বাংলাদেশে গত কয়েক বছর ধরেই ই-কমার্স ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও, এই খাতটির ক্রমবর্ধবান গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষায় সরকারের ভূমিকা এখনও প্রশ্নবিদ্ধ। যার ফলে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ ওঠার পর গোটা খাতটি এখন ভুগছে আস্থার সংকটে। সম্প্রতি খুব অল্প সময়ে দ্রুত জনপ্রিয়তা পাওয়া কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শত শত কোটি টাকা আত্মসাতসহ গ্রাহক ও মার্চেন্টদের সাথে প্রতারণার অভিযোগ ওঠে।
শুরুতে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকদের আকর্ষণ করতে ‘অস্বাভাবিক’ সব অফার দেয়। পরে দেখা যায় যে অগ্রিম অর্থ নিলেও প্রতিশ্রুতি মোতাবেক তারা সময়মত পণ্য সরবরাহ করছে না। ভোক্তাদের অভিযোগ, পণ্যের টাকা পরিশোধ করা সত্ত্বেও নির্ধারিত সময়ে তারা পণ্য পাচ্ছেন না। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানটির পণ্য সরবরাহকারী বা মার্চেন্টরা বলছেন, দিনের পর দিন তাদের বকেয়া পাওনা পরিশোধ করা হচ্ছে না। এই নিয়ে সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় শীতঘুমে কাটিয়েছে গোটা সময়টাই। আলোচনা আর আশ্বাসের বাইরে সমস্যা নিরসনে তেমন কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি।
এদিকে লোভনীয় অফার দিয়ে গ্রাহকদের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে লাপাত্তা হওয়া ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ‘আকাশ নীল’ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মশিউর রহমান ও প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান রনিকে ফরিদপুর ও রাজধানী থেকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
ইচ্ছে ছিল অ্যামাজন বা আলি বাবার মতো ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম তৈরি করার। পরে ইভ্যালির ব্যবসায়িক ধরণ দেখে তাতে অনুপ্রাণিত হয়ে পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আকাশ নীল গঠন করেন মশিউর রহমান। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হন নিজেই। যাত্রা শুরুর পর টাকা নিয়ে পণ্য না দেয়া ও হুমকির অভিযোগে তার প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেন এক ভুক্তভোগী। এর পরিপ্রেক্ষিতে তিনিসহ গ্রেপ্তার হন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান রনি।
রাজধানী ঢাকা ও ফরিদপুর থেকে এ দুই আসামিকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। গত ১৮ মার্চ আকাশ নীলের এমডি-ডিরেক্টরসহ মোট ৯ জনের বিরুদ্ধে শেরে বাংলা নগর থানায় মামলাটি দায়ের হয়। এ ছাড়া প্রচুর ভুক্তভোগীর অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে।
আজ সোমবার(২১ মার্চ) দুপুরে কারওয়ানবাজারে মিডিয়া সেন্টারে এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তারিত জানায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাটি। সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন বাহিনীর আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গত ১৮ মার্চ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে এক ভুক্তভোগী ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আকাশ নীলের এমডি এবং পরিচালকসহ মোট ৯ জনের বিরুদ্ধে শেরে বাংলা নগর থানায় একটি মামলা করেন। সেই মামলার ছায়া তদন্তে নেমে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ সময় তাদের হেফাজত থেকে দুটি মোবাইল ফোন, দুটি ল্যাপটপ এবং একটি প্রাইভেটকার উদ্ধার করা হয়। মেলে ২২ মার্চ তারিখে দুবাইয়ে যাওয়ার টিকিটও।
ইচ্ছে ছিল অ্যামাজন বা আলি বাবার মতো ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম তৈরি করার। পরে ইভ্যালির ব্যবসায়িক ধরণ দেখে তাতে অনুপ্রাণিত হয়ে পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আকাশ নীল গঠন করেন মশিউর রহমান।
