বিদ্যুৎ–সংকট মোকাবিলায় এবং অর্থনৈতিক সংকট এড়াতে আগামীকাল মঙ্গলবার (১৯ জুলাই) থেকে সারাদেশে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ লোডশেডিং হতে পারে দুই ঘণ্টা পর্যন্ত। আর এখন থেকে সপ্তাহে এক দিন বন্ধ থাকবে পেট্রলপাম্প। খরচ সাশ্রয়ের জন্য ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন আপাতত স্থগিতের সিদ্ধান্তও নিয়েছে সরকার।
আজ সোমবার এ কথা জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। আজ সোমবার (১৮ জুলাই) প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এ বিষয়ে এক সভার পর প্রতিমন্ত্রী এ তথ্য জানান। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে আজ বিকালে সংবাদ সম্মেলন করবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ওই সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব আহমেদ কায়কাউস এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব তোফাজ্জল হোসেন প্রমুখ।
সাংবাদিকদের সামনে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘কোন এলাকায় বিদ্যুতের লোডশেডিং হবে, তা আগে থেকে গ্রাহককে জানিয়ে দেওয়া হবে। আমরা সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছি শিল্প খাতকে।’ তিনি আরও বলেন, আগামী এক সপ্তাহে এক থেকে দুই ঘণ্টা লোডশেডিং দেওয়া হবে। পরে পরিস্থিতি বুঝে ভিন্ন রকম সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, এখন থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সারা দেশে এক দিন পেট্রলপাম্প বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে কীভাবে, কোন পদ্ধতিতে বন্ধ রাখা হবে, সেটা পরে জানানো হবে।
তিনি বলেন, ‘পরীক্ষামূলকভাবে সাময়িক এই লোডশেডিং হবে। আগেই সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হবে।’ তবে লোডশেডিং কোথাও টানা দুই ঘণ্টা করা হবে না বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে। সূত্রটি জানিয়েছে, দিনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আধা ঘণ্টা করে সব মিলিয়ে এক থেকে দুই ঘণ্টা লোড শেডিং হতে পারে।
সেইসঙ্গে যানবাহনে জ্বালানির ব্যবহার কমানোর বিষয়েও পদক্ষেপ নেবে সরকার। প্রতিমন্ত্রী জানান, গাড়িতে তেল কম ব্যবহার করতে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
নসরুল হামিদ আরও বলেন, ‘সরকারি-বেসরকারি অফিসের সময়ও এক থেকে দুই ঘণ্টা কমিয়ে আনা যায় কি না, সে বিষয়টিও পর্যালোচনা করা হচ্ছে। তবে এখনও চূড়ান্ত হয়নি।’ অফিসের বৈঠক অনলাইনে করার বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এছাড়াও রাত ৮টার পর দোকানপাট, শপিংমল বন্ধ রাখার আগের যে সিদ্ধান্ত রয়েছে, তা বাস্তবায়নে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানানো হয়। সেই সঙ্গে নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, অফিস-আদালত ও বাসাবাড়ির এয়ার কন্ডিশনের (এসি) তাপমাত্রা ২৪ ডিগ্রির উপরে রাখতে হবে এবং মসজিদে এসি চালানো যাবে না।
পাশাপাশি বন্দর এলাকায় সপ্তাহে দুই দিন পেট্রলপাম্প বন্ধ রাখার বিষয়ে ভাবা হচ্ছে বলেও জানান নসরুল হামিদ।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘এটা দীর্ঘমেয়াদি নয়, আমাদের সাশ্রয়ী হতে হবে। বিদ্যুতের বেশি অগ্রাধিকার শিল্প ও ব্যবসায়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য। আগামী কাল থেকে সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হবে।’
এর আগে গত ৭ জুলাই তৌফিক–ই–এলাহী চৌধুরী বলেছিলেন, লোডশেডিং স্বাভাবিক হতে আরও আড়াই মাস সময় লাগবে। সেপ্টেম্বর নাগাদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে পারে। ওই সময় বেশ কয়েকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হবে।
সেপ্টেম্বরের মধ্যে কীভাবে জ্বালানি–সংকট কমে আসবে, তার ব্যাখ্যা দিয়ে তৌফিক–ই–এলাহী চৌধুরী বলেন, ওই সময়ের মধ্যে আদানি থেকে কয়লাভিত্তিক ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট এবং পায়রা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিট থেকে ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। তখন লোডশেডিং কমে আসবে।
আজকের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা তৌফিক–ই–এলাহী চৌধুরী বলেন, খরচ কমাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন আজ থেকে সাময়িক বন্ধ থাকবে। এ সিদ্ধান্ত সাময়িক। বিশ্ব পরিস্থিতির উত্তরণ হলে আগের অবস্থানে ফিরে আসা হবে।
জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, ‘পৃথিবীতে একটা যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে। ইউক্রেনের যে যুদ্ধ, সে যুদ্ধ কিন্তু আমাদেরও যুদ্ধ। ওই যুদ্ধের প্রভাব পড়ছে আমাদের ওপর।’ তিনি আরও বলেন, ‘যাদের অর্থের অভাব নেই, তারাও কিন্তু লোডশেডিং করছে। যুক্তরাজ্যে হচ্ছে, অস্ট্রেলিয়ায় হচ্ছে। উৎপাদনকে কমিয়ে খরচ যাতে সহনশীল হয়, সে পর্যায়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করছি। ডিজেলের বিদ্যুৎ উৎপাদন আপাতত স্থগিত করলাম, তাতে অনেক টাকা সাশ্রয় হবে। মনে রাখতে হবে, ডিজেলের দাম আকাশচুম্বী হয়ে গেছে।’
তৌফিক–ই–এলাহী চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের ধারণা, এক থেকে দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি হবে। এতে দিনে এক থেকে দেড় ঘণ্টা এবং কোনো কোনো জায়গায় দুই ঘণ্টাও লোডশেডিং হতে পারে। কিন্তু দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এবং পৃথিবীর এই দুর্যোগপূর্ণ সময়ে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।’
জ্বালানি সাশ্রয় করলে চাহিদা কত কমে আসবে—এমন প্রশ্নের জবাবে তৌফিক–ই–এলাহী চৌধুরী গত ৭ জুলাই বলেছিলেন, আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জাতীয় গ্রিডে ১৪ হাজার মেগাওয়াট চাহিদা থাকতে পারে। অফিস–আদালতের সময় কমিয়ে আনলে, আলোকসজ্জা বন্ধ হলে চাহিদা কমে ১২ হাজার ৫০০ মেগাওয়াটে নেমে আসবে। সবাই সাশ্রয়ী হলে লোডশেডিং কমে আসবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন এক কর্মকর্তা জানান, তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মধ্যে ডিজেলচালিতগুলো বন্ধ রাখা হলেও ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্রগুলো প্রয়োজনে চালু রাখা হবে।
এদিকে বাজারে এলএনজির দাম বেড়ে যাওয়ায় ২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানিও বন্ধ রাখা হয়েছে। ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘এটি আসলে জ্বালানির সংকট নয়, সংকট যাতে তৈরি না হয় সেজন্য আগেই সাশ্রয়ের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।’
এসডব্লিউ/এসএস/১৬১০
আপনার মতামত জানানঃ