স্বাদে জুড়ি নেই মিনিকেট চালের ভাতের। এ চালের ভাতের রসনা তৃপ্তির জন্য ব্যাকুল মানুষ। অথচ দেশে ‘মিনিকেট’ নামে কোনো ধানের জাত না থাকলেও এই নামে প্রতারণার মাধ্যমে রমরমা বাণিজ্য চলছে দীর্ঘকাল ধরে। এক শ্রেণির চালকল মালিক মোটা চাল ছেঁটে সরু করে ‘মিনিকেট’ বলে বাজারজাত করে বিপুল পরিমাণ মুনাফা লুটে নিচ্ছে।
দেশে প্রায় আড়াই দশক ধরে ‘মিনিকেট’ নামে চাল বাজারজাত হচ্ছে। বাজারে চালু ধারণা হলো, এটি একটি বিশেষ জাতের চাল, যা দেখতে চিকন, ফর্সা এবং চকচকে। ফলে অনেক ভোক্তা বাড়তি খরচ দিয়ে হলেও কিনে খেয়েছেন মিনিকেট নামের চিকন চাল।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একটি গবেষক দল দেশের ১০টি জেলা থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে। তাদের গবেষণা সমীক্ষার প্রতিবেদনে এটি বলা হয়েছে।
গবেষক দলের ওই প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, ‘বাস্তবতা হলো—বিশ্বের কোথাও মিনিকেট নামে কোনো ধান নেই। বিজ্ঞানীরা এ নামে কোনো ধান আবিষ্কার করেননি। দেশেও মিনিকেট নামে কোনো ধানের অস্তিত্ব নেই। তাই এ জাতের ধান উৎপাদনও হয় না। যেখানে ধান হিসেবে মিনিকেটের অস্তিত্বই নেই, সেখানে একই নামে চাল থাকার প্রশ্ন ওঠে না।’
গবেষণা প্রতিবেদনে আরও দাবি করা হয়, বাজারে মিনিকেট নামে যে চাল পাওয়া যাচ্ছে বা বিক্রি হচ্ছে, তা আদৌ মিনিকেট নয়। মূলত বিআর-২৬, বিআর-২৮, বিআর-৩৩, ব্রি-৪৩, ৪৮ থেকে ৯৮ পর্যন্ত উদ্ভাবিত বিভিন্ন জাতের ধান এবং কল্যাণী, স্বর্ণা, গুটিস্বর্ণা, লাল স্বর্ণা, আইআর-৫০, জাম্বু ও কাজললতা ধানের চালকে মিনিকেট চাল হিসেবে চালানো হচ্ছে। এসব ধানের চালকে মিল পর্যায়ে গ্রেডিং ও মিক্সড গ্রেডিংয়ের মাধ্যমে পলিশ করে চকচকে করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিনিকেট কোনো জাত নয়, এটি একটি ব্র্যান্ড নাম। এ নামে বিভিন্ন চালকে ব্র্যান্ডিং করছেন অটোরাইস মিলাররা। তা করা হচ্ছে সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে বেশি ক্রেতা টানতে এবং বাড়তি মুনাফা করতে।
মাঠপর্যায় থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে গবেষক দল একমত হয়েছে, দেশে মিনিকেট নামে আদতে কোনো ধান নেই।
প্রতিবেদনের ফলাফলে বলা হয়, মিনিকেট চাল নিয়ে দেশে যা হচ্ছে, তার পুরোটাই মিথ্যা প্রচারণা। ভোক্তারা সেটি বুঝতেও পারছেন না। বাজারজাতকারীরা ভোক্তাকে অন্ধকারে রেখে প্রচলিত মিথ্যাকেই বাস্তবে ব্যাপক মাত্রায় বিশ্বাসযোগ্যতায় রূপ দিতে সক্ষম হয়েছেন। এতে মিনিকেট চালের ব্যবসা চলছে রমরমা। প্রতি কেজি চালে দিতে হচ্ছে বাড়তি দাম। এতে পকেট কাটা যাচ্ছে ক্রেতার। অথচ ওই চালের ভাত খেয়ে ভোক্তার উপকার তো হচ্ছে না, বরং আরও ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, মিল মালিকেরা ব্রি-২৮ এবং ব্রি-২৯ জাতের ধান থেকে পাওয়া চাল দিয়ে মিনিকেট ও নাজিরশাইল চাল তৈরি করছেন। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে এই দুটি জাতের ধানই সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয়। সাধারনত ৪০ টাকা কেজি দরে এই চাল বিক্রি হয়। অন্যদিকে, বাজারে মিনিকেট ও নাজিরশাইল চালের দাম ৫৫ টাকা থেকে ৬০ টাকা কেজি।