তিনি বলেন, আকাশ নীলের কারসাজির মূলহোতা গ্রেপ্তারকৃত মো. মশিউর। তার মাথায় ই-কমার্স ব্যবসার আইডিয়া আসলে অ্যামাজন, আলি বাবার মতো অনলাইনে ব্যবসার করার ইচ্ছা হয়। ২০১৯ সালে তিনি আকাশ নীল কোম্পানি গঠন করেন। এরপর প্রতিষ্ঠানের নামে ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজ তৈরি করে ট্রেড লাইসেন্স নেন।
প্রথমে তারা রাজধানীর কাঁঠালবাগান এলাকায় একটি অফিস চালু করে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এবং কৃষকদের কাছ থেকে শাকসবজি কিনে অনলাইনে হোম ডেলিভারি দেওয়ার ব্যবসা শুরু করে। পরবর্তীতে ইভ্যালিসহ অন্যান্য ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন মোটরসাইকেলের অফার দিয়ে যখন রমরমা ব্যবসা শুরু করে তখন তিনি এই ধরনের ব্যবসা দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে ২০২১ সালের জুন মাসে মোটরসাইকেলে বিভিন্ন অফার দিয়ে ফের ব্যবসা শুরু করেন।
আসামিদের বরাত দিয়ে র্যাব জানায়, তারা প্রথম ক্যাম্পেইন করেছিল গত বছরে মে মাসে। যেখানে ৩০ শতাংশ ছাড়ে ২ মাসের মধ্যে ২ শতাধিক মোটরসাইকেলের অর্ডার পান। মোটরসাইকেলের পাশাপাশি সেই লোভনীয় ছাড়ে মোবাইল, ইলেকট্রনিকস পণ্য, গৃহস্থালির অন্যান্য পণ্যের অফার দেওয়া শুরু করে। গত সেপ্টেম্বর ইভ্যালিসহ অন্যান্য ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযানের ফলে গ্রাহকেরা তাঁদের প্রদানকৃত অর্থ ফেরত চাইতে থাকে। তখন গ্রাহকদের চাপে গত নভেম্বরে অফিস বন্ধ করে দিয়ে লাপাত্তা হয় তারা।
যেভাবে প্রতারণা হতো
র্যাব জানিয়েছে, আকাশ নীল কোম্পানিতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার গ্রাহক ছিল। প্রতিষ্ঠানটি সর্বশেষ যে অফার দেয়, ছাত্র বা যুব সমাজ সাদরে সেটি গ্রহণ করে। মোটর সাইকেল ছাড়াও নিত্য প্রয়োজনীয় ইলেক্ট্রনিক পণ্য, মোবাইল অ্যাক্সেসরিজ ছিল। ব্যাংকের মাধ্যমে গ্রাহকরা অর্থ পরিশোধ করলে আকাশ নীলের সদস্যরা ডিলার থেকে নগদ টাকায় মালামাল ক্রয় করে সরাসরি মূল কার্যালয়ে নিয়ে আসতো। কেননা তাদের নিজস্ব কোনো ওয়্যার হাউজ বা গোডাউন ছিল না। কুরিয়ার সাভির্সের মাধ্যমে আকাশ নীলের কার্যালয় থেকেই পণ্য পৌঁছে দেয়া হতো গ্রাহকদের কাছে। পণ্য হস্তান্তরের আগে ব্যাংক থেকে গ্রাহকের টাকা তুলে নিতো আকাশ নীল। অন্যান্য ই-কমার্স ব্যবসায় গেটওয়ে সিস্টেম থাকলেও আকাশ নীল সরাসরি গ্রাহকের কাছ থেকে অর্থ আদায় করতো।
ই-কমার্স নীতিমালায় পণ্য ডেলিভারি না হলে টাকা গেটওয়েতে আটকে থাকে। ফলে পণ্য ডেলিভারি না হলে গ্রাহককে গেটওয়ে থেকেই অর্থ রিফান্ড করা যায়। কিন্তু আকাশ নীলের এ সিস্টেম ছিল না। ফলে ব্যাংকের মাধ্যমে গ্রাহকের টাকা সরাসরি আদায় করতো প্রতিষ্ঠানটি। এভাবেই মূলত প্রতারণা চালিয়ে আসছিলেন মশিউর ও তার বন্ধু রনি।
গ্রেপ্তারের পর মশিউর ও রনিকে করা জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে র্যাব জানায়, প্রতিষ্ঠানটিতে প্রায় ৪০ জন অস্থায়ী কর্মচারী নিয়োগ করা হয়েছিল, যাদের মাসিক বেতন ছিল চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা। তিন কোটি টাকা খরচায় রাজধানীর ধানমন্ডিতে একটি ফ্ল্যাট কেনে প্রতারক দল, এ ছাড়া প্রিয়াশ ও সিএইচআর নামে দুটি দামি গাড়ি ব্যবহার করতেন তারা। কোম্পানির নামে তারা টাটা কোম্পানির চারটি পিকআপ কিনেছিলেন। বর্তমানে গ্রাহকদের কাছে কোম্পানিটির দেনা প্রায় ৩০ কোটি টাকা। বিভিন্ন ব্যাংকে তাদের চারটি অ্যাকাউন্টের তথ্য পাওয়া গেছে।
