দেশে হিন্দু জনসংখ্যার হার ক্রমাগত কমছে। গত ৫০ বছরে মোট জনসংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। হিন্দুদের ক্ষেত্রে তা হয়নি। হিন্দুদের সংখ্যা প্রায় ৭৫ লাখ কমেছে। যা প্রায় ৪০ শতাংশ। যদিও এই সময়ে বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী জনসংখ্যার হার মোটামুটি একই আছে। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে যাচ্ছেন। সব দেশের সংখ্যালঘুদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা কাজ করে। সরকার ও বৃহত্তর সমাজের দায়িত্ব হচ্ছে সেই নিরাপত্তাহীনতা যতটা সম্ভব দূর করার চেষ্টা করা। অথচ বাংলাদেশে সরকার আগের অনেক ঘটনার বিচার করেনি, করলে হয়তো কিছু ঘটনা এড়ানো যেত।
হিন্দু জনসংখ্যা কমার প্রবণতা
স্বাধীন দেশে প্রথম আদমশুমারি হয় ১৯৭৪ সালে। তখন হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ। এরপর আরও চারটি আদমশুমারি হয়েছে। সর্বশেষ ২০১১ সালের আদমশুমারিতে দেখা গেছে, দেশের মোট জনসংখ্যার ৮ দশমিক ৫ শতাংশ হিন্দু।
দেশ ভাগের আগে ব্রিটিশ ভারতের ১৯৪১ সালের আদমশুমারিতে পূর্ববাংলার (বর্তমান বাংলাদেশ) হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ২৮ শতাংশ। ১০ বছর পরে অর্থাৎ ১৯৫১ সালে পাকিস্তানের প্রথম আদমশুমারিতে হিন্দু কমে ২২ শতাংশে দাঁড়ায়। এর মধ্যে ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের কারণে অনেক হিন্দু দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান। ভারত থেকেও অনেক মুসলমান পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশে চলে আসেন। এই দেশান্তর জনসংখ্যার অনুপাতে প্রভাব ফেলে।
এরও আগে বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যা কমার প্রবণতা ছিল। ১৯০১ সালের আদমশুমারিতে বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ৩৩ শতাংশ। এরপর প্রতি ১০ বছর পর পরিচালিত আদমশুমারিতে এই হার কমতে দেখা গেছে। অর্থাৎ এই প্রবণতা ১০০ বছরের বেশি পুরোনো।
২০০১ সালের আদমশুমারির বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ ভাগ হওয়া, ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধ এ দেশে হিন্দু জনসংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ।
কারণ
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ২০১১ সালের আদমশুমারি ও গৃহগণনা প্রতিবেদনে দেশে হিন্দু জনসংখ্যা কমে যাওয়ার দুটি কারণ উল্লেখ করেছে। প্রথমত, হিন্দুরা দেশ ছাড়ছে। দ্বিতীয়ত, হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যে মোট প্রজনন হার বা টোটাল ফার্টিলিটি রেট তুলনামূলক কম। অর্থাৎ হিন্দু দম্পতিরা তুলনামূলকভাবে কম সন্তান জন্ম দেন।
সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে ধর্মীয় জনগোষ্ঠীভিত্তিক প্রজনন হারের কোনো তথ্য বা পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। তবে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশসহ (আইসিডিডিআরবি) তিনটি প্রতিষ্ঠানের একদল গবেষক দেশের একটি ছোট এলাকার জনমিতি বিশ্লেষণ করে বলছেন, দেশত্যাগ ও প্রজনন হার কম হওয়া ছাড়াও হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যে নবজাতক মৃত্যুহার তুলনামূলকভাবে সামান্য বেশি।
ওই গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি হাজার জনসংখ্যায় হিন্দু জনগোষ্ঠী বৃদ্ধির হার মুসলমানের চেয়ে ২ পয়েন্ট কম। তিন বছরে একজন মুসলমান নারীর সন্তান জন্ম দেওয়ার সম্ভাবনা যেখানে ৩৫ শতাংশ, হিন্দু নারীদের মধ্যে তা ৩২ শতাংশ।
গবেষণায় দেখা গেছে, হিন্দুদের মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণের সামগ্রী ব্যবহারের হার বেশি। তাদের মধ্যে গর্ভপাত করানোর হারও বেশি। দুটির পর আর সন্তান নিতে না চাওয়া নারীর হার হিন্দুদের মধ্যে বেশি। মুসলমানদের মধ্যে কম বয়সে বিয়ের প্রবণতা বেশি। এ ধরনের আরও কিছু সূচক বিশ্লেষণ করে গবেষকেরা বলছেন, হিন্দুদের প্রজনন হার তুলনামূলকভাবে কিছুটা কম।
হিন্দুদের মধ্যে মৃত্যুহারও সামান্য বেশি। গবেষকেরা তথ্য বিশ্লেষণ করে বলছেন, মতলবে প্রতি ১০ হাজার জনের মধ্যে মুসলমানদের চেয়ে হিন্দুদের ৪টি মৃত্যু বেশি।
গবেষকেরা বলছেন, ১৯৮৯ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে হিন্দুদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার মুসলমানদের তুলনায় যতটুকু কম ছিল, তার ৫৪ শতাংশ আন্তর্জাতিক অভিবাসন বা দেশ ছাড়ার কারণে, ৪১ শতাংশ প্রজনন হার কম হওয়ার জন্য এবং বাকি ৫ শতাংশ মৃত্যুহার বেশি হওয়ার কারণে। তাঁরা আরও বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অভিবাসনের চেয়ে প্রজননের হারই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
তবে দেশে হিন্দু জনসংখ্যা কমে যাওয়ার প্রধান কারণ দেশত্যাগ। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগের বিষয় নিয়ে তিন দশকের বেশি সময় ধরে গবেষণা করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবুল বারকাত এ প্রসঙ্গে বলেন, কোনো মানুষ নিজের মাতৃভূমি, নিজের বাড়িঘর, ভিটামাটি ছেড়ে অন্য দেশে যেতে চান না। অত্যাচারের কারণে বাংলাদেশের হিন্দুরা দেশ ছাড়ছেন, তাদের সংখ্যা দ্রুত কমছে। শত্রু (অর্পিত) সম্পত্তি আইনের কারণে অনেকে নিঃস্ব হয়ে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। এটা বেশি ঘটেছে গ্রামের দুর্বল হিন্দুদের ক্ষেত্রে। কারণ আরও আছে।
অসাম্প্রদায়িক চেতনার মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে জন্ম নেওয়া স্বাধীন বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উপর রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রথম আঘাতটি আসে ১৯৭৭ সালে। যখন মূলত পঞ্চম সংশোধনী অনুমোদনের মাধ্যমে সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। এর ১১ বছর পর ১৯৮৮ সালের জুনে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সংগঠন এই ঘোষণার বিরোধিতা করেছিল। দুটি ঘটনা সামরিক সরকারের আমলে হলেও পরবর্তীকালে কোনো গণতান্ত্রিক সরকার রাষ্ট্রীয় আদর্শকে অসাম্প্রদায়িক অবস্থানে ফিরিয়ে নেয়নি।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯৫০
আপনার মতামত জানানঃ