যুক্তরাষ্ট্রে অস্ত্র বিক্রির সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়েছে। আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে খুনের সংখ্যাও বেড়েছে। প্রতিদিনই দেশটির কোনো না কোনো অঙ্গরাজ্যে বন্দুকের গুলিতে প্রাণ হারাচ্ছেন নিরীহ মানুষ।যুক্তরাষ্ট্রে গত দুই সপ্তাহে বন্দুক হামলায় ৩৭ জন নিহত হয়েছে।
দেশটিতে সাম্প্রতিক সময়ে বন্দুক হামলার সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। গতকাল দেশটির ওকলাহোমা অঙ্গরাজ্যের টিউলসা শহরের একটি হাসপাতালে বন্দুকধারীর হামলায় চারজন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। সন্দেহভাজন ওই হামলাকারীও নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ।
ঘটনার পর টুলসার উপপুলিশ প্রধান জনাথন ব্রুকস সেন্ট ফ্রান্সিস ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। তিনি বলেন, বন্দুকধারীর পরিচয় বের করার চেষ্টা করছে পুলিশ। তার বয়স ৩৫ থেকে ৪০ বছর বলে ধারণা করা হচ্ছে। বন্দুকধারীর হাতে রাইফেল ও পিস্তল ছিলো।
জনাথন ব্রুকস বলেন, গোলাগুলির খবর পাওয়ার তিন মিনিটের মধ্যেই পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। মিনিট পাঁচেক পরই হামলাকারীকে শনাক্ত করে তাঁরা।
হাসপাতালের নাতালি ভবনের তৃতীয় তলায় গোলাগুলি হয়। সেখানে চিকিৎসকদের অফিস ও অর্থোপেডিক সেন্টার ছিলো। টুসলার আরেক উপপুলিশ প্রধান এরিক দালগ্লেইস বলেন, নিহতদের মধ্যে রোগী ও হাসপাতালের কর্মচারী রয়েছেন বলে প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছেন তাঁরা।
এক বিবৃতিতে হোয়াইট হাউস জানিয়েছে হামলার খবর প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে জানানো হয়েছে। গোলাগুলির ঘটনায় বিদ্যমান পরিস্থিতিতে স্থানীয় কর্মকর্তাদের সহায়তার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, স্থানীয় সময় বুধবার (১ জুন) টিউলসার সেন্ট ফ্রান্সিস হাসপাতালে রাইফেল নিয়ে হামলা চালায় সন্দেহভাজন ওই ব্যক্তি। স্থানীয় সময় বিকাল ৪টা ৫২ মিনিটে পুলিশ ওই হামলার ঘটনার বিষয়টি জানতে পারে এবং তারা ৩ মিনিটের মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছায়।
পরবর্তীতে ওই ব্যক্তি নিজের গুলিতে আত্মহত্যা করেন বলে ধারণা করছে পুলিশ। তবে ওই হামলার কারণ সম্পর্কে এখনো স্পষ্ট হতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। টিউলসা পুলিশের ফেসবুক পেজে বলা হয়েছে, ঘটনাস্থলে পুলিশ এখনও তল্লাশি চালাচ্ছে।
এর আগে লুইজিয়ানা অঙ্গরাজ্যে গত মঙ্গলবার (৩১ মে) একটি হাইস্কুলের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে গুলিতে এক নারী নিহত এবং আরও দুজন গুরুতর আহত হন। নিউ অরলিন্সের জেভিয়ার ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে মরিস জেফ কমিউনিটি স্কুলের শিক্ষার্থীদের স্নাতক সমাবর্তন অনুষ্ঠানের আয়োজনে ওই হামলার ঘটনা ঘটে।
তার আগে দেশটির টেক্সাস অঙ্গরাজ্যে গত ২৪ মে একটি স্কুলে বন্দুকধারীর হামলায় ২১ জন নিহত হন। এদের মধ্যে ১৯ জনই শিশু। দেশটির মেক্সিকো সীমান্তবর্তী উভালদে এলাকার একটি এলিমেন্টারি স্কুলে এ ঘটনা ঘটে।
