উদ্বেগ জাগিয়ে ক্রমশ আমেরিকায় কোভিড সংক্রমণে নতুন মাত্রা যোগ করেছে ওমিক্রনের বিএ.২ ভেরিয়েন্টটি। শুধু আমেরিকা নয়, একই চিত্র দেখা যাচ্ছে পশ্চিম ইউরোপের ক্ষেত্রেও, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের এমনটাই দাবি।
সান দিয়েগোর একটি জিনোমিক্স সংস্থার সূত্রে জানা গিয়েছে, আমেরিকায় বর্তমানে যত সংখ্যক কোভিডে আক্রান্ত রোগী রয়েছেন, তাদের মধ্যে ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ আক্রান্ত হয়েছেন বিএ.২ ভেরিয়েন্টে। গত দুই সপ্তাহের কোভিড পরীক্ষায় দেখা যাচ্ছে এই চিত্র।
নিউ ইয়র্কেই গত এক সপ্তাহে ফের বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। আমেরিকার সংবাদমাধ্যগুলিতে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে যখন আমেরিকায় প্রথম এই ভেরিয়েন্টে আক্রান্ত রোগীর খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল, তখন থেকেই বিষয়টি নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছে সংস্থাটি।
এ বিষয়ে হোয়াইট হাউসের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক অ্যান্টনি ফাউচি জানিয়েছেন, ওমিক্রনের থেকে অনেক বেশি সংক্রামক এই নতুন ভেরিয়েন্ট। তবে এখনও সেটি প্রাণঘাতী হয়ে ওঠেনি বলেই জানা গিয়েছে। আক্রান্তদের উপসর্গও খুব একটা ভয়াবহ নয় বলেই এখনও পর্যন্ত খবর।
ওমিক্রনের এই নতুন ভেরিয়েন্টের সংক্রমণে আশঙ্কার চিত্র দেখা যাচ্ছে ব্রিটেনেও। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, সে দেশে কোভিডে আক্রান্তদের মধ্যে ৫০ শতাংশের দেহেই রয়েছে নতুন ভেরিয়েন্টের উপস্থিতি। আর তার পরেই বাড়তে শুরু করেছে সংক্রমণ।
যদিও আক্রান্তের উপসর্গ খুব মারাত্মক নয়, কিন্তু এই স্ট্রেনটিতে সম্ভাবনা রয়েছে বার বার আক্রান্ত হওয়ার। ফলে, কোভিডে আক্রান্ত হওয়া ও সেরে ওঠার মাঝের সময়কালটি ক্রমশ বাড়ছে। যা নিয়ে স্বভাবতই চিন্তিত চিকিৎসকেরা।
ক্রমবর্ধমান আক্রান্তের সংখ্যা নিয়ে নাজেহাল চিনও। ‘জিরো কোভিড’ পলিসি নিয়ে চলা দেশটির একের পর এক শহরে লকডাউন ঘোষণা হচ্ছে। রাতারাতি ন’লক্ষ বাসিন্দা থাকেন এমন একটি শহরে লকডাউন ঘোষণা করেছে চিন।
মঙ্গলবার চার হাজারেরও বেশি কোভিড আক্রান্ত ধরা পড়েছে। আগেও শেনজেন নামে একটি শহর লকডাউন করেছে চিন। ওমিক্রনের ধাক্কায় বেসামাল চিনের বেশ কিছু এলাকা।
গত দু’বছরে চীনে করোনা পরিস্থিতির এমন অবনতি হয়নি কখনই। এই পরিস্থিতিতে উত্তর-পূর্ব চীনের জিনিন প্রদেশকে ও পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এর ফলে সেখানকার ২ কোটি ৪০ লক্ষ বাসিন্দাকে কার্যত গৃহবন্দি হয়ে দিন কাটাতে হবে।
জোর দেওয়া হয়েছে পরীক্ষা ও শহর অনুযায়ী লকডাউনে। তার মধ্যেও গত এক বছরে এই প্রথম দু’জনের মৃত্যুও হয়েছে।
কী ভাবে প্রতিরোধ সম্ভব?
