়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞের মতামত
বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দাম যখন কমছে, সেই সময়ে বাংলাদেশে দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘সরকারের এই সিদ্ধান্তের একটা ধারাবাহিকতা আছে। বিশ্ব বাজারে তেলের দাম যখন বেশি ছিল না তখন থেকেই দেশে তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া অব্যাহত ছিল।’
তেলের দাম বৃদ্ধির এই সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জনগণের দিক থেকে দেখলে এর জন্য কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। সরকার দাবি করছে, বিশ্ব বাজারে তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমাদের দেশে তেলের দাম বাড়ানো হলো। কারণ, সরকারের পক্ষে আর ভর্তুকি দেওয়া সম্ভব না। এই দাবির পেছনে কোনো যুক্তি পাওয়া যায় না।’
যুক্তি কেন পাওয়া যায় না সেই ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গত কিছু দিনে তেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও বিশ্ব ব্যাপী মন্দার আবহাওয়া তৈরি হওয়ায় তেলের দাম কমে যাচ্ছে। একই কারণে সামনে তেলের দাম আরও কমে যাবে। কাজেই বিশ্ব বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে আমাদের দেশে তেলের দাম বাড়ানোর যুক্তি কোনোভাবেই প্রাসঙ্গিক না।’
‘দ্বিতীয়ত, বিশ্ব বাজারে তেলের দাম যখন বাড়তি ছিল তখন বিভিন্ন দেশে ভোক্তা পর্যায়ে দাম সহনীয় রাখতে বিভিন্ন ধরনের শুল্ক প্রত্যাহার করে। কিন্তু বাংলাদেশে এটা এখনো অব্যাহত আছে। সরকার শুল্ক না নিলে দাম অনেকটাই কমে যাওয়ার কথা।’
‘তৃতীয়ত, আমরা তো এই হিসাবটা ভুলতে পারি না যে, ২০১৪ থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে যখন তেলের দাম খুবই কম ছিল তখন দেশে তেলের দাম কমায়নি সরকার। ফলে, তাদের লাভ হয়েছে বেশ বড় অংকের। সরকারি হিসাবেই সেটা প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকা। গত কিছু দিনে যদি লোকসানও হয় সেটা ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার কোটি টাকার মতো হতে পারে। তাহলে, কয়েকগুণ বেশি লাভের টাকা তাদের হাতে রয়েছে। তেলের দামের এই ঊর্ধ্বমুখী তৎপরতার সময় সরকার চাইলে লাভের ওই টাকা থেকে সমন্বয় করতে পারত, এর জন্য তাদের হাতে তহবিল ছিল। এটা বেশি দিন করতেও হতো না, কারণ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে যে বিশ্ব বাজারে তেলের দাম কমে যাচ্ছে।’
দেশের অকটেন ও পেট্রলের দাম বৃদ্ধি পুরোপুরি অযৌক্তিক উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘গত ২৭ জুলাই প্রধানমন্ত্রী একটি অনুষ্ঠানে পরিষ্কার ভাবে বলছেন যে অকটেন ও পেট্রল আমাদেরকে বিশ্ব বাজার থেকে কিনতে হয় না। প্রাকৃতিক গ্যাসের বাই প্রডাক্ট হিসেবে এটা পাওয়া যায় এবং আমাদের চাহিদার তুলনায় বেশি পরিমাণ অকটেন, পেট্রলের মজুদ আছে। তাহলে এর দাম বাড়ানোর তো কোনো প্রশ্নই আসে না। বিশ্ব বাজারের হিসাব এখানে একেবারেই অচল।’
তিনি আরও বলেন, ‘একমাত্র ডিজেলের দাম বাড়ানোর কথা বলা যায়। সেখানেও আমদানি শুল্ক কমিয়ে, বাড়তি তহবিল সমন্বয় করে এর দাম কম রাখার বিকল্প ছিল।’
এসডব্লিউ/এসএস/০৭৩২
আপনার মতামত জানানঃ