অক্সিজেনের বিশেষ ব্যবস্থা ছাড়া কেউ মহাকাশ পরিভ্রমণে যেতে পারেন না। কারণ পৃথিবীর বাইরে মহাশূন্যে কোনো বাতাস নেই। বায়ুর চাপ না থাকায় তাদের স্পেস স্যুট পরতে হয়। না হলে বাঁচাই দায়। বায়ুশূন্য পরিবেশে সব সময় থাকতে অভ্যস্ত হওয়ার জন্য অনেক দিন ধরে নাসার গবেষণাগারে কৃত্রিম বায়ুশূন্য কক্ষে অনুশীলন করতে হয়।
প্রশ্ন হলো, পৃথিবী তো মহাশূন্যেই নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরছে। মহাশূন্যে বাতাস নেই অথচ পৃথিবীতে বাতাস। এটা কীভাবে সম্ভব হলো? এটা কি ব্যতিক্রম? যদি তা-ই হয়, তাহলে এই ব্যতিক্রম কীভাবে হলো?
সন্দেহ নেই এটা ব্যতিক্রম এবং শুধু তা-ই নয়, বলা যায় অদ্বিতীয় ব্যতিক্রম। অন্তত আমাদের সৌরজগতের অন্য কোনো গ্রহে পৃথিবীর মতো অক্সিজেনসমৃদ্ধ বায়ুমণ্ডল নেই।
তবে আজ পৃথিবীতে বাতাস আছে, কিন্তু প্রথমে ছিল না। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, সূর্য, পৃথিবীসহ অন্য গ্রহগুলো একই সময়ে সৃষ্টি হয়। সেই জন্মলগ্নে পৃথিবীতে সমুদ্র বা বাতাস ছিল না। যদি থাকত, তাহলে প্রাথমিক পর্বের তীব্র সৌরবায়ুর ঝাপটায় উড়ে যেত। পৃথিবীর আকাশে বাতাস এসেছে পরে।
আদি যুগে পৃথিবীতে লাখ লাখ আগ্নেয়গিরি ছিল। প্রায়ই অগ্ন্যুৎপাত হতো। অনেক বাষ্প বের হতো। বাষ্পে রয়েছে পানির উপাদান—দুইটি হাইড্রোজেন ও একটি অক্সিজেন পরমাণু। আগ্নেয়গিরি থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও অ্যামোনিয়া গ্যাসও বের হতো। এসব মিলেই পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল।
প্রথম দিকে বাতাসের কার্বন ডাই-অক্সাইড সমুদ্রের পানিতে বেশি হারে দ্রবীভূত হয়। পানির ব্যাকটেরিয়া সূর্যরশ্মি ও কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে এবং অক্সিজেন বাতাসে ছেড়ে দেয়। এভাবে বাতাসে অক্সিজেনের হার বাড়ে।
অন্যদিকে অ্যামোনিয়ার অণু তীব্র সূর্যরশ্মির প্রভাবে বিভক্ত হয়ে নাইট্রোজেন ও হাইড্রোজেন তৈরি করে। এভাবে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ৭৮ ভাগ নাইট্রোজেন, ২১ ভাগ অক্সিজেন ও অল্প মাত্রার অন্যান্য কিছু গ্যাস সমন্বয়ে গঠিত হয়। এই বায়ুমণ্ডলই আমাদের বেঁচে থাকার অন্যতম একটি শর্তে পরিণত হয়েছে।
অন্যান্য গ্রহে হালকা বায়ুমণ্ডলের অস্তিত্ব রয়েছে। মঙ্গল গ্রহের বায়ুমণ্ডল খুবই হালকা। এর ঘনত্ব আমাদের বায়ুমণ্ডলের ১০০ ভাগের মাত্র ১ ভাগ। অক্সিজেন প্রায় নেই। বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস, নেপচুন প্রভৃতি বড় গ্রহগুলোর বায়ুমণ্ডলে হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, মিথেন ও অ্যামোনিয়া রয়েছে।
তাই বলা যায়, একমাত্র আমাদের পৃথিবীতেই মানুষসহ বিভিন্ন প্রাণীর বেঁচে থাকার মতো বায়ুমণ্ডল আছে। কিন্তু এখন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল এক নতুন সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে। এটা হয়েছে বাতাসে বেশি হারে কার্বন ডাই-অক্সাইড জমা হতে থাকায়। কার্বন ডাই-অক্সাইড বাড়লে পৃথিবীর গড় উষ্ণতা বাড়ে। শুধু তা-ই নয়, জলবায়ু বিপর্যয়ও দেখা দেয়।
এখন যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অনেক দেশে অসময়ে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বনাগ্নি প্রভৃতি হচ্ছে, এটা জলবায়ু বিপর্যয়ের একটি লক্ষণ এবং এর মূলে রয়েছে বায়ুমণ্ডলে ক্রমবর্ধমান কার্বন ডাই-অক্সাইড। এটা প্রাণের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বিপজ্জনক।
কার্বন ডাই-অক্সাইড কেন বাড়ছে? এর মূল কারণ জানতে যেতে হবে প্রায় ৩০০ বছর আগে। সে সময় বিশেষত ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের ফলে কয়লা ও পেট্রল-জাতীয় জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর হার ক্রমাগত বাড়তে থাকে।
কলকারখানা, রেল, মোটরগাড়ি প্রভৃতি পরিবহন চালানোর জন্য কয়লা ও পেট্রল দরকার। আর এসব জ্বালানি পোড়ালে শক্তি উৎপাদন হয় বটে, কিন্তু পাশাপাশি বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডও বেশি হারে জমা হয়। এর ফলে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বাড়তে থাকে।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ কমিয়ে আনতে হবে। ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর গড় উষ্ণতা শিল্পবিপ্লবের সময়ের তুলনায় দেড় ডিগ্রি বা খুব বেশি হলে দুই ডিগ্রির বেশি বাড়তে দেওয়া যাবে না। এটা পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার অন্যতম শর্ত। পাশাপাশি বনাঞ্চল রক্ষা ও বাড়ানো দরকার।
তাই বলা যায়, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে শুধু বাতাস থাকাই যথেষ্ট নয়, এর উপাদানগুলোর মধ্যে প্রয়োজনীয় ভারসাম্য রক্ষাও একটি অন্যতম দায়িত্ব। বিশেষত বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের হার কমিয়ে আনা ও অক্সিজেনের হার প্রয়োজনীয় অনুপাতে রাখার ব্যবস্থা করা এখন বিশ্বসভ্যতার অন্যতম চ্যালেঞ্জ।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬৫০
আপনার মতামত জানানঃ