বাংলাদেশের সুন্নী মুসলমান মৌলবাদীরা হিন্দুদের উপর যে আগ্রাসন শুরু করেছে- হিন্দুদের মন্দির, প্রতিমা, ঘর-বাড়ি এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর ও লুটপাট, খুন-ধর্ষণ করছে; এটাকে সন্দেহের চোখে দেখছে পশ্চিমবঙ্গের কোনো কোনো হিন্দু বুদ্ধিজীবী এবং সাধারণ মানুষ। তাদের ধারণা বিজেপি উত্তর প্রদেশের আগামী নির্বাচন এবং বিভিন্ন জায়গায় উপ-নির্বাচন উপলক্ষে ষড়যন্ত্র করে এগুলো করাচ্ছে নির্বাচনে সুবিধা পাওয়ার জন্য। এই বিষয়ে তারা ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছে এবং মন্তব্য করছে, খুব বাহবা পাচ্ছে পশ্চিবঙ্গের মুসলমানদের কাছ থেকে, মুসলমানরা উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে এগুলো শেয়ার করছে। পশ্চিমবঙ্গের একজন ব্রাহ্মণ দেখলাম লিখেছে- বাংলাদেশের হিন্দুদের দোষ আছে, তারা ধোয়া তুলশী পাতা নয়। কী দোষ করেছে বাংলাদেশের হিন্দুরা? নিজের ধর্ম পালন করা দোষের?
আমি ভাবছি- যে হিন্দুর রাজনৈতিক জ্ঞান এইরকম নির্বোধ পর্যায়ের, ইতিহাস জ্ঞানহীন, উন্নাসিক; তাদের ধ্বংস অনিবার্য। কী ভয়াবহ আত্মঘাতী এদের বিদ্যা! যে পতঙ্গ আগুনে ঝাঁপায়, তারে বাঁচায় সাধ্য কার? বাঙালী হিন্দু নিজেরা নিজেরা অন্তর্কোন্দলে জর্জরিত, একজন আরেকজনের বিপদে পাশে দাঁড়ায় না বরং আরো বিপদে ঠেলে দেয়, তারা সংগঠিত নয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ-প্রতিরোধে তারা নেই। মুহাম্মদ বিন কাশিম যখন দেবলে (করাচি) হামলা চালিয়েছিল, তখন প্রতিবেশী কোনো রাজা দেবলের রাজা দাহিরের পাশে দাঁড়াননি। তারা ভেবেছিলেন- ‘ব্যাটা ব্রাহ্মণ হয়ে রাজা হয়েছে, যবনের হাতে ধ্বংস হয় হোক। যবন তো আর আমাদের আক্রমণ করছে না!’ বস্তুত পরবর্তীকালে যবনের হাত থেকে পার্শ্ববর্তী কোনো রাজা ও রাজ্যই রক্ষা পায়নি। কারণ, অন্তর্কোন্দলের কারণে সব রাজ্য একত্রিত হয়ে সাম্রাজ্যবাদী মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে পারেনি।
হিন্দুদের ওপর মুসলমানদের হামলার মধ্যে যারা বিজেপি’র ষড়যন্ত্র দেখতে পাছে, তাদের কাছে আমার প্রশ্ন- ৭১২ সালে তো বিজেপি ছিল না, কোন ষড়যন্ত্রের ফলে মুহাম্মদ বিন কাশিম দেবল বন্দরে হামলা চালিয়েছিল, গুঁড়িয়ে দিয়েছিল দেবলের মন্দির, নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল, রাজা দাহিরের কাটা মুণ্ড, পুরুষদের দাস এবং নারীদেরকে যৌনদাসী করে বাগবাদাদের সম্রাটের কাছে পাঠিয়েছিল?
সুলতান মুহাম্মদ কোন ষড়যন্ত্রের ফলে সতেরো বার সোমনাথ মন্দিরে হামলা করেছিল? ধর্ষণ-লুণ্ঠন করে জনপদ গুঁড়িয়ে দিয়েছিল?
মুহাম্মদ ঘোরী কোন ষড়যন্ত্রের ফলে পৃথ্বিরাজ চৌহানের রাজ্যে হামলা করেছিল? প্রথমবার পৃথ্বিরাজ চৌহানের কাছে পরাজিত হয় ঘোরী, পৃথ্বিরাজ তাকে ক্ষমা করে দেন, পরবর্তীতে আবার সংগঠিত হয়ে ঘোরী হামলা চালায় এবং পৃথ্বিরাজকে পরাজিত করে, পৃথ্বিরাজের চোখ উপড়ে ফেলে তাকে হত্যা করে। কোন ষড়যন্ত্রের ফলে এসব করেছিল ঘোরী?