র্যাব আরো জানায়, বিভিন্ন সংস্থার সূত্রে প্রকাশিত বিপুল পরিমাণ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে জিজ্ঞাসাবাদে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি গ্রেপ্তারকৃতরা। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই আকাশ নীল একটি লোকসানি কোম্পানি। প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গ্রাহকের অর্থ দিয়েই যাবতীয় ব্যয় ও খরচ চালাতেন। যে কারণে তাদের দেনা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাস্তবায়নহীন নীতিমালা ও শাস্তির অপ্রতুলতা
বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতে আস্থার জায়গা ধরে রাখতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ডিজিটাল কমার্স পরিচালনায় নীতিমালা ও নির্দেশিকা জারি করলেও, তা আছে মাত্র কাগজে কলমে। বাস্তবে এর কতোটা প্রয়োগ হচ্ছে তা নিয়ে নজরদারির যথেষ্ট অভাব রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা।
নতুন এই নির্দেশিকায় প্রধানত পণ্য সরবরাহ ও রিফান্ড দেওয়ার সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ও ক্রেতা একই শহরে অবস্থান করলে পাঁচ দিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহ করতে হবে। ভিন্ন শহরে অবস্থান করলে ১০ দিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
পাশাপাশি পণ্য স্টকে না থাকলে সেটার কোন পেমেন্ট গ্রহণ করা যাবে না। আগাম পরিশোধ করা টাকা পণ্য সরবরাহের পরই বিক্রেতার অ্যাকাউন্টে জমা হবে। ক্রেতার অগ্রিম মূল্য পরিশোধের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পণ্যটি ডেলিভারি-ম্যান বা ডেলিভারি সংস্থার কাছে হস্তান্তর করে তা টেলিফোন, ই-মেইল বা এসএমএসের মাধ্যমে জানাবে ই-কমার্স কোম্পানিগুলো। পরবর্তী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ডেলিভারি-ম্যান পণ্যটি ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেবে।
এতে বলা হয়েছে, সর্বোচ্চ ৭২ ঘণ্টার মধ্যে পণ্য বা সেবা ডেলিভারি-ম্যানের কাছে হস্তান্তর করার মতো অবস্থায় না থাকলে ই-কমার্স কোম্পানি পণ্য মূল্যের ১০ শতাংশের বেশি অর্থ অগ্রিম নিতে পারবে না।
তবে নীতিমালা ভঙ্গ করলেও শাস্তিটা এক্ষেত্রে শুধু প্রশাসনিক; যেমন কোম্পানির নিবন্ধন বাতিল করা। কিন্তু দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোন ব্যবস্থা নেওয়ার কোন সুযোগ নেই। এমন অবস্থায় ই-কমার্সে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে এসব নীতিমালার আলোকে শিগগিরই আইন প্রণয়ন করার কথা জানান বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা-ডব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক এবং ও কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেলের প্রধান হাফিজুর রহমান। তবে কথা অব্দিই। আলোর মুখ দেখেনি কোন আশ্বাসই। কেবল নীতিমালা প্রণয়ন করেই দায়িত্ব কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলেছেন মন্ত্রণালয়। মনিটরিংয়ের কোনো ব্যবস্থাই রাখা হয়নি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ই-কমার্সে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো গ্রাহকের আস্থা। তা রক্ষা করা না গেলে তাতে দু-একটি প্রতিষ্ঠান নয়, গোটা শিল্পের ওপরই মানুষ আস্থা হারাবে। সে জন্য যেসব অভিযোগ আসছে, প্রশাসনিকভাবেই সেগুলো দ্রুত খতিয়ে দেখা দরকার। কেবল ভোক্তার স্বার্থেই নয়, বরং ই-কমার্স খাতের শৃঙ্খলা আনয়নে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। দু-একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য ই-কমার্স খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তা কারও কাম্য নয়। ভোক্তা যাতে প্রতারিত না হন, বাজারে যাতে প্রতিযোগিতা থাকে বা সব প্রতিষ্ঠানের জন্য সমান সুযোগ থাকে, সে জন্য এ খাতে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর বা যথাযথ পরিচালন নীতিমালার দ্রুত বাস্তবায়ন প্রয়োজন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৪৮
আপনার মতামত জানানঃ