অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মধ্যখানে অবস্থিত তাসমান সাগর। এই সাগরের বুক চিরে গেছে ছোট্ট একটি দ্বীপ, নাম তার তাসমানী। যেটি কিনা বর্তমান অস্ট্রেলিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গরাজ্য। তবে দ্বীপটির গুরুত্ব শুধু এ কারণে নয়, ঐতিহাসিকভাবে দ্বীপটি সাক্ষী হয়ে আছে এক করুণ বিষাদের সুরের সাথে।
কেননা এককালে এই দ্বীপেই বাস ছিল হাজার বছর পুরনো এক আদিম জনগোষ্ঠীর। শান্তশিষ্ট এ আদিম আদিবাসীদের বলা হত তাসমানিয়ান।
শ্বেতাঙ্গ উপনিবেশিকদের পাল্লায় পড়ে উনিশ শতকের শেষ নাগাদ অবলুপ্ত হয় বৈচিত্র্যময় এ আদিম আদিবাসীর। নিষ্ঠুর ব্রিটিশ উপনিবেশাদীরা নিরীহ তাসমানিয়ানদের উপর চাপিয়ে দেয় ব্ল্যাক ওয়ার নামের এক অসম যুদ্ধ।
আদতে যুদ্ধ বলা হলেও এটি মোটেও কোন যুদ্ধ ছিল না। স্রেফ গণহত্যা চালিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয় এ প্রাচীন গোষ্ঠীকে। ১৮৭৬ সালে যখন শেষ তাসমানিয়ান নারীর মৃত্যু হয় ঠিক তখন থেকে কার্যত সমাপ্তি ঘটে পৃথিবীর বুকে জেগে থাকা এক বিচিত্র জাতিসত্তার।
আজ থেকে প্রায় তিনশো বছর আগেও তাসমানিয়ানদের সংখ্যা ছিল প্রায় দুই হাজার। এরা ছিল নিগ্রো গোত্রের মহাসাগরীয় শাখার অন্তর্ভুক্ত। কোন ঐতিহাসিকদের মতে তাসমানিয়ানরাই অস্ট্রেলিয়ার আদিম গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। পুরুষ তাসমানিয়ানদের শারীরিক উচ্চতা ছিল প্রায় ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি এবং নারী তাসমানিয়ানদের উচ্চতা ছিল চার ফুট এগারো ইঞ্চির কাছাকাছি। এদের গায়ের রঙ ছিল কালো। দাঁত ছিল স্বাভাবিকের তুলনায় বড় বড়, লম্বা মাথা, দীর্ঘ চোয়াল ছিল তাদের শারীরিক গড়ন।
তাসমানিয়ান আদিবাসীরা নানান উপশাখায় বিভক্ত ছিল। গোত্রপ্রথা প্রচলিত ছিল। যার কারণে ভিন্ন ভিন্ন গোত্রের মধ্যে সর্বদাই ঝগড়া বিবাদ লেগে থাকত। তাদের নিজেদের মধ্যে কোন ব্যবসার প্রচলন ছিল না। প্রকৃত অর্থে তারা ব্যবসা কিভাবে করতে হয় তা জানত না।
গোত্রের বা উপজাতের নিজস্ব শিকারের ভূমির মালিক ছিল গোত্র। প্রত্যেকের ব্যক্তিগত সম্পদ বলতে ছিল অস্ত্রশস্ত্র, তাবিজ-কবজ ও আসবাবপত্র। তাসমানিয়ানরা লাঠি, বর্শা ও তীর ধনুকের ব্যবহার জানত। যুদ্ধের সময় বলশালী পুরুষকে দেয়া হত গোত্রের নেতার মর্যাদা। শান্তির সময় কোন নেতার প্রয়োজন পড়ত না। তাসমানিয়ান সমাজে বৃদ্ধদের ছিল একচ্ছত্র আধিপত্য। তারা ভাষার ব্যবহার জানত না তবে ইশারাভাষা ছিল যোগাযোগের শক্তিশালী মাধ্যম।
তাসমানিয়ানদের প্রতিটি গোত্র যখন কোন শত্রুর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হত তখন তারা নির্দিষ্ট কিছু কৌশলের আশ্রয় নিত। প্রতিটি দল ছোট ছোট শাখায় বিভক্ত হয়ে চারদিক থেকে শত্রুকে আক্রমণ করত। কোন কোন সময় শত্রুকে আক্রমণ করার জন্য তারা এক অভিনব পন্থা গ্রহণ করত।
প্রথমে ভাল মানুষের মত দুহাত উঁচুতে তুলে এমনভাবে শত্রুর পানে এগুতো যে মনে হত সে বুঝি আত্মসমর্পণের জন্য আগাচ্ছে। কাছে আসার সাথে সাথে পায়ে বাঁধা লুকোনো বর্শা দিয়ে আক্রমণ করে বসত। যুদ্ধে তাদের নিজেদের সঙ্গী নিহত হলে তাকে সংগে করে নিয়ে যেত। শত্রুপক্ষের নিহত ব্যক্তিকে ঘিরে নাচগান আনন্দ উৎসব করত। এছাড়া নিহত শত্রুর মাথা ভেঙে, নখ উপড়িয়ে তারা মজা পেত।
১৬৪২ সালে যখন ডাচ নাবিক Tasman এ দ্বীপটি আবিষ্কার করেন ঠিক তার ১৩০ বছর পর ১৭৭২ সালে সর্বপ্রথম ফরাসিরা উপনিবেশ কায়েম করতে আসে এখানে। ফরাসিদের অনাগ্রহের সুযোগে ১৮০৩ সালে তাসমানে ঘাটি গাড়ে ইংরেজরা।
এই ইংরেজরা আসার পর থেকেই মূলত তাসমানিয়ানদের ভাগ্যে শেষ পেরেক ঠুকে দেয়া হয়। নিরীহ নিরপরাধ তাসমানিয়ান জনগণের ওপর চেপে দেয়া হয় ব্রিটিশ নির্যাতনের বুলডোজার। তাদের জড়ানো হয় এক অসম যুদ্ধে। শ্বেতাঙ্গরা তার নাম দেয় ব্ল্যাক ওয়ার।
১৮০৩ ও ১৮০৮ সালের মধ্যবর্তী সময়ে ইংরেজদের সাথে প্রথম সংঘর্ষে জড়ায় তাসমানিয়ানরা। দ্বিতীয় সংঘর্ষটি হয় ১৮০৮ ও ১৮২৩ সালের মাঝামাঝি কোন এক সময়ে। তাসমানিয়ান নারীদের তারা যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করে। বনবাদাড়ে, যেখানে খুশি সেখানে অদ্ভুত সব ছুতো দেখিয়ে হত্যা করা হয় তাদের। সর্বশেষ ১৮৭৬ সালে শেষ তাসমানিয়ান নারীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পৃথিবী থেকে বিলীন হয়ে যায় চমকপ্রদ এক আদিম উপজাতির।
এসডব্লিউ/এসএস/২২০৫
আপনার মতামত জানানঃ