পৃথিবীর পরিধি ছাড়িয়ে মহাবিশ্বেও মানব সভ্যতার বিকাশ পুরোটাই এখন আর সায়েন্স ফিকশন নয়। প্রসঙ্গত, মানব জাতির ভবিষ্যত মহাকাশে। খুব বেশিদিন আর পৃথিবীর বুকে থাকবে না মানুষ-গত বছর শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসি’তে অনুষ্ঠিত ‘ইগনাটিস ফোরাম’-এ মানুষের ভবিষ্যত সম্পর্কে নিজ এই ধারণা তুলে ধরেছিলেন জেফ বেজোস।
তার মতে, একসময় মহাকাশে সন্তান সন্ততির জন্ম দেবে মানুষ। হয়তো গড়ে ফেলা হবে পুরোদস্তুর উপনিবেশ। এমনকি সেখানকার বাসিন্দারা হয়তো ছুটি কাটাতে আসবেন পৃথিবীতে। ঠিক যেমন আমরা পরিবার নিয়ে ছুটির দিনে বেড়াতে যাই ভিক্টোরিয়া, চিড়িয়াখানায়।
জেফ বেজোসের দাবি, আগামী দিনে এটাই হতে চলেছে। কারণ একটা সময় পৃথিবীতে আর জনসংখ্যা বাড়ানো সম্ভব হবে না। তখন বিকল্প কী? কেমন সেই পরিকল্পনা? ওয়াশিংটন ডিসি-তে একটি অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে এ প্রসঙ্গে নিজের পরিকল্পনা জানিয়েই চমকে দিয়েছিলেন জেফ।
তবে এ ক্ষেত্রে কিছু সমস্যাও আছে। প্রথমত, পৃথিবীর বাইরে জল এবং অক্সিজেনের অভাবই এই গ্রহে আবদ্ধ করে রেখেছে আমাদের। তবে তার চেয়েও বড়ো সমস্যা হল, পৃথিবীর বাইরে বায়ুমণ্ডলীয় চাপের অভাব। অন্যান্য গ্রহ বা উপগ্রহের অভিকর্ষ বলও ভিন্ন। ফলে, স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলাও করা সম্ভব নয় সেখানে।
কিন্তু এবার এই সমস্যারই অভিনব সমাধান খুঁজে বার করলেন জাপানের বিজ্ঞানীরা। তৈরি করে ফেললেন মহাজাগতিক মানব-কলোনির নকশা।
হ্যাঁ, শুনতে অবাক লাগলেও সত্যি। গত ৬ জুলাই রীতিমতো সাংবাদিক সম্মেলন করেই এই অভিনব আবিষ্কারের কথা প্রকাশ্যে আনলেন জাপানের গবেষকরা। কিয়োটা বিশ্ববিদ্যালয় এবং কাজিমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানির যৌথ প্রচেষ্টায় তৈরি হয়েছে এই মহাজাগতিক ঔপনিবেশিক নকশা।
‘দ্য গ্লাস’-খ্যাত সে শহরে গণপরিবহন থেকে শুরু করে গ্রিন বেল্ট, জলাশয়, উন্মুক্ত মাঠ—রয়েছে সবকিছুই। বহির্বিশ্বে এই শহরে দু’দণ্ড কাটালে একবারের জন্যেও মনে হবে না, এ আসলে মহাশূন্য।
পৃথিবীর অভিকর্ষ ক্ষেত্রের বাইরে গেলেই ভরশূন্য হয়ে যায় মানুষ। তাই প্রত্যেক নভোচারীকেই আলাদা করে অভ্যেস করতে হয় স্পেস-ওয়াকিং। তবে জাপানের এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে ভর হারাবে না মানুষ।
হ্যাঁ, এই শহরে তৈরি করা হবে কৃত্রিমভাবে অভিকর্ষ ক্ষেত্র। অভিকর্ষ ক্ষেত্র বললে খানিকটা ভুলই হবে। আসলে, ঘূর্ণনকে কাজে লাগিয়েই এমনটা সম্ভব করেছেন গবেষকরা। কোনো ঘূর্ণায়মান পদার্থের গতিবেগের জন্য কেন্দ্রের বাইরের দিকে একটি বল প্রযুক্ত হয়। যা পরিচিত সেন্ট্রিফিউগাল ফোর্স নামে।
বহির্বিশ্বের শহরে এই বলকেই অভিকর্ষ বলের প্রতিরূপ হিসাবে কাজে লাগাচ্ছেন গবেষকরা। হ্যাঁ, মহাশূন্যে অনেকটা লাট্টুর মতোই ঘুরবে এই শহর। অনেকটা পৃথিবীর মতোই।
এবার আসা যাক খাদ্য, পানীয় ও অন্যান্য সম্পদের কথায়। পৃথিবীতে খাদ্যের মূল উৎপাদক আসলে উদ্ভিদরাই। সেখান থেকেই খাদ্য-খাদক শৃঙ্খল পেরিয়ে প্রাণীজ সম্পদ পেয়ে থাকি আমরা। মহাজাগতিক উপনিবেশের ক্ষেত্রেও ঘটবে একই ঘটনা।
ভাসমান এই শহরের কেন্দ্রে থাকবে ঘূর্ণায়মান বায়োম। সেখানেই উৎপাদিত হবে শস্য। ঘূর্ণনের গতি কমিয়ে কিংবা বাড়িয়ে ফসলের উৎপাদনও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব—তাত্ত্বিকভাবে এটা প্রমাণও করেছেন গবেষকরা। অন্যদিকে শক্তির চাহিদা পূরণ করবে সূর্য। তবে পানীয়ের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করতে হবে রাসায়নিকের ওপরেই।
তবে প্রশ্ন থেকে যায় অন্য জায়গায়। যদি এক শহর থেকে অন্য শহরে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে? তবে কি ব্যয়বহুল স্পেস শাটলের শরণাপন্ন হতে হবে? শিখতে হবে স্পেসওয়াকিং? না, তেমনটা নয় একেবারেই।
‘হেক্সাট্র্যাক’-খ্যাত এক নতুন প্রযুক্তির সন্ধান দিয়েছেন জাপানি বিজ্ঞানীরা। এই যানও চলবে সর্পিলাকার পথে। ক্রমশ ব্যাসার্ধ বাড়বে সেই পথের। সেইসঙ্গে পরিবর্তিত হবে যানের গতিও। ফলে, মূল ঘূর্ণায়মান শহরের বাইরে চলে এলেও পরিবর্তিত হবে না কৃত্রিম মাধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্র। কাজেই প্রয়োজন নেই স্পেস-ওয়াকিং শেখার। স্বাস্থ্যের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাও নেই সেক্ষেত্রে।
নাসা-সহ বিশ্বের একাধিক প্রথম সারির মহাকাশ সংস্থারই দাবি একুশ শতকের শুরুর দিকেই হয়তো পৃথিবী ছেড়ে মহাকাশের দিকে পা বাড়াবে মানুষ। মঙ্গল বা চাঁদে তৈরি হবে বেস। জাপানের হাত ধরেই সেই কল্পজগতের সূচনা হল যেন। জাপানি গবেষকদের তৈরি অভিনব এই শহরের নকশাই যেন পথ দেখাচ্ছে ভবিষ্যতের।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬১০
আপনার মতামত জানানঃ