বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, জনগণের জানমাল ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান, অপরাধ প্রতিরোধ ও দমনে প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে। শুধু আইন পরিপালন নিশ্চিত করা আর অপরাধ প্রতিরোধ বা দমনই নয়, দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রাখতে পুলিশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
বাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বলা হয়। এই বিভাগ যেকোনো দেশ ও জাতির একটি স্থায়ী সম্পদ। তারা আইন ও নীতি-নৈতিকতার ব্যাপারে উচ্চতর স্থানে থাকার কথা। অথচ সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে পুলিশের কিছু সদস্য বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এ প্রবণতা এতই বাড়ছে যে, সহকর্মীরাও যৌন হয়রানি, ধর্ষণ থেকে ছাড় পাচ্ছে না। কেউ কেউ হত্যা, ধর্ষণ ও ডাকাতির মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। বিশেষ করে চাঁদাবাজি ও মাদকের সাথে সম্পৃক্ত থাকা আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে।
ফরিদপুরের বোয়ালমারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) বিরুদ্ধে শারীরিক নির্যাতন এবং মিথ্যা মামলা ও ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগ করেছেন স্থানীয় এক ব্যবসায়ী।
ওসি আব্দুল ওহাবের বিরুদ্ধে বুধবার পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শকের (ডিআইজি) কাছে লিখিত অভিযোগ দেন পাইকারি ব্যবসায়ী মাসুদ আলম।
অভিযোগে বলা হয়, গত মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে নিজের দোকানে ছিলেন মাসুদ। সে সময় বোয়ালমারী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মামুন অর রশিদ তার দোকানে গিয়ে জানান, ওসি থানায় ডেকেছেন। এরপর তাকে পুলিশের গাড়িতে করে নিয়ে যান।
থানায় গেলে ওসি ওহাব তার নাম-ঠিকানা জিজ্ঞেস করেন। এরপর রুমের ক্লোজড সার্কিট টেলিভিশন (সিসিটিভি) ক্যামেরা বন্ধ করে ও দরজা লাগিয়ে মাসুদকে মারধর করেন ওহাব।
অভিযোগে আরও বলা হয়, মারধর শেষে ওহাব তার কাছে ২ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। চাঁদা না দিলে বিভিন্ন মামলায় জড়ানোর ভয় দেখান। এরপর মাসুদ তার স্ত্রীকে খবর দিলে, তিনি ১ লাখ টাকা দিয়ে স্বামীকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান।
বিষয়টি কাউকে জানালে ক্রসফায়ারের হুমকিও দেন ওসি ওহাব। থানা থেকে বেরিয়ে বোয়ালমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নেন মাসুদ।
মাসুদ সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘পারিবারিক সম্পত্তি নিয়ে বাবার সঙ্গে আমার ঝামেলা রয়েছে। এ নিয়ে আদালতে দেওয়ানি মামলাও চলছে। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য ওসি ওহাব আমাকে থানায় ডেকে নিয়ে যান।
‘থানায় নিয়ে তার রুম আটকে আমাকে কোনো কিছু বলার সুযোগও দেননি। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও লাঠি দিয়ে বেধড়ক পেটানো শুরু করেন। পিটিয়ে এক ঘণ্টা পর ১ লাখ টাকা নিয়ে আমাকে ছেড়ে দেন। আমি থানা থেকে বের হয়ে স্ত্রীসহ হাসপাতালে যাই চিকিৎসা নিতে।’
তবে পুরো অভিযোগ অস্বীকার করেন ওসি ওহাব। তিনি বলেন, ‘মাসুদের সঙ্গে তার বাবার পারিবারিক সম্পত্তি নিয়ে একটি ঝামেলা চলছে। বিষয়টি নিয়ে অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে থানায় ডাকা হয়। সে সময় থানায় বাবা-ছেলে দুজনই উপস্থিত ছিলেন।
