একটি গবেষণায় অংশ নেওয়া শতকরা ৫২ জন মানুষ মনে করেন মেয়েদের গণমাধ্যম, চলচ্চিত্রে কাজ করা, পুরুষের সঙ্গে রাতের শিফটে কাজ করা বা পুরুষের সঙ্গে দূরে কোথাও ভ্রমণ বা কাজে যাওয়া ঠিক নয়। এমন ধারণা পোষণকারীদের শতকরা ২১ জন নারী ও ৩১ জন পুরুষ এবং উত্তরদাতাদের মধ্যে তরুণদের সংখ্যাই বেশি।
শতকরা ৮১ জন উত্তরদাতা মনে করেন, মেয়েরা খোলামেলা পোশাক পরলে, অশালীন আচরণ করলে, খারাপ ভাষা ব্যবহার করলে, স্বাধীনভাবে চলাফেরা ও মেলামেশা করলে, সেই মেয়েদের নানাভাবে হেয় ও তাদের প্রতি অপমানজনক আচরণ করা যায়। এর মধ্যে শতকরা ৩৯ জন নারী ও ৪২ জন পুরুষ।
‘বাংলাদেশে ইন্টারনেটে পর্নোগ্রাফির সহজ বিস্তার এবং নারীর প্রতি সহিংসতা’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের (এমজেএফ) নারীর প্রতি সহিংসতা কর্মসূচির আওতায় বেসরকারি সংস্থা ডি-নেট দেশব্যাপী এই গবেষণাটি পরিচালনা করেছে।
আজ বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন আয়োজিত অনুষ্ঠানে গবেষণার সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন ডি-নেটের ইনোভেশন অ্যাডভাইজার সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, দেশে ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়ার পাশাপাশি পর্নোগ্রাফি দেখার হারও বেড়েছে।
গত বছরের অক্টোবর মাস থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ৮টি বিভাগের ১৬টি জেলায় ৫১৮ জন ব্যক্তির (পুরুষ ৫৩ শতাংশ) কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে গবেষণাটি করা হয়েছে।
গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, শতকরা ৭৪ জন উত্তরদাতা মনে করেন, ‘মন্দ’ মেয়ে, ‘মন্দ’ ছেলের চেয়ে বেশি বিপজ্জনক। আর সমাজে ‘ভালো’ ও ‘মন্দ’ মেয়ে আছে এমনটা বিশ্বাস করেন শতকরা ৭৯ জন উত্তরদাতা।
শতকরা ৮১ জন উত্তরদাতা মনে করেন, মেয়েরা খোলামেলা পোশাক পরলে, অশালীন আচরণ করলে, খারাপ ভাষা ব্যবহার করলে, স্বাধীনভাবে চলাফেরা ও মেলামেশা করলে, সেই মেয়েদের নানাভাবে হেয় ও তাদের প্রতি অপমানজনক আচরণ করা যায়। এর মধ্যে শতকরা ৩৯ জন নারী ও ৪২ জন পুরুষ।
গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, মন্দ মেয়ের মতো আচরণ সমাজে অনাকাঙ্ক্ষিত, কারণ তা অন্য ছেলেমেয়েদের নষ্ট করে ফেলবে বলে মনে করেন শতকরা ৭৯ জন উত্তরদাতা। তাই অনলাইনে মন্দ মেয়ের মতো আচরণ যারা করে, তাদের সেটা থেকে বিরত রাখার জন্য হেয় করা, মন্দ বলা ও তাদের প্রতি অপমানজনক আচরণ করা সমাজের জন্য উপকারী বলে মনে করেন শতকরা ৪৪ জন উত্তরদাতা।
গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, মেয়েদের ভালো হতে উৎসাহী করা ও মন্দ বিষয়ে বাধা দেওয়া ও তাদের নিরাপদে রাখা পুরুষের দায়িত্ব এটা মনে করেন শতকরা ৮০ ভাগ উত্তরদাতা। এর মধ্যে নারী উত্তরদাতা ছিলেন ৩৫ শতাংশ।
ডি-নেটের ইনোভেশন অ্যাডভাইজার সিরাজুল ইসলাম বলেন, পর্নোগ্রাফি দেখার হার বাড়ার ফলে সমাজে মেয়েদের প্রতি সহিংসতাও বেড়েছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে উত্তরদাতাদের ৮২ ভাগ মানুষই বলেছেন, তারা মনে করেন সহিংসতা বেড়েছে। নারীর প্রতি অবমাননাকর আধেয় কিশোর, যুবক ও পুরুষ নিয়মিত দেখে বলে গবেষণায় অংশগ্রহণকারী ৮১ ভাগ উত্তরদাতা মনে করেন।
