দেশ জুড়ে উত্তাপ ছড়াচ্ছে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা। উন্নত চিকিৎসার জন্য বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেয়া নিয়েই বিতর্কের পারদ চড়ছে। জাতীয় সংসদ, সংসদের বাইরে সভা, সমাবেশ, সেমিনার, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ব্লগ, টুইটার সর্বত্রই এই নিয়ে চলছে তর্ক-বিতর্ক।
একাদশ জাতীয় সংসদের ১৫তম অধিবেশন শুরুর পর থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বেগম জিয়াকে বিদেশে নেয়া ইস্যুতে বিতর্ক চলছে। উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে সংসদ অধিবেশন। বিএনপির এমপিরা বেগম জিয়াকে আইনিভাবে বিদেশে নেয়া যায়, এমন আইনি প্রক্রিয়া বাতলে দিচ্ছেন। প্রয়োজনে মানবিক কারণে বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা দেয়ার জোড়ালো দাবি তুলে ধরছেন। আর আইনমন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীন দলের একাধিক এমপি আইনের ৪০১ ধারা তুলে ধরে বেগম জিয়াকে বিদেশে নেয়া সম্ভব নয় মন্তব্য করছেন।
গত ১৮ নভেম্বর সংসদে পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে বিএনপির এমপি জিএম সিরাজ বলেন, খালেদা জিয়ার জামিন দিয়ে বিদেশে চিকিৎসার জন্য আবেদন করা হয়েছে। জামিন দিয়ে তাকে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হোক। প্রধানমন্ত্রী শপথ নিয়েছিলেন বিরাগের বশবর্তী হবেন না। সম্মান রেখেই বলছি ওনার বক্তব্যের সঙ্গে সেটার অসঙ্গতি দেখছি।
তিনি আরও বলেন, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ নেতা সাজাপ্রাপ্ত মোহাম্মদ নাসিমকে জামিনে বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। আসম আব্দুর রবকে জামিনে জার্মানিতে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়েছিল। চিকিৎসার অভাবে খালেদা জিয়ার কিছু হয়ে গেলে সেই দায় আওয়ামী লীগকে বহন করতে হবে।
কতটা ঝুঁকিতে খালেদা জিয়ার জীবন?
বেগম জিয়ার পরিস্থিতি খুব জটিল হয়ে দাঁড়ালে এবং শারিরীক পরিস্থিতির যথেষ্ট অবনতি হলে সরকার তাকে নিজের বাসায় থেকে চিকিৎসা করাবার সুযোগ দেয়। কিন্তু যখন দেয়া উচিত ছিল তখন না দিয়ে তারা পরিস্থিতির গুরুতর অবনতির জন্য অপেক্ষা করেছে বলেই বেগম খালেদা জিয়ার ঘনিষ্ঠদের পক্ষ থেকে অভিযোগ রয়েছে।
বেগম খালেদা জিয়ার অবস্থা এখন বেশ গুরুতর। রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে এবারে ভর্তি করাবার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার এখন পর্যন্ত তেমন কোনো উন্নতিই হয়নি। আসলে বর্তমানে তার যে অবস্থা তাতে দেশে চিকিৎসার সুযোগ নাই বললেই চলে। জীবন বাঁচাতে হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে নিতেই হবে। চিকিৎসকরা তাকে অনতিবিলম্বে সিঙ্গাপুর কিংবা থাইল্যান্ডে নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
সূত্র মতে খালেদা জিয়ার রোগ ও শারিরীক অবস্থার কথা গণমাধ্যমে যথাযথভাবে তুলে ধরা হচ্ছে না। তবে নির্ভরযোগ্য সূত্র মতে, তিনি তার পুরনো জটিল রোগগুলো ছাড়াও ডিকমপেন্স্যাটেড লিভার সিরোসিস-এ আক্রান্ত হয়েছেন। এটা সম্ভবত ফ্যাটি লিভার থেকে হয়ে থাকতে পারে।
এখন এর দু’টি মাত্র চিকিৎসা সম্ভব; স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্টেশন থেরাপি এবং তাতেও কাজ না হলে লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করা। এর কোনোটিই বাংলাদেশে সম্ভব নয় এবং করার সুযোগ নেই।