‘বাবা-ছেলের মধ্যে মীমাংসার চেষ্টা করা হয় কিন্তু মাসুদ রাজি না হওয়ায় তাদের আদালতে যাওয়ার জন্য বলা হয়। পরে তারা বাবা-ছেলে দুজনই থানা থেকে চলে যান। এর বেশি কিছু নয়। আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সঠিক নয়।’
পুলিশে জবাবদিহিতার অভাবেই এ পরিস্থিতি। এটি কমাতে হলে দায়িত্বশীল অফিসারদেরও জবাবদিহিতা ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে।’
এদিকে চট্টগ্রামে ইয়াবাসহ পুলিশের এক সদস্য ও তার তিন সহযোগীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গ্রেপ্তার পুলিশ সদস্যের নাম উপল চাকমা। তিনি নগর পুলিশের বিশেষ শাখায় (সিটিএসবি) কনস্টেবল হিসেবে কর্মরত।
নগর পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর) মোখলেসুর রহমান সংবাদমাধ্যমকে বলেন, পুলিশ কনস্টেবল উপল চাকমাকে তিন সহযোগীসহ আটক করে র্যাব। তাদের কাছ থেকে ৫ হাজার ২৬০টি ইয়াবা উদ্ধার করা হয়।
চারজনের বিরুদ্ধে আজ শুক্রবার পাঁচলাইশ থানায় মামলা করা হয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে করা এই মামলার বাদী র্যাব–৭–এর ডিএডি মো. শহিদুল আলম।
পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ এলেই তাদের কারো কারো ক্ষেত্রে বিভাগীয় মামলা হয়, কারো ক্ষেত্রে ফৌজদারি মামলা হয়। শাস্তির মাধ্যমে যদিও তাদের বোঝানো হয়, অপরাধ করলে পার পাওয়া যায় না। কিন্তু বাস্তবতা হলো- পুলিশে অপরাধ কমছে না, বাড়ছে প্রতিদিন।
অপরাধবিজ্ঞানীরা মনে করেন, ‘পুলিশে জবাবদিহিতার অভাবেই এ পরিস্থিতি। এটি কমাতে হলে দায়িত্বশীল অফিসারদেরও জবাবদিহিতা ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে।’
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এ অন্যায় অনৈতিক কাজের কারণেই সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ও অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এর সুযোগ নিচ্ছে বিভিন্ন অপরাধীরা বা অপরাধী গোষ্ঠী। তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে বা তাদের সহযোগিতায় প্রকাশ্যেই সব বেআইনি অপরাধ করে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে অনেকেই নানাভাবে দ্রুত আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করছে, আবার অনেকেই রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে বেপরোয়া হয়ে নানা অপরাধ করছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ, পোস্টিং ও পদোন্নতির কারণেই এমনটি হয়েছে বলে মনে করেন অনেকে।
অপরাধী যেই হোক, অপতৎপরতা-অনৈতিক থেকে পুলিশ বিভাগকে মুক্ত করার জন্য শক্তিশালী জবাবদিহির ব্যবস্থা এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ছাড়াও যুগোপযোগী আইনেরও প্রয়োজন। প্রয়োজন আইনের সংস্কার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীরা যদি অনৈতিক কাজ করে আর শাস্তি যদি ১০০ টাকা হয় অপরাধ দমন তো হবেই না, বরং উৎসাহিত হবে। আর অপরাধ দমনের দায়িত্বে নিয়োজিতদের মধ্যে যারা নিজেরাই অপরাধে লিপ্ত হয়, তাদের শাস্তি অধিকতর কঠোর হওয়া দরকার।
তারা বলেন, বাংলাদেশ পুলিশ দক্ষতার পরিচয় দিয়ে আসছে দীর্ঘ দিন থেকে। অথচ ঘুষ, অনৈতিক, দুর্নীতির কারণে অভিযুক্ত এই বাহিনী তার পেশাদারিত্ব হারাচ্ছে। জনগণের প্রতি তার দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়ে জনগণের গর্বের বাহিনীতে পরিণত করতে হবে ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৩৬
আপনার মতামত জানানঃ