বাংলাদেশের সমাজ ক্রমেই অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। সাম্প্রদায়িকতার ছোবলে বাংলাদেশ এখন ক্ষতবিক্ষত। সরকার সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। অতীতে ঘটে যাওয়া ঘটনার বিচার না হওয়ায় সংখ্যালঘুদের ওপর নিয়মিত হামলা হচ্ছে। সরকারের নিষ্ক্রিয়তায় অপরাধীরা উসকানি পাচ্ছে।
গত শুক্রবার নড়াইলের লোহাগড়ায় এক ফেসবুক পোস্টে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এরপর গতকাল ভুক্তভোগী একজনকেই গ্রেপ্তার করা হয়। অথচ যারা ভাঙচুর চালালো, ব্যক্তিগত সম্পত্তির ক্ষতি করলো, তারা থেকে গেল বিচারের ঊর্ধ্বে। আর এর কারণ তারা পরে আছে ধর্মের বর্ম।
গ্রেপ্তার করা হয় ভুক্তভোগীদেরকেই
ফেসবুকে ধর্মীয় অবমাননাকর পোস্ট দেওয়ায় অভিযোগে আকাশ সাহাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গতকাল শনিবার দিবাগত রাত দুইটার দিকে খুলনা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগে গতকাল রাতে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়।
উল্লেখ্য, আকাশ দিঘলিয়া গ্রামের ব্যবসায়ী অশোক সাহার ছেলে। তিনি স্থানীয় নবগঙ্গা ডিগ্রি কলেজের স্নাতকের ছাত্র।
নড়াইলের লোহাগড়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) হারান চন্দ্র পাল বলেন, আকাশকে আজ রোববার আদালতে সোপর্দ করা হবে। দিঘলিয়া এলাকার বাসিন্দা সালাউদ্দিন কচি বাদী হয়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। ওই মামলায় আকাশকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ওই ফেসবুক পোস্টের জের ধরে গত শুক্রবার সন্ধ্যার পর দিঘলিয়া বাজারের কয়েকটি দোকান ভাঙচুর ও একটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে উত্তেজিত লোকজন। একটি মন্দির ভাঙচুর এবং দুটি পারিবারিক মন্দিরে হামলার ঘটনা ঘটে।
পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে লাঠিপেটা করে এবং ফাঁকা গুলি ছোড়ে। রাত সাড়ে নয়টার পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
এদিকে আজ সকালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এলাকার পরিস্থিতি শান্ত রাখতে মোড়ে মোড়ে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এলাকায় টহল দিচ্ছে র্যাব ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। পুলিশের বিশেষ শাখা ও গোয়েন্দা শাখার সদস্যরাও সার্বক্ষণিক ওই এলাকায় অবস্থান করছেন। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতা, জনপ্রতিনিধিরাও সেখানে আছেন।
দিঘলিয়া সাহাপাড়ার বাসিন্দাদের কেউ কেউ বাড়িতে ফিরতে শুরু করেছেন। তাদের অধিকাংশই হামলার পর বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। ঘটনার পর থেকে দিঘলিয়া বাজারের দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। আজ সকালে কিছু কিছু দোকান খুলেছে।
লোহাগড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আজগর আলী প্রথম আলোকে বলেন, এলাকার পরিস্থিতি শান্ত আছে। তারপরও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আগামী শুক্রবার পর্যন্ত প্রতিদিন দিঘলিয়া বাজারের দোকানপাট সকাল নয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সাম্প্রদায়িক হামলা যেন ধর্মীয় অধিকার
গত ৯ বছরে বাংলাদেশে একটিও সাম্প্রদায়িক হামলার বিচার হয়নি। আর এই বিচারহীনতাই উস্কে দিয়েছে সাম্প্রদায়িকতাকে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বলেছে, যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া পোস্টকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা ছড়িয়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা নতুন কিছু নয়। কোনো বিচার দ্রুততম সময়ে না হওয়ায় অপরাধীরা এ ধরনের অপরাধ করে পার পেয়ে যাচ্ছে। অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি ধর্মীয় সংখ্যালঘু পরিবার ও সম্পত্তির নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছে তারা।
অতীতে হিন্দুদের ওপর হামলা-নির্যাতনে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র ও সরকারের ব্যর্থতার কারণে বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ। দলটির সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার এক বিবৃতিতে বলেছেন, হিন্দুদের ওপর হামলাকারীরা নিজেদের বিচারের ঊর্ধ্ব ভাবতে শুরু করেছে। তারা বিচারহীনতার এই সংস্কৃতির অবসান দাবি করেন।
বাম গণতান্ত্রিক জোট বলেছে, দেশে অব্যাহতভাবে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস, শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটছে। সরকার প্রায় নিষ্ক্রিয়-নির্বিকার, যা এ–জাতীয় ঘটনা বারবার সংঘটিত হওয়ার ক্ষেত্রে ইন্ধন জোগাচ্ছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় দেশের সচেতন মানুষকে এগিয়ে আসতে ও স্থানীয়ভাবে সম্প্রীতি রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ কার্যক্রম নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে এই জোট।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম ও সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স এক বিবৃতিতে বলেছেন, বর্তমান সরকারসহ অতীতের সরকারগুলোর কর্মকাণ্ড সমাজকে সাম্প্রদায়িকীকরণের ধারায় নিয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের বিশেষ নজরদারি ও কার্যকর ভূমিকা নেওয়ার প্রয়োজন।
উল্লেখ্য, ২০০১ সালের নির্বাচনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও সহিংসতা নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার একটি বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করেছিল। সেই কমিশন যেসব সুপারিশ করেছে, তা এখনো ফাইলবন্দী আছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রামু, নাসিরনগর, শাল্লা, সাঁথিয়া ও গোবিন্দগঞ্জে ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর ওপর যেসব হামলা হয়েছে, সেসব মামলারও বিচার হয়নি। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা শাস্তি পায়নি।
দেশে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনাগুলোর বিচার হয় না। অভিযুক্তরা সবাই একপর্যায়ে ছাড়া পেয়ে যান। কিন্তু ঝুমন দাশের মতো ব্যক্তিদের মুক্তি পেতে হয় অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে।
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বলেন, সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। কিন্তু কোনো বিচার হয় না। আজও এই ধারা অব্যাহত আছে। এই দায়মুক্তির সংস্কৃতির কারণে সাম্প্রদায়িক শক্তি উৎসাহিত হচ্ছে। এই শক্তি মনে করে, ঠিক একাত্তরের মতো টার্গেট করে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালিয়ে, তাদের ঘরবাড়ি দখল করে, মন্দির-মঠ-গির্জা ধ্বংস করে এবং নারী-মেয়েদের ধর্ষণ করে তাদের দেশ থেকে বের করে দেওয়া যায়। পাকিস্তান আমল থেকে শুরু হওয়া এই সর্বনাশা ধারা এখনো অব্যাহত আছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪১৫
আপনার মতামত জানানঃ