সিরিয়া, প্যালেস্তাইন, আফগানিস্তান, ইউক্রেন; যুদ্ধে দিশেহারা পৃথিবী। আগুনের মতো যেন দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে যুদ্ধের ভয়াবহতা। আর গোটা বিশ্বজুড়েই এই হিংসার শিকার হচ্ছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। ক্রমশ বেড়ে চলেছে উদ্বাস্তুর সংখ্যা। পরিত্রাণ পাচ্ছে না শিশুরাও। এমনকি জন্ম লগ্ন থেকেই ‘উদ্বাস্তু’-র তকমা বসে যাচ্ছে অজস্র শিশুদের নামের পাশে। সম্প্রতি এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এল জাতিসংঘের রিপোর্টে।
জাতিসংঘের শরণার্থী হাইকমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী, সাম্প্রতিক প্রায় ১০ লক্ষাধিক শিশু উদ্বাস্তু জন্মলগ্ন থেকেই। তাছাড়াও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে বিতাড়িত হওয়ার কারণে বিপর্যস্ত আরও কয়েক লক্ষ শিশুর ভবিষ্যৎ। যা কেবলমাত্র তাদের শৈশবেই প্রভাব বিস্তার করছে না, বরং আজীবন এই অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হয়ে যেতে হবে তাদের।
সংশ্লিষ্ট রিপোর্টে সবচেয়ে বেশি করে উঠে এসেছে ইউক্রেন এবং সিরিয়ার নাম। রিপোর্ট বলছে, শুধুমাত্র ইউক্রেন থেকেই বাস্তুচ্যুত হয়েছে ১০ লক্ষাধিক মানুষ। পোল্যান্ড, রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি এবং মালদোভার মতো পশ্চিমি দেশগুলিতে যেমন আশ্রয় নিচ্ছেন ইউক্রেনিয়ান শরণার্থীরা; তেমনই রাশিয়া এবং বেলারুশেও সীমান্ত পেরিয়ে প্রবেশ করেছেন বহু ইউক্রেনিয়ান নাগরিক। পশ্চিমি দেশগুলি তাদের মুক্ত হস্তে আশ্রয় দিলেও ভয়াবহ ট্রমা, প্যারানোইয়ায় আক্রয়ান্ত ইউক্রেনের শরণার্থীরা।
অন্যদিকে আফগানিস্তান, লিবিয়া, সোমালিয়া, ফিলিপাইন, ইয়েমেন এবং সিরিয়ায় মিলিয়ে বাস্তুচ্যুত প্রায় ৩ কোটি ৮০ লক্ষ মানুষ। যা বিশ্বের মোট শরণার্থীর প্রায় ৩৫ শতাংশ। এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলির পাশাপাশি ল্যাটিন আমেরিকার রাষ্ট্রগুলিতে শরণার্থীর সংখ্যা ক্রমশ বেড়ে চলেছে বলেই অভিমত জাতিসংঘের। আশঙ্কার বিষয়, শরণার্থীদের অধিকাংশই শিশু।
তবে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী শরণার্থী শিশুদের জন্য সেইভাবে বন্দোবস্ত নেওয়া হচ্ছে না বলেই জানাচ্ছে জাতিসংঘের সাম্প্রতিক রিপোর্ট। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুনর্বাসনের প্রকল্প থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শরণার্থীরা। যারা উন্নত দেশগুলিতে পুনর্বাসিত হচ্ছেন, সেখানে সেইভাবে শরণার্থী শিশুদের মানসিক বিকাশের জন্য কোনো বিশেষ পদক্ষেপও নেওয়া হচ্ছে না অধিকাংশ ক্ষেত্রে। যা ক্রমশ চিন্তা বাড়াচ্ছে জাতিসংঘের। তার ওপর মহামারীর প্রকোপ আরও ভয়াবহ করে তুলেছে শিশুদের অনিশ্চয়তাকে। এই সমস্যার শেষ কোথায়, জানা নেই কারোরই!
বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনের ভাষ্য মতে, বর্তমান সময়ে যুদ্ধ ও সংঘাতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মৃত্যু হচ্ছে শিশুদের। অকাতরে মারা পড়ছে শিশুরা। রণাঙ্গনে ও যুদ্ধপ্রান্তরে তৈরি হয়েছে শিশুদের লাশের পাহাড়! সর্বত্র গড়াগড়ি দিচ্ছে শত সহস্র শিশুর রক্তাক্ত মরদেহ।
মিডিয়া প্রতিদিন দেখাচ্ছে যে, মধ্যপ্রাচ্য নামক অঞ্চলটির সর্বত্রই মরছে হাজার হাজার শিশু। মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতে প্রধান বলি হচ্ছে শিশু-কিশোরেরা। সেখানে যুদ্ধে এবং শরণার্থী শিবিরে নিত্য মরছে নাম না জানা সংখ্যাহীন শিশু। বিপন্ন ও অবরুদ্ধ শিবিরে খাদ্যের অভাবেও প্রাণ দিচ্ছে শিশুরা। বোমা ও গোলার আঘাতে একতরফা নিহত হচ্ছে শিশু এবং নারীরা।
জাতিসংঘের একটি অধিবেশনের আলোচনা থেকে জানা গেছে, দায়েশ, তালিবান ও আল-নুসরা ফ্রন্ট বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যত শিশু হত্যা করেছে, তা অকল্পনীয়। অন্যদিকে, ইয়েমেনের যুদ্ধপরিস্থিতিতেও হিংসার বলি হচ্ছে অজস্র শিশু।
জাতিসংঘের আলোচনা থেকে শিশুহত্যার যে ভয়াবহ চিত্রটি উঠে আসেনি, তাহলো, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ ও অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে লড়াইটি এখন মানবতা, মানবাধিকার, ন্যায়বিচার ও শান্তির প্রতি তীব্র মস্করা হয়ে দাঁড়িয়েছ। শান্তির নাম করে বিভিন্ন পক্ষ পশ্চিমা দেশগুলো থেকে ‘সুন্দর অস্ত্র’ কিনে তা নিরীহ মানুষের ওপর ব্যবহার করছে। শান্তি ও মানবাধিকারের পক্ষে কথা বলে জড়িতরা নিজেদের চেহারা গোপন রাখলেও তাদের বীভৎস তৎপরতা স্পষ্ট হয়েছে। কারণ তাদের হাতেও মারা পড়ছে নারী, শিশু ও বৃদ্ধরা।
লাগাতার সংঘাত ও যুদ্ধের আগুনে যখন পুড়ছে মধ্যপ্রাচ্য ও মূলত মরছে শিশুরা, তখন দুটি ভিন্ন ধরনের চিত্র দেখতে পাওয়া গেছে সিরিয়া ও ইয়েমেনে।
সিরিয়ায় দেখা গেছে, একতরফা হামলায় অবোঝ শিশুরা মরছে। অন্যদিকে ইয়েমেনে শিশুদের হাতে জোর করে অস্ত্র তুলে দিয়ে পাঠানো হচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্রে।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ইয়েমেনে যোদ্ধাদের এক তৃতীয়াংশই শিশু! এই শিশু-সৈনিকরা দারিদ্র্যের কারণে যুদ্ধে যাচ্ছে এমনটি নয়, যাচ্ছে বাধ্য হয়ে। শিশুযোদ্ধারা তাদের বাবা-মা, অভিভাবক এবং রাজনীতিবিদদের ক্রীড়নক হয়ে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে বাধ্য হচ্ছে। গবেষকরা জানিয়েছেন, শিশুদের যুদ্ধে পাঠানোর কারণে অনেক স্কুল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
এদিকে, ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন শুরুর পর বৃহস্পতিবার যুদ্ধ গড়িয়েছে অষ্টম দিনে। যুদ্ধ শুরুর পর এখন পর্যন্ত দেশটি ছেড়ে পাশের দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে ১০ লাখের বেশি মানুষ।
এত বেশি মানুষ ইউক্রেন ছেড়েছে যে, ‘শতাব্দীর বড় শরণার্থী সংকট’ তৈরি হতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। সংস্থাটি বলছে, আশঙ্কাজনকভাবে মানুষ দেশটি ছেড়ে পাশের দেশগুলোতে চলে যাচ্ছে।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয় সংস্থা মার্কিন সংবাদ সংস্থা এপিকে জানায়, এক সপ্তাহেরও কম সময়ে ইউক্রেনের মোট জনসংখ্যার ২ শতাংশের বেশি মানুষ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। খারকিভ শহর থেকে বেশি মানুষ পালিয়েছে পাশের দেশগুলোতে।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার মুখপাত্র জুং-আহ গেদিনী-উইলিয়ামস বলেন, জাতীয় কর্তৃপক্ষের সংগৃহীত পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে মধ্য ইউরোপে শরণার্থীর সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এই সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে।
সংস্থাটির আরেক মুখপাত্র শাবিয়া মান্টু বলেন, ‘এই হারে’ ইউক্রেন ছেড়ে পালানোর ঘটনা ‘শতাব্দীর সবচেয়ে বড় শরণার্থী সংকট’ তৈরি করতে পারে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬৫৫
আপনার মতামত জানানঃ