সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সংঘাতপ্রবণ এলাকার বাইরে সংবাদকর্মীদের নিহত হওয়ার সংখ্যা বেড়েছে। অনেক দেশেই দুর্নীতি, পাচার, মানবাধিকার লঙ্ঘন কিংবা পরিবেশ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো অনুসন্ধান করতে গিয়ে সাংবাদিকদের জীবন ঝুঁকিতে পড়ছে। সংবাদ প্রকাশের কারণে গত বছর বিশ্বজুড়ে নিহত হয়েছেন ৪৫ জন সাংবাদিক। সবচেয়ে বেশি সাংবাদিক নিহতের ঘটনা ঘটেছে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে।
আন্তর্জাতিক ওয়াচডগ সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব জার্নালিস্ট (আইএফজে) এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানিয়েছে।
বিগত বছরগুলোর তুলনায় নিহত সাংবাদিকদের সংখ্যা ২০২১ সালে সর্বনিম্ন ছিল উল্লেখ করে বিবৃতিতে আইএফজের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘বিশ্বজুড়ে চলমান সংঘাতময় পরিস্থিতির মধ্যে সাংবাদিক হত্যার হার কমে আসা কিছুটা হলেও স্বস্তিদায়ক।’
আইএফজের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে বিশ্বে সর্বোচ্চ সংখ্যক সাংবাদিক নিহত হয়েছেন আফগানিস্তানে- ৯ জন। এছাড়া আফগানিস্তানের প্রতিবেশীদেশ পাকিস্তানে ৩ জন, ভারতে ৪ জন ও মেক্সিকোতে ৮ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন।
বৈশ্বিক অঞ্চলের হিসেবে ২০২১ সালে সবচেয়ে বেশি সাংবাদিক নিহতের ঘটনা ঘটেছে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে। আইএফজের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বিগত বছর এই অঞলে নিহত হয়েছেন ২০ জন সাংবাদিক।
এছাড়া বিগত বছর আমেরিকা অঞ্চলে ১০ জন ও আফ্রিকা মহাদেশে ৮ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে। একই সময়ে ইউরোপে নিহত হয়েছেন ৬ জন সাংবাদিক ও মধ্যপ্রাচ্যে হত্যার শিকার হয়েছেন ১ জন।
আইএফজের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দুর্নীতি, অপরাধ ও ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে প্রতিবেদন করার কারণেই হত্যার শিকার হতে হয়েছে সাংবাদিকদের। তবে সশস্ত্র সংঘাত বা যুদ্ধ কভার করা সংবাদিকদের মৃত্যুর হার কমেছে ২০২১ সালে। তার প্রধান কারণ, মহামারি ও অন্যান্য কারণে অনেকক্ষেত্রেই সংবাদকর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে পারেননি।
তবে বিগত বছর মেক্সিকো, গ্রিস, নেদারল্যান্ডসসহ কয়েকটি দেশে অপরাধী গ্যাং ও মাদক ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য ছিল চোখে পড়ার মতো। উল্লেখযোগ্য সংবাদকর্মীর মৃত্যু হয়েছে এইসব অপরাধী গ্যাং ও মাদক ব্যাবসায়ীদের হাতে।
২০২১ সালে বিশ্বে সর্বোচ্চ সংখ্যক সাংবাদিক নিহত হয়েছেন আফগানিস্তানে- ৯ জন। এছাড়া আফগানিস্তানের প্রতিবেশীদেশ পাকিস্তানে ৩ জন, ভারতে ৪ জন ও মেক্সিকোতে ৮ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন।
তবে হত্যাকাণ্ড কম হলেও পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সরকারের রোষের শিকার হয়ে কারাবরণ করতে হয়েছে অনেক সাংবাদিককে। সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক অলাভজনক সংস্থা কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্ট শুক্রবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ২০২১ সালে বিশ্বজুড়ে কারাবরণ করতে হয়েছে ২৯৩ জন সংবাদকর্মীকে।
এর আগে আন্তর্জাতিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) জানিয়েছে, সংবাদ প্রকাশের কারণে চলতি বছর বিশ্বে ৪৬ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন এবং বিভিন্ন দেশে কারাবন্দী আছেন ৪৮৮ জন।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা এই সংগঠনটি আরও বলেছে, গত বছরের তুলনায় সাংবাদিকদের নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে। যে দেশ ও এলাকাগুলোয় এমন ঘটনা বেড়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে হংকং, মিয়ানমার ও বেলারুশ।
আরএসএফের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, চলতি বছরে যে পরিমাণ নারী সাংবাদিককে আটক করা হয়েছে, সেই পরিমাণ নারী সাংবাদিকে পূর্ববর্তী কোনো বছরে আটক হননি। চলতি বছর নারী সাংবাদিক আটক হয়েছেন ৬০ জন, যা ২০২০ সালের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ বেশি।
আরএসএফ বলছে, বিশ্বজুড়ে ৬৫ জন সাংবাদিককে অপহরণ করা হয়েছে চলতি বছর। এর মধ্যে ৬৪ জনই অপহৃত হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের তিন দেশে। সিরিয়ায় অপহৃত হয়েছেন ৪৪ জন। ইরাকে ১১ ও ইয়েমেনে অপহৃত হয়েছেন ৯ জন। আর একজন সাংবাদিক অপহৃত হয়েছেন ফ্রান্সে।
অনেক দেশেই দুর্নীতি, পাচার, মানবাধিকার লঙ্ঘন কিংবা পরিবেশ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অনুসন্ধানে গিয়ে সাংবাদিকদের জীবন ঝুঁকিতে পড়ছে। এছাড়া, অপহরণ, নির্যাতন, ডিজিটাল ও অন্যান্য মাধ্যমে গুজব রটানোসহ নানা হয়রানিতে পড়তে হচ্ছে সাংবাদিকদের। নারী সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে অনলাইন সহিংসতার মাত্রা বেশি বলেও জানিয়েছে জাতিসংঘ।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, সাংবাদিকরা আরও অগুনিত হুমকির মুখোমুখি হচ্ছেন। যেমন—অপহরণ, নির্যাতন ও গুম থেকে শুরু করে গুজব রটানো ও হয়রানি, বিশেষত ডিজিটাল মাধ্যমে, অনেক ধরনের ঝুঁকি মোকাবিলা করতে হচ্ছে। নারী সাংবাদিকরা বিশেষত অনলাইন সহিংসতার ঝুঁকিতে বেশি।
তিনি বলেন, সমাজের ওপর সামগ্রিকভাবে সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অপরাধের ব্যাপক প্রভাব পড়ে। কারণ তারা তথ্যপ্রাপ্তির মাধ্যমে মানুষকে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সহযোগিতা করেন। কোভিড-১৯ মহামারি এবং ভুল তথ্যের ছায়া মহামারি দেখিয়ে দিয়েছে যে সঠিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য সত্যিকার অর্থেই জীবন-মৃত্যুর পার্থক্য গড়ে দিতে পারে। তথ্যপ্রাপ্তি যখন হুমকিতে পড়ে, তখন তা এমন বার্তা পাঠায়, যা গণতন্ত্র ও আইনের শাসনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, কোনও রাষ্ট্র যদি নিজেকে গণতান্ত্রিক দাবি করে, তবে সেখানে গণমাধ্যমের একশভাগ স্বাধীনতা থাকতেই হবে। যে গণমাধ্যম সরকারের সমালোচনা করবে, সেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আবার সেই সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে। জনসাধারণের কথাই উঠে আসে গণমাধ্যমে। তাই এই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত না করতে পারলে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৩৭
আপনার মতামত জানানঃ