পাকিস্তানে প্রতি বছর বাড়ছে ধর্ষণের ঘটনা৷ সামাজিক প্রতিবন্ধকতা, নারীদের মত প্রকাশের অধিকার না থাকা এবং যর্থার্থ বিচার না হওয়ায় নারীর ওপর এই সহিংসতা বেড়েই চলেছে বলে মনে করছে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন৷ এবার তা স্বীকার করলেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেছেন, সমাজে দুই ধরনের অপরাধ বাড়ছে। এর একটি হলো দুর্নীতি। অন্যটি যৌন অপরাধ।
বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে গতকাল রোববার বৈঠক করেন ইমরান খান। সেই বৈঠকে এসব কথা বলেন তিনি।
পাকিস্তানের পত্রিকা ডনের খবরে বলা হয়েছে, তরুণদের বিশ্বাস, ধর্ম ও নৈতিক মূল্যবোধের ওপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে যে আঘাত হানা হচ্ছে, তা থেকে রক্ষার উপায় খুঁজতে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
এ বৈঠকে ইমরান খান বলেন, ‘আমাদের সমাজে যৌন অপরাধ ব্যাপক হারে বাড়ছে। এর মধ্যে রয়েছে ধর্ষণ, শিশুদের যৌন হয়রানি। এর এক শতাংশের খবর পাওয়া যায়।’
প্রসঙ্গত, নারী অধিকার কর্মী সারাহ জামান জানান, পুলিশ ও আদালতের জিজ্ঞাসাবাদের ভয়ে ৭০ ভাগ ধর্ষণের ঘটনা নথিভুক্ত হয় না৷ কেননা ধর্ষণের ঘটনায় দণ্ড প্রদানের ঘটনা বিরল, মাত্র ২ শতাংশ৷
‘সাহিল’ নামে একটি নারী নির্যাতন বিরোধী সংগঠনের প্রোগ্রাম অফিসার আতা মহীউদ্দীন বললেন, এ সব সামাজিক প্রতিবন্ধকতা এবং বিচারের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে নারীদের ধর্ষণ, নির্যাতন ও সহিংসতার ঘটনা বেড়েই চলেছে৷
তাদের একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৯৬ সালের চেয়ে বর্তমানে ধর্ষণের হার বেড়েছে ৭.৬ ভাগ৷ অপর এক সংগঠন ‘আওরাত’ ফাউন্ডেশন বলছে, ২০১২ সালে পাকিস্তানে ধর্ষণ ও গণ ধর্ষণের ৮২২টি ঘটনা নথিভুক্ত করা হয়েছে৷
ন্যাশনাল রেহমাতুল-লিল-আলামিন অথরিটি এ সংলাপের আয়োজন করেছিল।
ইমরান খান বলেন, ‘যৌন অপরাধের বিরুদ্ধে সমাজের লড়াই করতে হবে। দুর্নীতি ক্ষেত্রেও একই পদক্ষেপ নিতে হবে। সমাজে দুর্নীতিবাজদের অগ্রহণযোগ্য করে তুলতে হবে। কিন্তু হতাশার বিষয় হলো আমাদের নেতারা যখন দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতি করে, তখন এই দুর্নীতি গ্রহণযোগ্য হয়ে যায়।’
এদিক আলোচনা সভায় বিশেষজ্ঞরা ইঙ্গিত দিয়েছেন, মুসলিম দেশগুলোকে এক হয়ে কাজ করতে হবে। আধুনিকায়নের যে নেতিবাচক প্রভাবগুলো রয়েছে, সেগুলোর মোকাবিলা করতে এই দেশগুলোকে এক হয়ে কাজ করতে হবে।
এ আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক সাইয়্যেদ হোসেন নাসর। তিনি বলেন, এই সময় তরুণদের জন্য অনিশ্চিত ও বিপজ্জনক।
নারীদের জন্য বিপজ্জনক পাকিস্তান