গবেষণা প্রতিবেদন এটাও বলছে যে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে কিছু মেয়ে বা নারী ছেলে বা পুরুষদের প্রলুব্ধ করছে। পশ্চিমা বিশ্বে মানুষ যৌন প্রয়োজনে পর্নোগ্রাফি দেখলেও বাংলাদেশে বেশির ভাগ মানুষ নারীকে অসম্মান, নিন্দা ও নির্যাতন করার জন্য পর্নোগ্রাফি দেখছে। অনলাইনে নারীর অবমাননাকর যে চিত্র দেখানো হয়, তা সমাজে প্রচলিত মন্দ মেয়ের ধারণাকে আরও শক্তিশালী করে। পর্নোগ্রাফি দেখার হার বাড়ায় মানুষের মধ্যে অনিরাপত্তাবোধ তৈরি হচ্ছে, ছেলেমেয়ে বিশেষ করে নিজের ছেলে এগুলো দেখে বিগড়ে যাবে কি না, এ চিন্তা মাথায় আসে বেশির ভাগ মানুষের।
পর্নোগ্রাফির গতিপ্রকৃতি ও গভীরতা বোঝা, মানুষ কেন নারী সম্পর্কে নেট দুনিয়াতে যেসব অবমাননাকর আধেয় প্রচারিত হচ্ছে তা কেন দেখছে বা গ্রহণ করছে, পর্নোগ্রাফি দেখার পর এবং নারীর সম্পর্কে অবমাননাকর আধেয় জানার পর মানুষ কীভাবে নারীর প্রতি আচরণ করে বা তাদের দৃষ্টিভঙ্গি কী হয়, ইন্টারনেট পর্নোগ্রাফির সহজ প্রবেশগম্যতা এবং নারীর প্রতি অবমাননাকর মন্তব্য বা আধেয়ের সঙ্গে মেয়ে ও নারীর প্রতি সহিংসতার কী সম্পর্ক, তা বিশ্লেষণ করার জন্য এই গবেষণাটি করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, পর্নোগ্রাফি দেখে মানুষ এমনকি শিশুরাও অন্যদের সঙ্গেও একই ধরনের আচরণ করতে চায়। মূল্যবোধের বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি মনস্তাত্ত্বিক শিক্ষা, নারী-পুরুষের সম্পর্ক, সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা ইত্যাদি বিষয়েও জীবনের প্রতিটি ধাপে গুরুত্ব দিতে হবে।
যারা নায়িকাদের মতো যৌন আবেদনময়ী আচরণ অথবা পশ্চিমা সংস্কৃতির পোশাক পরে ও আচরণ করে বা টিকটক, লাইকি ও ইনস্টাগ্রামের মাধ্যমে অনলাইনে ও সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করে, তারাই মন্দ মেয়ের তকমা পেয়েছে। অন্যদিকে যারা ধর্মীয় নিয়ম মানে, তারা ভালো মেয়ে, এটা মনে করেন শতকরা ৬৬ জন।
ধর্ষণের শিকার বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয় যে মেয়ে ও নারীরা, এতে তাদের নিজেদেরও দোষ আছে, এটা ভাবেন শতকরা ৫৩ শতাংশ উত্তরদাতা। শতকরা ৭৩ জন মনে করেন যে একটি মেয়ের জীবন তখনই সফল হয়, যখন একটি উপযুক্ত ছেলের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। শতকরা ৬৩ জন মনে করেন মেয়েদের বেশি স্বাধীনতা দিলে তারা পুরুষদের নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করে এবং শতকরা ৫৮ জন মনে করেন মেয়েরা প্রায়ই ছেলেদের নির্দোষ আচরণকেও নির্যাতন মনে করে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘আমাদের সমাজে নারীদের প্রাপ্য সম্মান দেওয়া হয় না। সেক্ষেত্রে পরিবার থেকে প্রতিটি প্রজন্ম শিখছে মেয়েরা মানুষ নয়, তারা শুধু ব্যবহারের জন্য। এভাবে পরিবার থেকেই মূলত নারীর প্রতি অসম্মানের শুরু। এতে বাড়ছে নারী ও শিশু নির্যাতনের হার। নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নের কথা বলছে রাষ্ট্র। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে আমরা নারীদের সম্মানের জায়গায় তুলে ধরতে পারছি না।’
তারা বলেন, ‘পরিবার থেকেই নারীদের সম্মান দেওয়ার শিক্ষাটা জরুরি। পাশাপাশি আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় যা রয়েছে তা একপ্রকার ইঁদুর দৌড়ের মতো। আমরা শুধু দৌড়াচ্ছি আর দৌড়াচ্ছি। মানবিক শিক্ষা না শিখে ডিগ্রির পেছনে দৌড়াচ্ছি। পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মানবিক শিক্ষা শুরু করা দরকার।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০০৪
আপনার মতামত জানানঃ