মিনিকেট চাল নিয়ে খোঁজখবর ও গবেষণার জন্য গত কয়েক বছরে সরকার বেশকিছু কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু চালের এই অসাধু ব্যবসা বন্ধ করা আজও সম্ভব হয়নি।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ একটি সংস্থা, খাদ্য পরিকল্পনা ও পর্যবেক্ষণ ইউনিট (এফপিএমইউ) ২০২০ সালে একটি জরিপ চালায়। জরিপে দেখা যায়, আধুনিক অটো রাইস মিলের মালিকেরা মেশিনের মাধ্যমে চালের আকার পরিবর্তন করেন এবং পলিশ করে চালকে চকচকে রূপ দেন। এ প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘রাইস মিলিং’।
এর ফলে কোন চাল কোন ধান থেকে আসছে তা বোঝার কোনো উপায় থাকে না ক্রেতার।
এছাড়া জরিপে আরও দেখা গেছে, পলিশিং ও হোয়াইটেনিং (সাদা বানানো) এর সময় চালে বিদ্যমান প্রোটিন, ফ্যাট, ভিটামিন ও খনিজ পদার্থের মতো পুষ্টিগুণগুলো চলে যায়।
এফপিএমইউ প্রকাশিত ২৫ পৃষ্ঠার ওই গবেষণাতে বলা হয়, ‘যেহেতু রাইস মিলিং বা চালের আকার-আকৃতি বদলানো এবং ব্র্যান্ডিং নিয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট নীতি নেই; তাই তারা নিজেদের ইচ্ছামতো কাজ করে যাচ্ছে এবং ক্রেতাদের এই চাল কিনতে বাধ্য করছে’।
কীভাবে এলো মিনিকেট
মিনিকেট নামের উৎপত্তি নিয়ে আরেক কৃষিবিদ সিরাজুল করিম চমৎকার তথ্য দেন। তিনি জানান, ১৯৯৫ সালের দিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত ভারতের কৃষকদের মাঝে সে দেশের ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট নতুন জাতের চিকন ‘শতাব্দী’ ধানের বীজ বিতরণ করে। মাঠপর্যায়ে চাষের জন্য কৃষকদের এ ধান বীজের সাথে কিছু কৃষি উপকরণসহ একটি ‘মিনিপ্যাকেট’ দেয়া হয়। মিনিপ্যাকেটে করে দেয়ায় ভারতীয় কৃষকদের কাছে এ ধান শেষমেশ মিনিপ্যাকেট শব্দটির ‘প্যা’ বাদ দিয়ে মিনিকেট বলে পরিচিতি লাভ করে। এটিই পরে চলে আসে বাংলাদেশে।
কৃষি বিভাগের অন্য একটি সূত্র জানায়, ৯৫ পরবর্তী সময়ে বোরো মৌসুমে সেই মিনিপ্যাকেটের শতাব্দী ধানের বীজ সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের কৃষকদের হাতে পৌঁছে যায়। ঝিনাইদহ জেলার সীমান্তবর্তী মহেশপুর উপজেলার চাষিরা এনে সর্বপ্রথম এ ধানের চাষ শুরু করেন। আমাদের দেশে আগে নাজিরশাইল, পাজাম ও বালাম ধানের চাষ হত। এসব দেশি সরু ধানের চালের ব্যাপক চাহিদা ছিল।
বিশ্বের কোথাও মিনিকেট নামে কোনো ধান নেই। বিজ্ঞানীরা এ নামে কোনো ধান আবিষ্কার করেননি। দেশেও মিনিকেট নামে কোনো ধানের অস্তিত্ব নেই। তাই এ জাতের ধান উৎপাদনও হয় না। যেখানে ধান হিসেবে মিনিকেটের অস্তিত্বই নেই, সেখানে একই নামে চাল থাকার প্রশ্ন ওঠে না।’
বরিশালের বালামের সুনাম ছিল ভারত উপমহাদেশব্যাপী। কালের বিবর্তনে সব সরু জাতের ধান চাষ উঠে যায়। সরু চালের সন্ধান করতে থাকেন ক্রেতারা। এ সময় বাজারে কথিত মিনিকেটের আবির্ভাব ঘটে। ক্রেতারা লুফে নেয় এ সরু জাতের চাল। সুযোগ বুঝে এক শ্রেণির মিল মালিক মাঝারি সরু বি আর-২৮, বিআর-২৯ ও বি আর-৩৯ জাতের ধান ছেঁটে ‘মিনিকেট’ বলে বাজারজাত করতে শুরু করেন। বর্তমানে সারা দেশে চিকন চাল বলতে এখন ‘মিনিকেট’ই বোঝায়, যার দামও চড়া। দেখতেও চকচকে, আকর্ষণীয়।
মিল মালিকদের বক্তব্য