নারীর জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশের তালিকায় পাকিস্তান বিশ্বে ছয় নম্বরে অবস্থান করছে৷ যৌন নির্যাতন ও পারিবারিক সহিংসতার হার বেড়েই চলেছে দেশটিতে৷ দেশটির অধিকাংশরাই মনে করেন নারীরা অনিরাপদ।
২০০২ সালে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হওয়া অধিকারকর্মী মুখতার মাই-এর মতও একই৷ তিনি বলেন, যারা নারীর প্রতি সহিংসতা করে, তারা আইনি প্রক্রিয়াকে ভয় করে না৷
তিনি জানান, বেশিরভাগ পাকিস্তানি পুরুষ নারীকে পেটানোকে কোনো সহিংসতাই মনে করে না৷ পাকিস্তানি সমাজ এখনও সামন্তবাদী এবং গোত্রবাদী প্রথা থেকে বের হতে পারেনি বলেও মনে করেন তিনি৷
সমাজের পুরুষতান্ত্রিক আচরণকেও দায়ী করেন অনেকে৷ লাহোর-ভিত্তিক নারীবাদী আন্দোলনকারী মাহনাজ রেহমান বলেন, যখনই নারীরা তাদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার হয় তখনই তাদের সহিংসতার শিকার হতে হয়৷
তিনি বলেন, নারীদের শিক্ষা দেয়া হয় পুরুষকে মান্য করে চলার জন্য, কারণ, পরিবারে তাদের স্ট্যাটাস উঁচুতে৷
লাহোর-ভিত্তিক অ্যাক্টিভিস্ট সাজিয়া খান মনে করেন, কিছু কিছু পুরুষ ধর্মীয় শিক্ষার কারণে নিজেদের আলাদা ভাবতে শুরু করেন৷ তিনি বলেন, আলেমরা এমনভাবে ধর্মের ব্যাখ্যা দেন যে পুরুষরা মনে করে তারা নারীদের পেটাতেই পারে৷ তারা বাল্যবিয়েও সমর্থন করে এবং নারীদের বলে, স্বামী মারধর করলেও তাকে মেনে চলতে৷
দেশটির প্রধানমন্ত্রীর দায়
অনেক অধিকারকর্মীই দেশটির প্রধানমন্ত্রী ‘সহিংসতার শিকার নারীকেই উলটো দায়ী’ করার কারণে নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়েছে বলে মনে করেন৷
চলতি বছরের মাঝামাঝিতে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান যৌন নির্যাতনের জন্য নারীকেই দায়ী করে বক্তব্য দিয়ে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেন৷ মার্কিন টিভি চ্যানেল এইচবিওতে ডকুমেন্টারি নিউজ সিরিজ এক্সিওস-এর জন্য দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, নারী যদি খুব কম কাপড় পরে তাহলে পুরুষের ওপর তার প্রভাব পড়তেই পারে, যদি তারা রোবট না হয়৷ এটাকে ‘সাধারণ জ্ঞান’ বলেও উল্লেখ করেন তিনি৷
এ বছরের শুরুতেও একটি মতবিনিময় অনুষ্ঠানে পাকিস্তানে নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধির পেছনে ‘পর্দার’ অভাবকে দায়ী করে বক্তব্য দেন তিনি৷
অধিকারকর্মীরা বলেন, প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এবং তার মন্ত্রীদের একের পর এক নারীবিরোধী মন্তব্য নারীবিদ্বেষ এবং নারীর প্রতি সহিংসতাকেও এক প্রকার উসকে দিয়েছে৷
তারা মনে করেন, ইমরান খানের সরকার নারীদের রক্ষায় কিছুই করেনি৷ বরং নারীর প্রতি সহিংসতা দমনে একটি আইন দেশের ইসলামিক আলেমদের কাছে পাঠানোর পর তারা তা আটকে দিয়েছেন৷
এসডব্লিউ/এসএস/১২৫৫
আপনার মতামত জানানঃ