শরীর থেকে রক্ত যেতে যেতে খালেদা জিয়ার হিমোগ্লোবিন একেবারে কমে গেলে এবং রক্তবমি হতে থাকলে তাকে এবার হাসপাতালে নেয়া হয়। ডাক্তারেরা এন্ডোস্কপি করে তার লিভার সিরোসিস শনাক্ত করেন। তার দেহে দফায় দফায় রক্ত দেয়া হয় এবং তার বড় হয়ে যাওয়া রক্তনালী এন্ডোস্কপির মাধ্যমে Oesophageal Band ligation করা হয়েছে এবং সিসিইউ-তে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। এর বেশি কিছু বাংলাদেশের ডাক্তারদের করার নাই বলেই জানানো হয়েছে।
এছাড়া বেগম জিয়া দীর্ঘদিন ধরেই আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, অনিয়ন্ত্রিত রক্তচাপ এবং হার্ট, কিডনি ও চোখের সমস্যায় ভুগছিলেন। তিনি নিয়মিত চিকিৎসাধীন ও চিকিৎসকদের তদারকিতে ছিলেন। তাকে জেলে নেয়ার পর সব বন্ধ হয়ে যায়। উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হতে থাকে, তার অবস্থারও গুরুতর অবনতি ঘটে। বারবার দাবি সত্বেও তার প্রয়োজন অনুযায়ী উপযুক্ত হাসপাতালে নিতে দেয়া হয়নি।
সূত্র মতে, এরপর তিনি করোনায় আক্রান্ত হলে তার দেহের অন্যান্য অর্গান ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং রোগগুলোও আরো জটিল হয়ে ওঠে। এরপর শনাক্ত হয় লিভার সিরোসিস। সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশে তার চিকিৎসা সম্ভব নয়। এখন বিদেশে সবগুলো রোগের সমন্বিত চিকিৎসার সুযোগ আছে এমন কোনও হাসপাতালে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করাতে না পারলে বেগম জিয়ার জীবন বিপন্ন হতে পারে। যে কোনও সময়ে লিভার ফেলিওর এবং লিভার ক্যান্সারের দিকে মোড় নেয়ার প্রবল ঝুঁকিতে আছেন তিনি। কেননা তার বয়সটাও অনুকূল নয়।
আইনের আড়ালে ষড়যন্ত্র?
অসুস্থতার কারণে বর্তমানে ‘সাজা স্থগিত’ খালেদা জিয়ার চিকিৎসা চলছে এভার কেয়ার হাসপাতালের সিসিইউতে। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করার পরামর্শ দিয়েছে মেডিক্যাল বোর্ড। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে নেয়ার অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছে পরিবার।
অন্যদিকে আইনমন্ত্রী বলছেন, সাজা স্থাগিত অবস্থায় বেগম জিয়াকে বিদেশে যেতে দেয়া আইনের ৪০১ ধারা অনুমোদন করে না। তাবে কারাগারে নিয়ে নতুন করে আবেদন করলে বিবেচনা করা যেতে পারে।
যদিও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, খালেদা জিয়াকে বিদেশে যেতে দেওয়ার বিষয়ে আইনমন্ত্রী সংসদে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা সঠিক নয়। ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৪০১ ধারার বিধানমতে, সরকার শর্তহীন বা শর্তযুক্তভাবে কোনো দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির দণ্ড মওকুফ করতে পারেন। এ আইনেই বলা হয়েছে, সরকার প্রয়োজন মনে করলে যেকোনো সময় এটার পরিবর্তন, সংযোজন এবং অন্য কোনো শর্ত আরোপ করতে পারেন। অর্থাৎ এটা সম্পূর্ণভাবে সরকারের এখতিয়ার।
প্রসঙ্গত, দেশে এর আগে সাজাপ্রাপ্ত আসামির উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে দেয়ার নজির রয়েছে। ১৯৭৯ সালে উন্নত চিকিৎসার জন্য সাজাপ্রাপ্ত কারাবন্দি আ স ম আবদুর রবকে জার্মানি পাঠানো হয়েছিল। ২০০৮ সালে প্রায় অভিন্ন অবস্থায় আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ নাসিমকে বিদেশে পাঠানো হয়েছিল। বিএনপির নেতারা অভিযোগ করে বলছেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো হয়েছিল।
আ’লীগের প্রতিশোধের রাজনীতি!
বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করানোর সুযোগ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এখানে তার কিছু করার নেই। এটা এখন আইনের ব্যাপার। তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘খালেদা জিয়াকে যে কারাগার থেকে বাসায় থাকতে দিয়েছি, চিকিৎসা করতে দিয়েছি এটাই কি বেশি নয়?’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার হাতে যেটুকু পাওয়ার, সেটুকু আমি দেখিয়েছি। আর কত চান, আমাকে বলেন। এখন সে অসুস্থ, ওই যে বললাম না রাখে আল্লাহ মারে কে, মারে আল্লাহ রাখে কে। সেটাই মনে করে বসে থাকেন। এখানে আমার কিছু করার নাই। আমার যেটা করার, আমি করেছি। এটা এখন আইনের ব্যাপার।’
গত বুধবার বিকেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সাম্প্রতিক স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৬ এ অংশগ্রহণ এবং লন্ডন ও ফ্রান্সে দু-সপ্তাহের সফর বিষয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। সেখানে খালেদা জিয়াকে চিকিৎসা করাতে বিদেশে যাওয়ার আবেদনের বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেবেন; এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন।
তিনি গণভবনে থাকা জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সঙ্গে সরাসরি এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে থাকা সাংবাদিকদের সঙ্গে ভার্চুয়ালি এই প্রশ্নোত্তরপর্বে অংশগ্রহণ করেন। এই প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমার কাছে চান কীভাবে? বলুন তো। খালেদা জিয়াকে যে কারাগার থেকে বাসায় থাকতে দিয়েছি, চিকিৎসা করতে দিয়েছি, এটাই কি বেশি নয়? আপনাকে যদি কেউ হত্যার চেষ্টা করত, আপনি কি তাকে গলায় ফুলের মালা দিয়ে নিয়ে আসতেন? আপনার পরিবারকে যদি কেউ হত্যা করত, আর সেই হত্যাকারীকে যদি কেউ বিচার না করে পুরস্কৃত করে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিত, তাদের আপনি কী করতেন? আমি থাকতে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে ভোট দিয়ে সংসদে বসাল। যেখানে আমি বিরোধীদলীয় নেতা ছিলাম, সেখানে বসানো হলো কর্নেল রশিদকে। কে করেছিল? খালেদা জিয়া।’
কোটালীপাড়ায় বোমা পুঁতে রেখে তাকে হত্যা প্রচেষ্টার প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ‘যখন বোমা পোঁতে, তার আগে তার (খালেদা জিয়া) বক্তৃতা কী ছিল? শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী তো দূরে থাকুক, কোনো দিন বিরোধী দলের নেতাও হতে পারবে না। সেই কথাও বলেছিল। ভেবেছিল মরেই তো যাব। রাখে আল্লাহ মারে কে, আর মারে আল্লাহ রাখে কে। এখন আমার বেলায় সেটা হচ্ছে রাখে আল্লাহ মারে কে। সেখানে তারপরও খালেদা জিয়ার জন্য এত দয়া দেখাতে আমাকে বলেন। কেউ এই প্রশ্ন করলে আমার মনে হয় আপনাদের একটু লজ্জা হওয়া উচিত। বাপ, মা, আমার ছোট ভাই রাসেলকে পর্যন্ত হত্যা করেছে।’
‘তারপরও আমরা অমানুষ না। অমানুষ না দেখেই তাকে আমরা অন্তত তার বাসায় থাকার, চিকিৎসা করানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছি। আমার এক্সিকিউটিভ ক্ষমতা আমার হাতে এতটুকুই আছে। বাকিটা আইনগত ব্যাপার।’
জনমানুষের অবস্থান কোন দিকে?
এদিকে, খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে সুচিকিৎসার দাবিতে গণঅনশন করেছেন দলটির নেতাকর্মীরা। গতকাল শনিবার নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত এই কর্মসূচিতে অংশ নেন তারা। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী সকাল ৯টায় কর্মসূচি শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সকাল ৮টার আগে থেকেই নয়াপল্টনে জড়ো হতে থাকেন বিএনপি নেতাকর্মীরা।
৯টার আগেই কেন্দ্রীয় কার্যালয়কে কেন্দ্র করে সড়কের নাইটিঙ্গেল মোড় ও ফকিরাপুল মোড় পর্যন্ত রাস্তার উপর মাদুর বিছিয়ে হাজার হাজার নেতাকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ গণঅনশনে অংশগ্রহণ করেন। সময় বাড়ার সাথে সাথে কর্মসূচিতে মানুষের ঢল নামে।
নেতা-কর্মীরা খালেদা জিয়ার প্রতিকৃতি হাতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মিছিল নিয়ে গণঅনশনে আসে এবং ‘মুক্তি মুক্তি মুক্তি চাই, খালেদা জিয়ার মুক্তি চাই’, ‘জ্বালাও জ্বালাও আগুন জ্বালাও, অবিলম্বে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে হবে’ ইত্যাদি শ্লোগান দিয়ে পুরো এলাকা তারা সরব করে রাখে। নেতাকর্মীরা সড়কের একপাশে অবস্থান নিলেও বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতির কারণে যানচলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩১০
আপনার মতামত জানানঃ