এদিকে মিনিকেট ও নাজিরশাইলের নামে অন্যান্য জাতের চাল বিক্রি করার কথা স্বীকার করেছেন রাইস মিলাররা। তারা জানান, বাজারে মিনিকেটের প্রচুর চাহিদা থাকায় এই পন্থা অবলম্বন করেন তারা। এমনকি কখনো কখনো চাহিদা পূরণ করতেই হিমশিম খেতে হয় তাদের।
বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাস্কিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলী বলেন, ‘আমরা যদি এটাকে মিনিকেট নামকরণ না করি, তাহলে ক্রেতারা এটা কিনবে না। মানুষ খাওয়ার টেবিলে মিনিকেট চালের ভাত চায় বলেই আমরা এর নাম দিয়েছি মিনিকেট’।
‘আমরা যদি এর নাম দেই ‘জিরাশাইল’, আপনি তো এটা কিনবেনই না। কিন্তু মিনিকেট নাম দিলে কেনার আগে আর দ্বিতীয়বার ভাববেন না’, যোগ করেন তিনি।
লায়েক আলী জানান, দেশজুড়ে ব্যাপক হারে জিরাশাইল ধানের আবাদ হচ্ছে। তারা জিরাশাইল ধানকেই মিনিকেট নামে বিক্রি করছেন। অন্যদিকে নাজিরশাইল চাল বানানো হচ্ছে কাটারি ও জিরা ধান থেকে।
‘আমাদের কাছে নাজিরশাইল চালও নেই। অতীতে আমরা পাইজাম ধান থেকে নাজিরশাইল বানাতাম। কিন্তু এখন আমন ধানের মৌসুমে বিভিন্ন স্লিম ভ্যারাইটি পাওয়া যায় যা থেকে নাজিরশাইল বানানো হয়। বর্তমানে কাটারি থেকে নাজিরশাইল বানানো হচ্ছে’, বলেন লায়েক আলী।
চালকে অতিরিক্ত পলিশিং করার ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে লায়েক আলী বলেন, চাল দেখতে সুন্দর-ঝরঝরে না হওয়া পর্যন্ত এটিকে পলিশ করে মিলাররা।
কিন্তু অটো রাইস মিল মালিকদের কাছ থেকে ক্রেতারা প্রতারিত হচ্ছেন জানানোর পরেও তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। এমনকি ভোক্তা অধিকার-সংরক্ষণ অধিদপ্তরও এই ব্যবসা ঠেকাতে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
ভোক্তা অধিকার-সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক শামীম আল মামুন বলেন, ‘আমরা কোনো ভোক্তার কাছ থেকে মিনিকেট চালের ব্যাপারে কোনো অভিযোগ পাইনি’।
তিনি জানান, রাইস মিল মালিকদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার এখতিয়ার সরকারের আছে।
অতিমাত্রায় পলিশিং এর কারণে চালের পুষ্টিগুণ চলে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে অবগত আছেন লায়েক আলীর মতো নেতারাও। তবুও কেন এই চাল বিক্রি করছেন জানতে চাইলে তার সোজাসাপ্টা উত্তর, ‘ক্রেতারা চায়, তাই আমরা এই চাল সরবরাহ করি’।
সরকারের দায়িত্বশীলরা যা বলছেন
নানা গবেষণার তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এখন সরকারও জোরালোভাবে দাবি করছে মিনিকেট নামে ধান যেহেতু নেই, এ নামে চাল হওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
এ প্রসঙ্গে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, ‘মূলত চিকন বা সরু জিরাশাইল, শম্পা কাটারি ধান থেকে পাওয়া চালকে মিনিকেট বলা হচ্ছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত বিআর-২৮, বিআর-২৯ ধান থেকে উৎপাদিত চালকেও মিনিকেট বলে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। আর আমরাও মিনিকেটই খুঁজছি।’