ফাউচির দাবি প্রতিষেধক ও সঠিক সময়ে বুস্টার ডোজ এই সংক্রমণ প্রতিরোধে অনেকটাই সহায়তা করবে। তার সঙ্গে মেনে চলতে হবে কোভিড বিধিগুলিও।
বিশেষজ্ঞদের মধ্যে কেউ কেউ দাবি করেছেন, ওমিক্রনের প্রথম ভেরিয়েন্টের থেকে ‘মাত্র’ ৩০ শতাংশ বেশি সংক্রামক এই বিএ.২ ভেরিয়েন্টটি।
যদিও ফাউচি জানিয়েছেন, সংখ্যাটি আসলে ৬০। আর উদ্বেগ সেখানেই। গতানুগতিক কোভিড পরীক্ষায় অনেক সময়েই এই ভেরিয়েন্টটি ধরা পড়ে না বলে এটিকে ‘স্টেলদ ভেরিয়েন্ট’ বলেন কেউ কেউ।
আমেরিকার সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন জানিয়েছে, প্রতি সপ্তাহেই যেন লাফিয়ে বাড়ছে এই নতুন ভেরিয়েন্টে আক্রান্তের সংখ্যা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ওমিক্রনের প্রথম ভেরিয়েন্ট অর্থাৎ বিএ.১ ও এই নতুন বিএ.২ ভেরিয়েন্টের মধ্যে মূলত জিনগত সিকোয়েন্সে ফারাক রয়েছে। রয়েছে কিছু অ্যামিনো অ্যাসিড ও স্পাইক প্রোটিনের পার্থক্যও। যে ফারাকের কারণে এই ভেরিয়েন্টটি অতি সংক্রামক।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানাচ্ছে, এই উপপ্রজাতি সারা বিশ্বে ইতিমধ্যেই ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। তাই এই মুহূর্তে প্রত্যেকটি মানুষকে থাকতে হবে সতর্ক।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোভিড ১৯-এর টেকনিকাল লিড মারিয়া ভ্যান কেরখোবে জানান, ওমিক্রনের এই উপপ্রজাতি আসল ভ্যারিয়েন্টের থেকে অনেক বেশি সংক্রামক। আর এই উপপ্রজাতি এখন বেশি দেখা যাচ্ছে।
তিনি আরও জানান, হু এই উপপ্রজাতির প্রতি কড়া নজর রাখছে। আমরা দেখতে চাইছি, কিছু দেশে করোনা সংক্রমণ দ্রুত বৃদ্ধি এবং দ্রুত কমে যাওয়ার পিছনে এই সাবভ্যারিয়েন্টের হাত আছে নাকি!
এদিকে ওমিক্রনের ঢেউয়ের সময় খুব কম মানুষের শরীরে দেখা দিয়েছে সমস্যা। এক্ষেত্রে শরীরে এই ভাইরাস প্রবেশ করার পরও তেমন সমস্যা দেখা দেয়নি। মানুষ বাড়িতেই হয়েছেন সুস্থ। দেখা দিয়েছে মৃদু উপসর্গ। তাই চিন্তার কোনও কারণ ছিল না।
এক্ষেত্রে বিজ্ঞানীদের দাবি, ওমিক্রনের এই সাবভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রেও ঠিক এমনটাই ঘটবে। যদিও এক্ষেত্রে কয়েকটি অস্বাভাবিক লক্ষণও দেখা দিচ্ছে।
বিএ.২ ভ্যারিয়েন্টের অস্বাভাবিক লক্ষণ
এক্ষেত্রে অনেকের মধ্যে দেখা দিচ্ছে মাথাঘোরা, চোখে ঝাপসা দেখার সমস্যা। অন্তত এই বিএ.২ সাবভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত মানুষের মধ্যে কয়েকজন এই দাবিই করেছে।
তবে মাথাঘোরা বা চোখে ঝাপসা দেখার পিছনে থাকতে পারে অন্যান্য কারণও। তাই প্রতিটি মানুষকে থাকতে হবে সতর্ক। এমনটা হলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া বাঞ্ছনীয়।
এদিকে ওমিক্রনের এই সাবভ্যারিয়েন্ট নিয়ে চিন্তার কারণ রয়েছে অনেক। এক্ষেত্রে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের তুলনায় এই উপপ্রজাতি প্রায় ১.৫ গুণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। অবশ্য টিকা নেওয়া ব্যক্তিরা এই রোগ কম ছড়াচ্ছেন।
তবে টিকা না নিলে ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া এবং ভাইরাসকে অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার আশঙ্কা থাকে খুবই বেশি। তাই টিকা নিতে হবে। পাশাপাশি মেনে চলতে হবে অন্য করোনাবিধিও।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪৫৫
আপনার মতামত জানানঃ