একজন সাংবাদিককে হয়রানিমূলকভাবে মধ্যরাতে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে কারাদণ্ড দেওয়ার ঘটনায় লঘুদণ্ড পেয়েছিলেন কুড়িগ্রামের ওই সময়কার জেলা প্রশাসক (ডিসি) সুলতানা পারভীন। রাষ্ট্রপতির কাছে আপিল করার পর রাষ্ট্রপতি সদয় হয়ে তার দুই বছরের জন্য বেতন বৃদ্ধি স্থগিতের দণ্ড বাতিল করে তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন।
ডিসির পর এবার দন্ড মওকুফ হলো সেই আরডিসির। কুড়িগ্রামে সাংবাদিক আরিফুল ইসলামকে হয়রানিমূলকভাবে মধ্যরাতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে কারাদণ্ড দেওয়ার ঘটনায় তৎকালীন রেভিনিউ ডেপুটি কালেকটর (আরডিসি) নাজিম উদ্দিনের শাস্তিও মাফ করা হয়েছে।
নাজিম উদ্দিনকে এক ধাপ পদাবনতির শাস্তি থেকে অব্যাহতি গত ৭ মার্চ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।
অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ‘গুরুদণ্ড’ হিসেবে নাজিম উদ্দিনকে এক ধাপ পদাবনতি করেছিলো সরকার। পরে রাষ্ট্রপতির কাছে দণ্ড মওকুফের আবেদন করলে, তা মঞ্জুর করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে নাজিম উদ্দিনের দণ্ড বাতিল করে তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলো।
একই ঘটনায় কুড়িগ্রামের সাবেক ডিসি সুলতানা পারভীনকে দুই বছরের জন্য বেতন বৃদ্ধি স্থগিত করা হয়েছিল। পরে তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শাস্তি মওকুফ করা হয়।
গত ২০২০ সালের ১৫ মার্চ অনলাইন নিউজপোর্টাল এর কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আরিফুল ইসলামের বাড়িতে ঢুকে তাকে ধরে নিয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। পরে জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত তাকে এক বছরের কারাদন্ড দেয়। তার বাড়িতে আধা বোতল মদ এবং গাঁজা পাওয়ার অভিযোগ আনা হয়। এভাবে মধ্যরাতে বাড়ি থেকে একজন সাংবাদিককে ধরে এনে সাজা দেওয়ার ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।
এ ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন সাবেক জেলা প্রশাসক (ডিসি) সুলতানা পারভীন, আরডিসি বা রেভিনিউ ডেপুটি কালেকটর নাজিম উদ্দিন, সহকারী কমিশনার রিন্টু বিকাশ চাকমা এবং এনডিসি বা নেজারত ডেপুটি কালেকটর এস এম রাহাতুল ইসলাম। ঘটনার তদন্তে অভিযোগের প্রমাণ পায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। অসাদাচরণের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সুলতানা পারভীনের দুই বছরের বেতন স্থগিত করা হয়। আরডিসি নাজিমকে এক ধাপ পদাবনতি দেয়া হয়। এনডিসি রাহাতুলের তিন বছর বেতন বৃদ্ধি স্থগিত রাখা হয় এবং রিন্টু বিকাশ চাকমাকে চাকরি থেকে স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হলেও তিনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট অনুযায়ী ওএসডি অবস্থায় রয়েছে।
পরবর্তীতে প্রেসিডেন্টের কাছে শাস্তি মওকুফের আবেদন করেন সুলতানা পারভীন। প্রেসিডেন্টের সুপারিশক্রমে সুলতানা পারভীনের দন্ড মওকুফ করে তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। সুলতানা পারভীন বর্তমানে ওএসডি অবস্থায় আছেন।
অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ‘গুরুদণ্ড’ হিসেবে নাজিম উদ্দিনকে এক ধাপ পদাবনতি করেছিলো সরকার। পরে রাষ্ট্রপতির কাছে দণ্ড মওকুফের আবেদন করলে, তা মঞ্জুর করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে নাজিম উদ্দিনের দণ্ড বাতিল করে তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলো।
নাজিম উদ্দিন বর্তমানে সাতক্ষীরা পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছেন। তবে সাংবাদিক পেটানোর ঘটনায় প্রকৃত গুরুদণ্ড পেয়েছেন অপেক্ষাকৃত জুনিয়র কর্মকর্তা রিন্টু বিকাশ চাকমা। তাকে চাকরি থেকে স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করা হচ্ছে। গত ২ মে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় রিন্টু বিকাশের বরখাস্তের সিদ্ধান্তে মতামতের জন্য পাবলিক সার্ভিস কমিশনে (পিএসসি) পাঠায়। ২০ জুন রিন্টু বিকাশকে বরখাস্তের সিদ্ধান্তে সম্মতি জানিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে অবহিত করে পিএসসি। তার বরখাস্তের ফাইল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। বর্তমানে রিন্টু বিকাশ চাকমাও ওএসডি অবস্থায় রয়েছেন।
সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম বলেন, ওই সময় সরকারের ঊচ্চ পর্যায় থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল যে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা হবে এবং ন্যায় বিচার পাব। কিন্তু এটাই যদি ‘ন্যায়বিচার’ হয় তবে সাধারণ জনগণের কাছে এ শব্দটি কল্পনাপ্রসূত শব্দ বলে মনে হবে। একটা প্রমাণিত অপরাধ প্রমাণিত হলো, বিভাগীয় তদন্তে সত্যতা পাওয়া গেল। কিন্তু অপরাধীরা ক্ষমা পেয়ে গেল। এই ঘটনা সরকারি কর্মকর্তাদের অপরাধ প্রবণতা বাড়িয়ে দেবে। এধরণের কর্মকর্তার কাছে রাষ্ট্র জিম্মি হয়ে আছে- এমন বার্তা পাবে জনগণ।
আরিফুল বলেন, ঘরের দরজা ভেঙ্গে পরিবারের সদস্যদের গালিগালাজ করে সেই রাতে আমাকে তুলে নিয়ে যান আরডিসি নাজিম। ডিসি অফিসে মোবাইল কোর্ট বসানো, মারধর করা, ক্রসফায়ারের ভয় দেখানো এবং সবশেষে আমাকে কারাগারে নিয়ে যান তিনি। এই ঘটনার নির্দেশদাতা ছিলেন ডিসি সুলতানা পারভীন। অর্থাৎ মূল হোতা হলেন দুইজন। আমি পরবর্তীতে রিন্টু বিকাশ চাকমা ও রাহাতুলের নাম জানতে পারি।
উল্লেখ্য, বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি আরিফুল ইসলাম রিগানকে গত বছর ১৩ই মার্চ গভীর রাতে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে মাদক রাখার অভিযোগে এক বছরের কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত।
কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমা ওই অভিযান পরিচালনা করেন। কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সিনিয়র সহকারী কমিশনার নাজিম উদ্দিন এবং সহকারী কমিশনার এস এম রাহাতুল ইসলামও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
কুড়িগ্রামের ওই সময়কার ডিসি সুলতানা পারভীনের নির্দেশেই আরিফুল ইসলামকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাজা দেওয়া হয় বলে আরিফুলের পরিবারের অভিযোগ করেন।
বিসিএস ২০তম ব্যাচের কর্মকর্তা সুলতানা কুড়িগ্রাম শহরের একটি সরকারি পুকুর সংস্কারের পর নিজের নামানুসারে ওই পুকুরের নাম ‘সুলতানা সরোবর’ রাখতে চেয়েছিলেন জানিয়ে বাংলা ট্রিবিউনে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলেন রিগান।
ওই প্রতিবেদন প্রকাশের ১০ মাস পর জেলা প্রশাসন আরিফুলের বাড়িতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে তাকে সাজা দেয়।
ওই ঘটনা তুমুল সমালোচনার জন্ম দেয়, বিষয়টি হাইকোর্টেও গড়ায়। পরে রিগানকে জামিন দেয় কুড়িগ্রামের আদালত। মুক্তি পেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন রিগান। সেখানে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘হাত ও চোখ বাঁধা’ অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার পর তাকে ‘বিবস্ত্র করে অমানুষিক নির্যাতন’ করা হয়। চোখ বেঁধে তার কাছ থেকে স্বাক্ষরও নেওয়া হয়।
তদন্ত প্রতিবেদনে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার পর ডিসি সুলতানা পারভীন, আরডিসি নাজিম উদ্দিন, সহকারী কমিশনার রিন্টু বিকাশ চাকমা ও এস এম রাহাতুল ইসলামকে কুড়িগ্রাম থেকে সরিয়ে দেয় সরকার।
পরে, ২০২০ সালের ১৯ মার্চ ডিসি সুলতানা পারভীন, সাবেক তিনজন সহকারী কমিশনারসহ ৩৫-৪০ জনের বিরুদ্ধে কুড়িগ্রাম সদর থানায় অভিযোগ দায়ের করেন সাংবাদিক আরিফুল।
হাইকোর্ট ওই অভিযোগ মামলা হিসেবে রেকর্ডের নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ আদালতে তাকে দেওয়া সাজা স্থগিত করে।
এর পর ২৬ মার্চ সুলতানা পারভীনসহ তার কার্যালয়ের সাবেক তিনজন সহকারী কমিশনারের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দায়মুক্তির এই সংস্কৃতি এবং ন্যায়বিচারের প্রতি এমন উদাসীনতা নির্ভয়ে দায়িত্ব পালনে সাংবাদিকদের জন্য একটি গুরুতর হুমকি।
তারা বলেন, বাংলাদেশের সাংবাদিকরা ইতোমধ্যেই ক্রমবর্ধমান পুলিশিংয়ের মধ্যে কাজ করছে। তাদের মাথার ওপর ভয়ংকর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ঝুলছে। বর্তমানে যে ভয়ের পরিবেশে সাংবাদিকরা কাজ করছে এই ধরনের পরিস্থিতি সেই ভয় আরও বাড়িয়েছে।
আরও বলেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপরাধের ক্ষেত্রে দায়মুক্তির সংস্কৃতি অব্যাহত থাকলে এই ধরনের হামলার ঘটনা বাড়বে এবং স্বাধীন ও সমালোচনামূলক সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শেষ পর্যন্ত এটা শুধু সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপরই নয়, গণতন্ত্রের ওপরও আক্রমণ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪০১
আপনার মতামত জানানঃ