খাদ্য সচিব ড. নাজমানারা খানুম এ প্রসঙ্গে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মিনিকেট আদৌ কোনো ধান-চালের নাম নয়। এটা একটা ব্র্যান্ড নেম। বিভিন্ন জাতের ধান কেটে যে চালই উৎপাদন করা হচ্ছে, সে চালকেই মিলাররা নাম দিচ্ছে মিনিকেট’।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘বিআর-২৬, বিআর-২৮, বিআর-৩৩, ব্রি-৪৩, ৪৩, ৪৮ থেকে ৯৮ পর্যন্ত বিভিন্ন জাতের হাইব্রিড ধান রয়েছে। দেশে ৩ কোটি ৮৪ লাখ টনের যে ধান উৎপাদন হয়, তার উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে এই হাইব্রিড ধান। কিন্তু এত এত ধান মাঠে উৎপাদন হলেও তা আমরা বাজারে দেখতে পাই না। আবার যা দেখছি, তা তো মাঠে ফলাতে দেখছি না। অর্থাৎ বিষয়টি এখানেই স্পষ্ট যে ব্রি উদ্ভাবিত মাঠপর্যায়ের ধানকে সংগ্রহের পর মিলপর্যায়ে প্রসেস করে পাওয়া চালকে মিনিকেট বলে বাজারে ছাড়া হচ্ছে।’
ব্রির ফলিত গবেষণা বিভাগের প্রধান গবেষক ড. মো. হুমায়ূন কবীর জানান, মিনিকেট চালের ব্র্যান্ডিং বন্ধে করণীয় অনেক কিছু আছে। তবে সময় বেশি লাগলেও সবচেয়ে সহজ সমাধান হলো ব্রির আবিষ্কৃত অন্তত ১৫টি প্রিমিয়াম কোয়ালিটির ধানবীজ (চিকন) সারা দেশে মাঠপর্যায়ে ছড়িয়ে দেয়া। কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করার মাধ্যমে ওই সব ধানের উৎপাদন বাড়ানোর ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেয়া।’
মিনিকেট আমাদের জন্য কতটা ক্ষতিকর?
ব্রির ফলিত গবেষণা বিভাগের প্রধান গবেষক ড. মো. হুমায়ূন কবীর জানান, কেমিক্যাল মিশ্রণ ও অতিরিক্ত ছাঁটাইয়ের কারণে মিনিকেট চালে শুধু শর্করা ছাড়া অন্যান্য পুষ্টিগুণ বলে আর কিছুই থাকে না। এ প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত চাল মানবশরীরের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে।
তিনি বলেন, ‘প্রাকৃতিক চালে নানা মাত্রিক পুষ্টিকর উপাদান থাকে, যার সিংহভাগই থাকে চালের উপরিভাগে। ছাঁটাই প্রক্রিয়ায় এটি ঝরে যায়। ভাত খাব অথচ এর আসল উপাদান থেকে বঞ্চিত হব, সেটি আমরা চাই না। জিংক ও আয়রন যদি চালে না থাকে, তাহলে আমাদের শরীরের যে ক্ষতি হবে, তার আর্থিক মূল্য অনেক।’
গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত ছাঁটাইয়ের ফলে মিনিকেট নামে এই চালে ভিটামিন, মিনারেল, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, প্রোটিন, আঁশ– এসবের কিছুই থাকে না। শুধু থাকে কার্বোহাইড্রেট। এই চালের ভাতে অভ্যস্তদের নানা রকম অপুষ্টিজনিত রোগবালাই হওয়ার ঝুঁকি থাকে। পলিশ করার কারণে মিনিকেট চালে শর্করার পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় ১ দশমিক ১৭ শতাংশ বেড়ে যায়। শর্করার পরিমাণ বাড়লে গ্লাইসিমিক ইনডেক্স বেড়ে যায়।
চাল থেকে প্রোটিন বা আমিষও পাওয়া যায়। প্রতি ১০০ গ্রাম চালে আমিষ থাকে প্রায় ৬-৭ শতাংশের মতো। কিন্তু কলে ছাঁটার কারণে ১-২ শতাংশ প্রোটিন নষ্ট হয়ে যায়। সবচেয়ে ক্ষতিকর হলো ফ্যাট বা অয়েল কমে যাওয়া। অয়েল কমে যায় ৬২ শতাংশ, ক্রুড ফাইবার কমে ৪০ শতাংশ এবং অ্যাশ কমে ১১৮ শতাংশ। এ ছাড়া ভিটামিন বি-১, বি-৬ প্রায় ৮০ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়।
সর্বশেষ পরিস্থিতি
