মালয়েশিয়ার একটি অভিবাসন বন্দিশিবিরে দাঙ্গা দেখা দেওয়ার পর সেখান থেকে পালিয়ে গেছেন প্রায় ৬০০ রোহিঙ্গা শরণার্থী। এছাড়া পালানোর সময় দেশটির একটি মহাসড়কে গাড়ির ধাক্কায় ৬ রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে দু’জন শিশু।
বুধবার (২০ এপ্রিল) ভোরে মালয়েশিয়ার একটি বন্দিশিবিরে দাঙ্গার এই ঘটনা ঘটে। অভিবাসন কর্তৃপক্ষের বন্দিশিবির থেকে পালিয়ে যাওয়া ও মহাসড়কে গাড়ির চাপায় নিহত এসব রোহিঙ্গা শরণার্থী মিয়ানমার থেকে মালয়েশিয়ায় গিয়েছিলেন।
মালয়েশিয়ার সংবাদমাধ্যম দ্যা সান ডেইলি অনলাইনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বুধবার (২০ এপ্রিল) ভোর সাড়ে চারটার দিকে দেশটির উত্তর-পশ্চিম উপকূলের রাজ্য পেনাংয়ের সুঙ্গাই বাকাপের অস্থায়ী ইমিগ্রেশন ডিটেনশন ডিপো থেকে ৫৮২ জন রোহিঙ্গা বন্দি পালিয়েছেন।
পেনাং পুলিশের প্রধান দাতুক মোহাম্মাদ সুহেলি মোহাম্মদ জেইন বলেছেন, বন্দিদের মধ্যে ছয়জন অবৈধ অভিবাসী উত্তর-দক্ষিণ হাইওয়ের ১৬৫ কিলোমিটার অতিক্রমের চেষ্টা করেছিলেন। পালানোর চেষ্টায় রাস্তা পারাপারের সময় সকাল ৬টা ৫০ মিনিটের দিকে একটি গাড়ির ধাক্কায় তারা প্রাণ হারান। নিহতদের মধ্যে দুজন পুরুষ, দুজন নারী এবং দুজন ছেলে-মেয়ে ছিল।
অভিবাসন মহাপরিচালক দাতুক সেরি খাইরুল জাইমি দাউদ এক বিবৃতিতে বলেছেন, পালানোর চেষ্টাকালে ৩৬২ জন বন্দিকে ফের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্য অবৈধ অভিবাসীদেরও খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। তারা সবাই ব্লকের দরজা ও ব্যারিয়ারের গ্রিল ভেঙে পালানোর চেষ্টা করেন।
পলাতকদের অবস্থান সম্পর্কে যে কোনো তথ্য অবিলম্বে ইমিগ্রেশন বিভাগ বা পুলিশকে জানাতে দেশটির নাগরিকদের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে।
বুধবার (২০ এপ্রিল) ভোরে মালয়েশিয়ার একটি বন্দিশিবিরে দাঙ্গার এই ঘটনা ঘটে। অভিবাসন কর্তৃপক্ষের বন্দিশিবির থেকে পালিয়ে যাওয়া ও মহাসড়কে গাড়ির চাপায় নিহত এসব রোহিঙ্গা শরণার্থী মিয়ানমার থেকে মালয়েশিয়ায় গিয়েছিলেন।
মিয়ানমারে নিপীড়নের শিকার হয়ে পালিয়ে আসা জাতিগত সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের কাছে বা বাংলাদেশে শরণার্থী শিবিরগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করা রোহিঙ্গাদের কাছে মালয়েশিয়া একটি পছন্দীয় গন্তব্য। তবে রোহিঙ্গাদের শরণার্থী মর্যাদাকে স্বীকৃতি দেয় না মালয়েশিয়া।
২০২০ সাল থেকে দেশটিতে যাওয়া হাজার হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে জনাকীর্ণ বন্দিশিবিরগুলোতে আটকে রাখছে মালয়েশীয় কর্তৃপক্ষ। যদিও দেশটির দাবি, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া রুখতেই রোহিঙ্গাদের বন্দিশিবিরগুলোতে আটকে রাখা হচ্ছে।
মালয়েশিয়ার পুলিশ বলছে, বুধবারের দাঙ্গার কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত চলছে। অন্যদিকে পালিয়ে যাওয়া বাকি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আটক করতে তল্লাশি অভিযান চলছে বলে জানিয়েছে অভিবাসন কর্তৃপক্ষ।
সংবাদমাধ্যম বলছে, দাঙ্গার আগে পেনাং প্রদেশের সুঙ্গাই বাকাপ অস্থায়ী অভিবাসন বন্দিশিবিরে ৬৬৪ জন রোহিঙ্গা শরণার্থী অবস্থান করছিলেন। বন্দিশিবিরে অবস্থানরত এসব রোহিঙ্গার মধ্যে ১৩৭ জন শিশু।