অপরদিকে গত ১৪ মে নিউইয়র্কে একটি মুদি দোকানে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে ১০ জনকে হত্যা করে ১৮ বছরের এক কিশোর। নিজেকে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী ঘোষণা দিয়ে আফ্রিকান-আমেরিকান অধ্যুষিত এলাকাটিতে হামলা চালায় সে। এর একদিন পরেই ক্যালিফোর্নিয়ায় একটি চার্চের দরজায় দাঁড়িয়ে নির্বিচারে গুলি চালায় এক বন্দুকধারী। এতে একজন নিহত ও পাঁচজন আহত হন।
যুক্তরাষ্ট্রে নিয়মিত বন্দুক হামলা ও তাতে প্রাণহানির ঘটনা ঘটলেও সেখানে বন্দুক নিয়ন্ত্রণ আইন এখনো কঠোর করা যায়নি।
যুক্তরাষ্ট্রে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে বন্দুক হামলা। প্রায়ই দেশটির কোনো না কোনো অঙ্গরাজ্যে নৃশংস বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটছে। যা থেকে রেহাই পাচ্ছে না শিশুরাও। ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ৬১টি বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটে। যা আগের বছর অর্থাৎ ২০২০ সালের তুলনায় ৫২ শতাংশ বেশি। এফবিআইয়ের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গেছে। ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) জানায়, গত বছর ৩০টি অঙ্গরাজ্যে হামলার ঘটনা ঘটে। এতে প্রাণ হারান ১০৩ জন ও আহত হন ১৪০ জন।
২০২০ সালে ১৯ অঙ্গরাজ্যে ৪০টি বন্দুক হামলা হয়। এতে নিহত হয় ৩৮ জন ও আহত হয় ১২৬ জন। যদিও এসময় করোনার মহামারির কারণে লকডাউনের মতো কঠোর করোনা বিধিনিষেধ জারি ছিল। ২০১৭ সালে এ ধরনের ৩১টি ঘটনা ঘটে। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে ৩০টি করে হামলা রেকর্ড করা হয়।
২০১৭ সালের ৩১টি ঘটনায় রেকর্ড ১৪৩ জন প্রাণ হারান ও আহত হয় ৫৯১ জন। সে সময় নেভেদার লাস ভেগাসে হামলায় বহু হতাহত হয়। হোটেল রুম থেকে একজন বন্দুকধারীর হামলায় ওই ঘটনায় মারা যান ৬০ জন ও আহত হন ৪১১ জন।
যুক্তরাষ্ট্রে নিয়মিত বন্দুক হামলা ও তাতে প্রাণহানির ঘটনা ঘটলেও সেখানে বন্দুক নিয়ন্ত্রণ আইন এখনো কঠোর করা যায়নি। মার্কিন কংগ্রেসে এ বিষয়ে কয়েকবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে সেগুলো।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় প্রতিটি পরিবারেই কারও না কারও কাছে ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য বন্দুক রয়েছে। ২০২০ সালে আমেরিকায় ৪৫ হাজারেরও বেশি মানুষ আগ্নেয়াস্ত্র সম্পর্কিত আঘাতের কারণে মারা গেছে। গাড়ির দুর্ঘটনায় যত তরুণ মারা যায় তার চেয়ে বেশি নিহত হচ্ছে বন্দুক হামলায়।
মানবাধিকার নিয়ে বুলি আওড়ানো যুক্তরাষ্ট্রেই দিন দিন ভয়াবহ হচ্ছে বন্দুক হামলা। করোনা মহামারিতে যুক্তরাষ্ট্রের স্কুলগুলোতে সুনামির মতো বেড়েছে বন্দুক হামলা। স্কুল-কলেজের পাশাপাশি শপিংমলগুলোতেও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে এ নির্মম ঘটনা। প্রতিনিয়তই অকালে প্রাণ হারাচ্ছেন মার্কিনিরা। দেশটিতে এটি স্বাভাবিক ঘটনা হলেও মহামারিতে অস্বাভাবিক আকার ধারণ করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে এই বন্দুক সহিংসতার ঘটনায় নিজ দেশের পাশাপাশি অন্যদেশের নাগরিকরাও প্রাণ হারাচ্ছেন। ২০২১ সালেই যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলায় বেশ কয়েকজন চীনা নাগরিক নিহত হয়েছেন। সরকার থেকে নানা পদক্ষেপ নেয়া হলেও দেশটিতে কমছে না এই বন্দুক হামলার ঘটনা।