চালের অসাধু ব্যবসা ঠেকাতে সরকার ব্যর্থ হওয়ায় উচ্চ আদালতের কাছে একটি লিখিত পিটিশন দায়ের করে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ। ২০২১ সালের ২১ নভেম্বর হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ‘মিনিকেট’ ও ‘নাজিরশাইল’ চাল প্রস্তুতকারক ও বাজারজাতকারী সবগুলো রাইস মিলারের তালিকা দিতে সরকারকে নির্দেশ দেয়।
চালের আকৃতি পরিবর্তন ও পলিশিংয়ের ফলে চালের পুষ্টিগুণ নষ্ট হচ্ছে কিনা এবং তা জনস্বাস্থ্যের প্রতি হুমকি কিনা জানিয়ে চার মাসের মধ্যে একটি গবেষণা প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশও দেয় হাইকোর্ট।
তাছাড়া, কম পুষ্টিগুণসম্পন্ন একটি চাল তৈরি ও বাজারজাতকরণের বিরুদ্ধে সরকার কেন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না তা জানতে চেয়ে একটি রুল জারি করে আদালত।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মোসাম্মত নাজমানারা খানম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, চালের অসাধু ব্যবসা ঠেকাতে একটি পূর্ণাঙ্গ গাইডলাইন তৈরি করতে চান তারা। ইতোমধ্যেই মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব খাজা আবদুল হান্নানকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
সচিব বলেন, ‘আমরা প্রতিবেশী দেশসহ আন্তর্জাতিক পর্যায়ের মিলিং প্রক্রিয়াও দেখবো। তারপর আমরা আমাদের স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণ করবো। একটা প্রোগ্রামে আমি শুনেছি ডিজি (ব্রি) বলছেন, মিলিং যদি ৮ শতাংশ হয় তাহলে চালের পুষ্টিগুণ রক্ষা করা সম্ভব। কিন্তু আমাদের দেশে মিলিং এর মাত্রা ৩০ শতাংশ’।
নাজমানারা খানম মনে করেন, গাইডলাইন তৈরি যখন সম্পন্ন হবে, তখনই সরকারের পক্ষে অসাধু মিলারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে।
দেশের প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকার চালের বাজারে মিনিকেটের বাজারই চার হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ বাজারে যত চাল তার ২২ ভাগের একভাগই মিনিকেট নামে বিক্রি হচ্ছে। আর দেশের প্রায় ৮০০টি চালকল মিনিকেট প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, চাল ছাঁটাইয়ের মাধ্যমে আকর্ষণীয় করে মিল মালিকরা প্রতারণা করছেন। পলিশিং করে মিলগুলো চালকে চিকন করে। এতে অনেক পুষ্টিগুণ চলে যায়। একটি অগ্রসরমান অর্থনীতিতে এমন প্রতারণা মেনে নেওয়া যায় না। এটা আইন করে বন্ধ করা উচিত। কোন জাতের চাল এ বিষয়টি গুরুত্ব না দিয়ে মিলগুলো নিজেদের মতো ব্র্যান্ড দাঁড় করিয়ে ভোক্তাদের সঙ্গে প্রতারণা করছে।
তারা বলেন, পুষ্টির ঘাটতি রোধে সরকারের বড় বড় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হচ্ছে। শুধু চালের মাধ্যমে জিঙ্ক সরবরাহ করা যাবে এমন নয়। তবে দেশের মানুষের প্রধান খাদ্য চাল হওয়ায়, এর মাধ্যমেই জিঙ্ক সরবরাহ করা সহজ। চালের মাধ্যমে এ উপাদানের সরবরাহ যথাযথ। আইন করে যেমন লবণে আয়োডিন এবং তেলে ভিটামিন থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে তেমনি চালের ক্ষেত্রেও আইন করা দরকার। কেউ প্রতারণা করে চালের যেমন ইচ্ছা তেমন রূপ দেবে এমনটি হতে পারে না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৫৪
আপনার মতামত জানানঃ