হাওয়া বদলাচ্ছে রাশিয়ার। দেশটির রাজধানী মস্কোর একটি থিয়েটার ভবনে টাঙ্গানো হয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধে সমর্থনের ‘জেড’ প্রতীক। তবে ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখলের সময় রাশিয়ার সর্বস্তরের মানুষ যেভাবে সমর্থন দিয়েছিল, ইউক্রেন যুদ্ধে সে জোয়ার দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু, তবুও আপাতত জয় হচ্ছে পুতিনেরই।
রাশিয়া আর ইউক্রেন দুই দেশেই বসবাস- স্লাভ জাতির। সাংস্কৃতিক বন্ধনও ঐতিহাসিক। তবু তারা যুদ্ধে লিপ্ত। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যখন ইউক্রেনে আগ্রাসনের সিদ্ধান্ত নেন, তখন বিস্মিত হয়েছিলেন অসংখ্য রুশ নাগরিক। অনেকে বিশ্বাসের ভিত্তি নড়ে যায় এ ঘটনায়।
যুদ্ধবিরোধী প্রতিবাদ হয়েছে, সংঘাত বন্ধের আবেদন জানিয়ে আইনপ্রণেতাদের কাছে চিঠিও লেখা হয়েছে অজস্র। যারা প্রকাশ্য প্রতিবাদ করেছেন তাদের অবশ্য দেশদ্রোহী তকমাই দেয় ক্রেমলিন। কারো কারো বাড়ির দরজায় ‘বিশ্বাসঘাতক’ লেখা প্লেটও সেঁটে দেয় রাষ্ট্রের অনুগত শক্তিগুলো। তবে প্রাথমিক এই বিরোধ এখন অনেকটাই দূর হয়েছে।
ইউক্রেন যুদ্ধ যখন পঞ্চম সপ্তাহে, তখন রুশ নাগরিকরাও দেশটিতে যুদ্ধরত তাদের সেনাবাহিনীকে সমর্থন জানাতে এগিয়ে আসছে, নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করছে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে। কিছু ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে এমন লক্ষণের দেখা মিলছে বলে জানিয়েছে খোদ আমেরিকার (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) প্রভাবশালী গণমাধ্যম দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস।
তবে গণমাধ্যমটির দাবি, এর পেছনে কাজ করছে রাষ্ট্রীয় প্রচারণা। যেমন টেলিভিশনে বিনোদন অনুষ্ঠানের জায়গা দখল করেছে সুনিয়ন্ত্রিত প্রোপাগান্ডা। যেখানে বলা হচ্ছে, ইউক্রেন শাসন করছে নাৎসীরা বা আমেরিকান অর্থে সেখানে গড়ে উঠেছে জীবাণু অস্ত্রের গবেষণাগার।
জরিপ ও সাক্ষাৎকার নিয়ে টাইমস দেখেছে, এসবে অংশ নেওয়া বেশিরভাগ রুশ নাগরিক এখন পুতিনের যুক্তিকে সমর্থন করে। তারা মনে করছে, পশ্চিমারা চারদিক থেকে রাশিয়াকে অবরোধ করেছে। এ বাস্তবতায় আক্রমণ করা ছাড়া অন্য কোনো উপায়ই ছিল না মস্কোর। অন্যদিকে, যুদ্ধের ঘোর-বিরোধীরা এখন হয় দেশ ছাড়ছে নাহয় ভয়ে মুখে কুলুপ আঁটছে।
রাশিয়ার সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য স্বাধীন জরিপকারী সংস্থা- লেভাদার এক সমীক্ষায় পুতিনের গ্রহণযোগ্যতার প্রতি সমর্থন দিয়েছেন এতে অংশ নেওয়া ৮৩ শতাংশ নাগরিক। জানুয়ারিতে বা ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে এই সমর্থন ছিল ৬৯ শতাংশ।
অর্থাৎ, যুদ্ধ শুরুর পর পুতিন আরো জনপ্রিয় হচ্ছেন। তাছাড়া, অংশগ্রহণকারীদের ৮১ শতাংশই ইউক্রেন যুদ্ধের পক্ষে মত দিয়েছেন। ইউক্রেনে রুশভাষী জনতাকে রক্ষার গুরুত্বকেই তারা নিজস্ব মতের প্রধান যুক্তি হিসেবে তুলে ধরেন।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, আসন্ন মাসগুলোয় পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার কারণে রুশ জনতার অর্থনৈতিক দুর্গতি বাড়লে, জনমত আবার পাল্টে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাদের কেউ কেউ মনে করেন, যুদ্ধকালে এমন জরিপ ফলাফলের তাৎপর্য সামান্যই, কারণ অনেক রুশ নাগরিক দমনের ভয়ে মুখ খুলছেন না। অনেকে সভয়ে পক্ষে মত দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
তাছাড়া, যুদ্ধ নিয়ে ক্রেমলিনের বক্তব্যের সাথে বিরোধ পোষণের ব্যাপারে আরোপিত হয়েছে নতুন সেন্সরশিপ বিধিমালা। যা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যাওয়ার ভয়ে অনেককে সন্ত্রস্ত করে রেখেছে। এসব বিধিভঙ্গ করলে রয়েছে সর্বোচ্চ ১৫ বছরের কারাদণ্ড।
অবশ্য পর্যবেক্ষকদের এসব ধারণাকে বাড়তি গ্রহণযোগ্যতা দেওয়াও সঠিক মনে করেন না অনেকে। লেভাদার পরিচালক ডেনিস ভোলকভ জানান, তার সংস্থার পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, ‘অবরুদ্ধ রাশিয়ার জনতাকে তাদের নেতার পেছনে দাঁড়াতে হবে’- অনেক রুশ নাগরিক এ বিশ্বাসকেই গ্রহণ করেছেন।
পশ্চিমাদের আরোপিত নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক যুদ্ধেরই নামান্তর। তারা রুশ বিমানের জন্য নিষিদ্ধ করেছে নিজস্ব আকাশসীমাও। রুশ ভূখণ্ড ছাড়ছে ম্যাকডোনাল্ড ও আইকিয়া’র মতো জনপ্রিয় পশ্চিমা ব্র্যান্ডগুলো। রাশিয়াকে এভাবে বর্জনও অপমানের শামিল। এতে ক্ষুদ্ধ রাশিয়ার মানুষ পুতিনের পেছনে এসে জড়ো হচ্ছে বলে ব্যাখ্যা করেন ভোলকভ।
জনমত পুতিনের পক্ষে চলে যাওয়ায় যুদ্ধ-বিরোধীরা কোণঠাসা হয়ে আশ্রয় নিয়েছে ফেসবুক আর ইউটিউবের জগতে। সামাজিক মাধ্যমে তাদের করা পোস্টও কর্তৃপক্ষ সরিয়ে ফেলছে। বিশেষ সফটওয়্যার ছাড়া রাশিয়ায় ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম অ্যাক্সেসও করা যাচ্ছে না। দেশটির সবচেয়ে স্বাধীন সমস্ত গণমাধ্যমে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭১২
আপনার মতামত জানানঃ