ইখতিয়ার উদ্দীন বখতিয়ার খিলজী কোন ষড়যন্ত্রের ফলে নদীয়া আক্রমণ এবং দখল করেছিল; নালন্দা, বিক্রমশীল, পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের ছাত্র-শিক্ষকদের হত্যা করে বিহারগুলো পুড়িয়ে দিয়েছিল?
কোন ষড়যন্ত্রের ফলে সম্রাট আওরঙ্গজেব হিন্দুদের ওপর গণহত্যা চালিয়েছিল? ধর্ষণ, ধর্মান্তর করেছিল? মন্দিরের প্রতিমা ভেঙে মসজিদের সিঁড়ির নিচে দিয়েছিল যাতে করে নামাজীরা তা মাড়িয়ে নামাজ পড়তে যেতে পারে। কোন ষড়যন্ত্রের ফলে?
কোন ষড়যন্ত্রের ফলে সুফীদের ইন্দনে সুলতান এবং মোগল শাসকরা বারবার হিন্দুদের ওপর গণহত্যা, ধর্মান্তর, ধর্ষণ-লুণ্ঠণ করেছিল?
ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে একটু ভাবা দরকার, নিজের বোধকে জাগ্রত করে নিজেকে প্রশ্ন করা দরকার যে ভিন্নমত, ভিন্ন ধর্মের ওপর মুসলমানদের এই হামলা অন্যদের ষড়যন্ত্র, নাকি আরব্য সংস্কৃতি?
পশ্চিমবঙ্গের এই উন্নাসিক প্রজন্ম জানে না যে বাংলাদেশের সুন্নী ইসলামী মৌলবাদীদের পেটের ভাত হজম হয় না প্রতিদিন ভারতকে, ভারতের সংস্কৃতিকে, ভারতের মানুষকে গালি না দিলে। অথচ এরাই নাকি বিজেপি’র সঙ্গে হাত মিলিয়েছে! পশ্চিমবঙ্গের এই উন্নাসিক প্রজন্ম জানে না যে বাংলাদেশে সুন্নী ইসলামী মৌলবাদের শিকড় কতোটা গভীরে প্রোথিত। এই দেশে একজন নারী শুধুমাত্র কপালে একটি লাল টিপ করার কারণে মুসলমান মৌলবাদীদের দ্বারা সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়, ধর্ষণের হুমকি পায়! কোনো নারী একটু আধুনিক পোশাক পরলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে! রোজার দিনে পেটে ক্ষুধা নিয়ে ঘুরতে হয়! নামাজ না পড়লে বাড়িতে গিয়ে হুমকি দেওয়া হয়! এই দেশের আবহমানকালের বাংলার সংস্কৃতি- যাত্রাপালা, পালাগান, বাউলগান ইত্যাদি আজ বিপন্ন হতে চলেছে মৌলবাদীদের হুমকির মুখে। মৌলবাদীরা কতো বাউলকে যে মারধর করেছে, বাউলদের চুল কেটে দিয়েছে, বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে, তার কোনো হিসেব নেই। মুসলমান মৌলবাদীরা কাউকে পরোয়া করে না, তারা ভয়-ডরহীন। তারা জানে যে জিহাদ করতে গিয়ে মারা গেলে তারা বেহেশ্তে যাবে! বেহেশ্তের লোভ তাদেরকে উন্মাদ করে তুলেছে। আর বেঁচে থাকলে তারা হিন্দুদের বাড়ি-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লুণ্ঠনের মাল পাবে। বাঁচলেও লাভ, মরলেও লাভ!
