প্রসঙ্গত, বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে দেশে বছরে ১০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ (৭ লাখ) মৃত্যুই অসংক্রামক রোগে ঘটে থাকে। সে হিসাবে দেশে দিনে গড়ে এক হাজার ৯০০ মানুষ অসংক্রামক রোগে মারা যায়।
দেশে অসংক্রামক রোগের কারণে অপরিণত মৃত্যু বাড়ছে। যত মৃত্যু হয়, এর ১০ জনের মধ্যে সাতজনই অসংক্রামক ব্যাধিতে মারা যাচ্ছেন। অর্থাৎ উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ক্যানসারসহ আরও কয়েকটি রোগে ৭০ শতাংশের বেশি মানুষ মারা যান। এসব রোগে ৩০ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে বেশি মৃত্যু হয়।
দেশে অসংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্যানসার, কিডনি, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে দেশের ৬৭ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। কয়েক বছর ধরে এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আজ সোমবার এমনটাই বলেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
দেশে ৬৭ শতাংশ মানুষ অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। গত কয়েক বছর এই রোগে আক্রান্তের হার বেড়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনসের ৫০ বছর পূর্তি ও ১৪তম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এসব কথা বলেন। সোমবার সকাল ১০টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত সমাবর্তনে মন্ত্রী এ কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে গণভবন থেকে অনুষ্ঠানে যুক্ত হন।
জাহিদ মালেক বলেন, দেশে অসংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্যানসার, কিডনি, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে দেশের ৬৭ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। কয়েক বছর ধরে এই রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এর কারণ আমাদের জীবনাচরণ পরিবর্তন হয়েছে। খাদ্যাভ্যাস, ধূমপান, প্রক্রিয়াজাত খাবারের প্রভাব, বায়ু-পানি দূষণ ও মানসিক চাপ বেড়েছে।
এসব রোগের চিকিৎসায় আট বিভাগে আটটি হাসপাতাল স্থাপন করা হচ্ছে। প্রতি জেলায় ১০ শয্যার ডায়ালাইসিস সেন্টার ও আইসিসির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বিশেষায়িত হাসপাতালে যখন কার্যক্রম শুরু হবে তখন বিশেষায়িত চিকিৎসক প্রয়োজন হবে। আমি আশা করি, বিসিপিএস থেকে প্রশিক্ষিত ডাক্তাররাই ওখানে মানুষের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করবে।
তিনি আরও বলেন, পরিবেশ দূষণমুক্ত নিরাপদ করার আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। স্বাস্থ্যব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়নের জন্য হাসপাতাল ডিজিটাইজেশনের ব্যবস্থা হাতে নেয়া হয়েছে।
পাশাপাশি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর চিকিৎসা নিশ্চিতে সারা দেশে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হয়েছে, যেখানে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ৩২ প্রকার ওষুধ বিনা মূল্যে সরবরাহ করা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, দেশে অসংক্রামক রোগে আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেশি হারে বাড়ছে। আগে এই রোগের প্রবণতা বয়স্ক মানুষের মধ্যে দেখা যেত। এখন তরুণরাও আক্রান্ত হচ্ছে। মানুষের জীবনাচার পরিবর্তন এর অন্যতম কারণ।
কিন্তু এর কারণ কী? কারণ হলো, অসংক্রামক রোগ একবার দেখা দিলে আজীবন চিকিৎসা নিতে হয়। কিন্তু এটা ব্যয়বহুল। এই রোগে আক্রান্তের হার বৃদ্ধিতে সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর চাপ তৈরি হচ্ছে। নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে হাসপাতালের সামগ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায়ও।
এদিকে, বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক এন্ড হেলথ সার্ভের (বিডিএইচএস) তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতি ৪ জনে ১ জন উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। দেশে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৩ কোটি। আর প্রতি ১০ জনে ১ জন ডায়াবেটিসে ভুগছেন। দেশে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা ১ কোটি ১০ লাখ।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব প্রিভেন্টিভ এন্ড সোশ্যাল মেডিসিন (নিপসম) পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ৯৭ ভাগ মানুষ কোনো না কোনোভাবে হৃদরোগের ঝুঁকিতে রয়েছে। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু কিডনি বিভাগের অধ্যাপক ডা. আফরোজা বেগম জানান, দেশে কমপক্ষে ২ কোটি মানুষ বিভিন্ন ধরনের কিডনি রোগে ভুগছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জাতীয় জরিপে বলা হয়, ২০২০ সালে করোনায় মৃত্যু হয়েছে ৮ হাজার ৪৯৬ জনের। ওই বছরই শুধু হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন ১ লাখ ৮০ হাজারের বেশি মানুষ, যা আগের বছরের তুলনায় ২৩ শতাংশ বেশি।
ওই বছর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে মারা গেছে ৮৫ হাজারের বেশি মানুষ, যা আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে ৮৮ শতাংশ। আট রকমের ক্যান্সারে মারা গেছে ৮৩ হাজার (বৃদ্ধির হার ৩২ শতাংশ), শ্বাসতন্ত্রের রোগে মারা গেছে ৭৪ হাজার (বৃদ্ধির হার ৩৬ শতাংশ) আর কিডনি রোগে মারা গেছে ২৮ হাজারের বেশি মানুষ (বৃদ্ধির হার ১৬৪ শতাংশ)।
এদিকে, বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোল্লা ওবায়দুল্লাহ বাকী জানান, প্রতি বছর ৩ লাখ মানুষ নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। করোনার পর ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে এটি বলা যাবে না। তবে ক্যান্সার যাদের হয় তাদের করোনায় আক্রান্তের ঝুঁকি বেড়ে যায় ১১ শতাংশ।
উদ্বেগজনক এই পরিস্থিতির কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নানা সামাজিক অনিশ্চয়তা, মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা, করোনাকালীন জীবনযাত্রার ধরন পাল্টে যাওয়া, চর্বি জাতীয় খাদ্য বেশি খাওয়া, কায়িক শ্রম না করা, খাদ্যে ভেজাল ও কীটনাশকের ব্যাপক ব্যবহার, অস্বাস্থ্যকর খাবার বা জাংকফুড খাওয়া ও ধূমপান স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায়। তাছাড়া করোনা সংক্রমণের কারণে অনেকেই সময়মতো চিকিৎসা নিতে পারেননি, যা এ জাতীয় অসংক্রামক রোগ বেড়ে যাওয়ার কারণ বলে মনে করছেন তারা।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫৪৫
আপনার মতামত জানানঃ