বিশ্বব্যাংকের হিসাব জানাচ্ছে, বাংলাদেশে এখন প্রতিবছর চার লাখ মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসছেন স্থায়ীভাবে৷ এই সংখ্যা প্রতিদিন দুই হাজারের মতো৷ তাদের মধ্যে শতকরা ৭০ ভাগ মানুষ উদ্বাস্তু৷
বর্তমানে পৃথিবীর আলোচিত এবং সংকটময় বিষয়গুলোর মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন অন্যতম প্রধান। যুক্তরাজ্যে দাবদাহ, অস্ট্রেলিয়ার দাবানল থেকে মস্কোতে তুষারপাতের অনুপস্থিতি অথবা চীন ও জার্মানিতে মারাত্মক বন্যা- প্রতিদিনের এইসব সংবাদ শিরোনাম আমাদের জলবায়ু পরিবর্তনের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ আজ আগের থেকেও অনেক বেশি শক্তিশালী।
জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীব্যাপী বাড়ছে তাপমাত্রা। আর তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তন ঘটছে। এ কারণে বিপদ সীমা অতিক্রম করছে সমুদ্র ও নদীর পানির উচ্চতা। তলিয়ে যাচ্ছে নিম্নাঞ্চল। ফলে, বসতবাড়ি ছেড়ে বাস্তুচ্যুত হতে বাধ্য হচ্ছে কোটি কোটি মানুষ।
বিশ্বব্যাংকের একটি সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আগামী তিন দশকে ২১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হবে। অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে বিশ্বজুড়ে কার্বন নিঃসরণ কমানো এবং সম্পদের ব্যবধান কমিয়ে আনার মতো জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে বলে সতর্ক করেছে বিশ্বব্যাংক। তবে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এ সমস্যা উন্নত বিশ্বের তুলনায় ভিন্নতর এবং আরও জটিল।
উদ্বাস্তু বাড়ছে বাংলাদেশে
বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ২০৫০ সাল নাগাদ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার এক কোটি ৩৩ লাখ মানুষ বাসস্থান হারাবেন৷ বিশ্বব্যাংকের হিসাব জানাচ্ছে, বাংলাদেশে এখন প্রতিবছর চার লাখ মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসছেন স্থায়ীভাবে৷ এই সংখ্যা প্রতিদিন দুই হাজারের মতো৷ তাদের মধ্যে শতকরা ৭০ ভাগ মানুষ উদ্বাস্তু৷
পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সম্প্রতি এক ভার্চুয়াল সেমিনারে বলেছেন, ‘‘বাংলাদেশের এক কোটি মানুষ এরইমধ্যে জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছেন৷ সমূদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, নদীর পানির লবণাক্ততা বাড়া, নদী ভাঙ্গন এবং ঝড়, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে যাওয়ার অভিঘাতে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে৷’’
আগামী কয়েক বছরে আমরা যা করব তার প্রভাব শত শত বছর ধরে থাকবে। মাত্র ১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে একটি উষ্ণ বিশ্বের বিপর্যয়কর প্রভাব আমরা প্রত্যক্ষ করেছি; কিন্তু এই উষ্ণতা বৃদ্ধি যদি ২ বা ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে গিয়ে পৌঁছায়, তাহলে কী ঘটবে?
পরিবেশবিদ ও জলবায়ু পণ্ডিত বিল ম্যাককিবেন জলবায়ু বিষয়ে বলেছেন, ‘ধীরে ধীরে জেতাও হেরে যাওয়ার সমান।’ তাই ধীরে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো ভুল এখানে করা যাবে না।
যে কারণে উদ্বাস্তু হচ্ছে মানুষ
বাংলাদেশের দক্ষিণের জেলা বাগেরহাটের মোংলা উপজেলার বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) আহ্বায়ক নুর আলম শেখ বলেন, ‘‘লবনাক্ততা বাড়ছে৷ বাড়ছে নদী ভাঙন৷ যা প্রাণ ও প্রকৃতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে৷ কৃষি নির্ভর এলাকার মানুষ কাজ হারিয়ে শহরে যাচ্ছেন কাজের খোঁজে৷ কেউ যাচ্ছেন একা আবার কেউ সপরিবারে৷ তারা শুধু ঢাকা নয় অন্য শহরেও যাচ্ছেন কাজের খোঁজে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘শুধু গরিব মানুষ নন, ধনীরাও এর শিকার হচ্ছেন৷ খাবার পানির সংকট সবাইকে বিপর্যস্ত করছে৷ লবণ পানির কারণে এই এলাকায় প্রতি তিনজনে একজন উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন৷ জলবায়ু উদ্বাস্তু হয়ে মানুষ এলাকা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন৷’’
বাংলাদেশ মূলত একটি গ্রাউন্ড-জিরো দেশ হিসেবে নিজের কোন দোষ ছাড়াই জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার। এটি বিপুল জনসংখ্যার দেশ, দক্ষিণে সাগরবিধৌত। জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্যানেল ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) বলছে, ২০৫০ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা যদি ১ মিটার বাড়ে, তাহলে বাংলাদেশের অন্তত ১৭ শতাংশ ভূমি সমুদ্রগর্ভে বিলীন হবার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে, ভূমিহীন ও জলবায়ু উদ্বাস্তু হয়ে পড়বে বিপুল সংখ্যক মানুষ। ফলে একদিকে যেমন জনসংখ্যার ঘনত্ব বেড়ে যাবে তেমনই উদ্বাস্তু সমস্যা দেশীয় সীমা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক রূপ নিতে পারে।
এই নিয়ে বিশ্বব্যাংকের অন্য একটি সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় জলবায়ু অভিবাসীর অর্ধেকই হবে বাংলাদেশ থেকে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবনাক্ততা বৃদ্ধি, নদী ভাঙন, বন্যা ও খরার প্রভাব ছাড়াও ১১ লাখ রোহিঙ্গা জোরপূর্বক মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হওয়ার কারণে বাংলাদেশ গুরুতর জলবায়ু প্রভাবের সম্মুখীন হচ্ছে। জরুরি উদ্যোগ এবং কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে বন্যা ও ফসলের উৎপাদন নষ্ট হয়ে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশর প্রায় দুই কোটি মানুষ অভিবাসী হওয়ার ঝুঁকিতে যাবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫০৮
আপনার মতামত জানানঃ