পশ্চিমবঙ্গের আত্মঘাতী প্রজন্মটি এসবের খবর রাখে না। এই যে বাংলাদেশে প্রতিবছর মুসলমান মৌলবাদীরা হিন্দুদের ওপর ব্যাপক হারে নির্যাতন করে, পশ্চিমবঙ্গের বেশিরভাগ মানুষ এসবের খবর রাখে না অথবা নির্লিপ্ত থাকে। তথাকথিত আধুনিক চিন্তার মানুষেরা ভাবে নির্যাতিত হিন্দুদের পাশে দাঁড়ালে তাদের মুসলমান বন্ধুরা কষ্ট পেতে পারে! তাদের গায়ে সাম্প্রদায়িক তকমা লেগে যেতে পারে! এরা নির্যাতিত মানুষের ধর্ম দেখে প্রতিবাদ করে! আহারে অসাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি! কেউ কেউ বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক হামলা নিয়ে বলতে গিয়ে টেনে আনছে কবে কোথায় ভারতে মুসলমানদের ওপর নির্যাতন হয়েছে, দুই দেশের মৌলবাদীদের একই পাল্লায় তুলে তারা বাংলাদেশের মৌলবাদীদের হামলা-নির্যাতনের ঘটনা লঘু করায় ব্যস্ত। অবশ্যই ভারতে মুসলমানদের ওপর হিন্দু মৌলবাদীদের হামলা ন্যাক্কারজনক। কিন্তু তুলনা করে বাংলাদেশের ঘটনা হালকা চোখে দেখতে হবে কেন? আর তুলনায় যদি যেতেই হয় তবে বলা যায় বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর যে নির্যাতন মুসলমানরা করে, তার ২ শতাংশও ভারতের হিন্দুরা মুসলমানদের ওপর করতে পারে না। কারণ, ভারতের মুসলমানরা প্রতিবাদ করতে জানে, লাঠি-তরোবারি ধরতে জানে, ধর্মের জন্য তারা জীবন দিতে জানে। বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেক জেলায় এরই মধ্যে হামলা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে, এটা ভারতে কল্পনা করা যায়? কি বলেন তুলনাকারী বাটখারাধারীরা?
আমরা বাংলাদেশের মানুষ এখন যে জীবন যাপন করছি তা মানুষের জীবন নয়। ক্রমশ আমাদের সাংস্কৃতিক চর্চার গণ্ডি ক্ষুদ্র হয়ে আসছে। যারা সংস্কৃতির চর্চা করেন বিপুল সংখ্যক লোকজন তাদেরকে ঘৃণা করে, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে মারধরও। ফলে মানুষ এখন সংস্কৃতিবিমুখ হয়ে পড়ছে, সংস্কৃতির কোনো প্রভাব নেই সমাজে। সংস্কৃতিহীন মানুষ অর্ধ জানোয়ার! আমরাও এখন তাই। পশ্চিমবঙ্গে এর ছোঁয়া লাগবে অদূর ভবিষ্যতে।
পশ্চিমবঙ্গের এই উন্নাসিক প্রজন্মটির অনেকেরই শিকড় বাংলাদেশে প্রোথিত ছিল, তাদের পূর্ব-পুরুষ নির্যাতনের শিকার হয়ে ভারতে গেছে। এই প্রজন্মটি সেই ক্ষত’র জ্বালা অনুধাবন করতে পুরোপুরি ব্যর্থ। আর যারা ঘটি তাদের বেশিরভাগেরই ব্যথা-বেদনার কোনো বালাই নেই! তাই তারা অবলীলায় শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে গালাগালি দেয় বাংলা ভাগের জন্য দায়ী করে, যদিও পাকিস্তান ভাগের জন্য জিন্নাকে কিংবা যাদের পূর্বপুরুষেরা বলেছিল- ‘হাত মে বিড়ি মুখ মে পান/ লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ তাদের দোষ দেখতে পায় না। এই যে আজকে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুরা যতোটুকু শান্তিতে আছে, রাতে একটু শান্তিতে ঘুমাতে পারছে, এই শান্তিটুকু তাদেরকে দিয়ে গেছেন শ্যামাপ্রসাদ। নইলে দুই বাংলা একত্রিত হয়ে বাংলাদেশ হলে তাদের অবস্থাও হতো বাংলাদেশের হিন্দুদের মতো নিজভূমে পরবাসী। এখন তো তবু বাংলাদেশের হিন্দুরা পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে ঠাঁই পায়, সমগ্র বাংলা নিয়ে বাংলাদেশ হলে সেই জায়গাটুকুও থাকতো না।
পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুরা তাদের উন্নাসিকতার মধ্য দিয়ে নিজেদের ভবিষ্যৎ ক্রমশ বিপজ্জনক-বিপন্ন করে তুলছে। এখনই পশ্চিমবঙ্গের অনেক জায়গায় হিন্দুরা মুসলমানদের নির্যাতনের শিকার হয়, মুসলমানদের সংখ্যাটা আরেকটু বাড়লেই ভিটে-মাটি হারাতে শুরু করবে। কিন্তু অবাঙালী হিন্দুরা তো এই বিপুল সংখ্যক বাঙালী হিন্দুর আশ্রয়দাতা হবে না, তারা লাথি দিয়ে তাড়িয়ে দেবে। তখন কোথায় হবে বাঙালী হিন্দুর ঠিকানা? ঝাড়খণ্ড, বিহার, উড়িষ্যার বন-জঙ্গল? নাকি ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়ে বাংলাতেই?
আপনার মতামত জানানঃ