যুক্তরাষ্ট্রের আইন ব্যবস্থাও হেইট ক্রাইমের পৃষ্ঠপোষকতা করে। আমেরিকার কালো মানুষদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১৩ শতাংশ, অথচ কারাগারে মোট বন্দির ৪০ শতাংশই হলো এ দেশের কালো মানুষ। নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ব্রেনন সেন্টার ফর জাস্টিস-এর এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০-৩৪ বছর বয়সী এমন প্রতি নয়জন আফ্রিকান-আমেরিকানের একজন এখন জেলে।
আরেকটি গবেষণা বলছে, প্রতি তিনজন আফ্রিকান-আমেরিকানের মধ্যে অন্তত একজনকে জীবনে একবার হলেও জেলে যেতে হয়। যে অপরাধে এরা জেলে, একই অপরাধে সাদা বা বাদামি রঙের মানুষেরা সহজেই ছাড়া পেয়ে যায়। আমেরিকায় কালোদের সামান্য অপরাধেই বড় সাজা পেতে দেখা যায়। সাদাদের ক্ষেত্রে বড় অপরাধেও তা হয় না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মানুষের শরীরের চামড়ার রঙের ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র-সমাজে যে বৈষম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যবস্থা সেটার সূত্রপাত ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক দখল ও আধিপত্যের মধ্য দিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদী এই দৃষ্টিভঙ্গি এতটাই গভীরে শিকড় গেড়েছে যে, এর বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াই সত্ত্বেও একবিংশ শতাব্দীতেও এর অবসান হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক শ্বেতকায়ই কালো মানুষদের তাদের পূর্ণ নাগরিক অধিকারের স্বীকৃতি দিতে এখনও প্রস্তুত নয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বন্দুক হামলার উদ্দেশ্য খুঁজে বের করা কঠিন এবং কঠোর নীতি প্রণয়ন করাও কঠিন। কিন্তু বন্দুক হামলার সুযোগ বন্ধ করা তেমন কঠিন নয়। শ্বেতাঙ্গদের শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার সারা দুনিয়াতেই আছে এবং আছে তাদের সহিংস ইচ্ছার বাহার। কিন্তু একজন সহিংস মানুষের হাতে রান্না করার ছুরি বা বেসবল খেলার ব্যাট হাতে যতটা না ভয়ংকর তারচেয়ে অনেক বেশি ভয়ংকর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে। কারণ চোখের পলকেই সে ১০০ রাউন্ড গুলি ছুঁড়তে সক্ষম। আর এ পদ্ধতিটি সন্দেহাতীতভাবে লোভনীয়।
তারা বলেন, কথা খুব স্পষ্ট যে, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের মালিকানা নিয়ে ক্রাইস্টচার্চ হামলার পর নিউজিল্যান্ড যে ধরণের নীতি গ্রহণ করেছে, একই রকম নীতি গ্রহণ করলে যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলার ঘটনা কমতে পারে। কিন্তু এভাবে সব বন্দুক হামলায় মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে না। যেমন সম্ভব হবে না সংবিধান সংশোধন করার মাধ্যমেও। যুক্তরাষ্ট্রের বন্দুক হামলার সমস্যা, ব্রাজিলের বন উজাড় হওয়া বা চীনের বায়ু দূষণের মতোই ভয়াবহ। মানবসৃষ্ট পরিবেশ বিপর্যয় বন্ধ করা কঠিন এবং রাতারাতি পরিবর্তন সম্ভবও নয়। তবে তাই বলে সাহসী মানুষের অভিযাত্রা থেমে থাকবে কেন?
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৫৪
আপনার মতামত জানানঃ