এক হিসাবে, বর্তমানে মালয়েশিয়াতে বৈধ এবং অবৈধভাবে দুই লাখের মত রোহিঙ্গা বসবাস করছেন, যাদের সিংহভাগই গেছেন সাগর-পথে মানব পাচার কারীদের হাতে।
তাদের মধ্যে লাখ দেড়েক জাতিসংঘের চেষ্টায় শরণার্থী হিসাবে রয়েছেন, বাকিরা অবৈধভাবে লুকিয়ে থাকেন।।
মালয়েশিয়া এখনও জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সনদে সই করেনি, ফলে শরণার্থীদের অনেক অধিকার সেখানে নেই। শরণার্থীর মর্যাদা দিলেও রোহিঙ্গাদের বাচ্চারা সরকারি স্কুলে যেতে পারেনা। জাতিসংঘ এবং অন্য কিছু এনজিও পরিচালিত কিছু স্কুলে তারা যায়।
বাংলাদেশের পর রোহিঙ্গাদের বড় একটি অংশ অবস্থান করছে মালয়েশিয়া। সেখানেই টার্গেট করে রোহিঙ্গাদের পাঠানোর চেষ্টা করে দালালরা। বিশেষ করে নারী ও শিশুদের। বিভিন্নসময় সাগরপথে পাড়ি দিতে গিয়ে উদ্ধার হওয়া বেশীরভাগ ব্যক্তিরাই বলছেন,তাদের অনেক স্বজন রয়েছে মালয়েশিয়াতে। আর এসব স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করেই তারা বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো থেকে বের হচ্ছিলেন। তাদের আশ্রয়দাতা বেশীরভাগই মালয়েশিয়ায় বসবাসরত রোহিঙ্গা স্বজনরা। তারা সেখানে আশ্রয়ের আশায় ও ভালো থাকার লোভে পাড়ি জমায়। কিন্তু এই চিত্র ভিন্ন সেখানে।
অভিযোগ রয়েছে, মালয়েশিয়াতে গিয়েও তারা নানান নির্যাতনের শিকার হন। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে,মেয়ের বিয়ে দিতে এবং বাংলাদেশের ক্যাম্পের চেয়ে আরও ভাল থাকার জন্য তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করেন তারা। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে মানব পাচারকারী চক্রগুলো রোহিঙ্গাদের টার্গেট করে। বিশেষ করে রোহিঙ্গা নারীদের। কারণ সে দেশে থাকা রোহিঙ্গা পুরুষদের সঙ্গে বিয়ে দেয়ার জন্য তাদের নিয়ে যায় মালয়েশিয়ায় থাকা স্বজনরা।
তবে উখিয়া রোহিঙ্গা একটি ক্যাম্পের প্রধানমাঝি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,রোহিঙ্গা নারীদের মালয়শিয়া বিয়ে হলেও,ওখানে যাওয়া বড় একটি অংশ অন্যান্য দেশে যেতে চায়। বিশেষ করে অস্ট্রিলিয়া,জার্মানসহ ইউরোপের দেশগুলোতে।
ওই মাঝি বলেন,কোথাও আমাদের কেউ নেই। কিন্তু আমাদের এখানে(ক্যাম্পে) কিছু দালাল আছে। যারা স্থানীয় দালালদের সঙ্গে মিশে রোহিঙ্গা নারীদের রাজি করানোর চেষ্টা করে। তাদেরকে নানান প্রলোভনও দেখানো হয়। যেহেতু আমরা এখানে খুব কষ্টে থাকি,সবাই চায় একটু ভালো জায়গা থাকতে। ফলে রোহিঙ্গারা সহজে রাজি হয়ে যায়।
জানা গেছে,পাচারকারীরাও অতি সহজে রোহিঙ্গাদের পাচারে রাজি করাতে পারে বলে তাদের সবচেয়ে নিরাপদ মনে করে। রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে টাকা নিতে পারলে ফেরত দেয়ার ঝুঁকিও থাকে না। পাচারকারীদের লাভও হয় অনেক বেশি। এদিকে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব রোহিঙ্গারা মালয়েশিয়া গেলেও কিছু ওখানে থেকে যায়। বাকিরা আবার অবৈধ পথে ইউরোপ যাওয়ার চেষ্টা করে। সেখানে তারা বাংলাদেশী বলে পরিচয় দেয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬২২
আপনার মতামত জানানঃ