বাংলাদেশে দরিদ্র প্রায় ৬ কোটি, অথচ গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) সহ বিভিন্ন বিদেশি সংস্থার হিসেবে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৮-৯ বিলিয়ন ডলার অবৈধভাবে পাচার হচ্ছে বলে দাবি করা হলেও প্রকৃত হিসাবে এর পরিমাণ আরও বেশি হবে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সূত্র মতে, পাচার হওয়া টাকার ৮০ শতাংশ ঘটছে আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যে ওভার ইনভয়েজিং আর আন্ডার ইনভয়েজিংয়ের মাধ্যমে। বাণিজ্যের বাইরে প্রভাবশালীদের দুর্নীতির মাধ্যমে আয় করে পাচার হওয়া অর্থ যোগ করলে এর পরিমাণ ১৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হতে পারে।
শনিবার সন্ধ্যায় ইকোনমিকস স্টাডি সেন্টার এবং ইএমকে সেন্টারের যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত এক আলোচনা সভায় এ তথ্য উঠে আসে।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেছেন, গণতন্ত্র ও সুশাসনের অভাব, আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়া, আর রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে প্রতি বছর দেশ থেকে বিপুল পরিমাণে অর্থ পাচার হচ্ছে। এর ফলে সরকারের রাজস্ব কর আহরণ কমে আসায় সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে প্রত্যাশিত বরাদ্দ দেওয়া যাচ্ছে না।
অনুষ্ঠানে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “ব্যবসায়ীরা আমদানি-রপ্তানিতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে যে অর্থ পাচার করেন তার পরিমাণ বছরে ৮-৯ বিলিয়ন ডলার। এর বাইরে রাজনৈতিক প্রভাবশালী আর দুর্নীতিবাজদের অর্থ যোগ করলে এর পরিমাণ ১২-১৫ বিলিয়ন ডলার হবে”।
তিনি বলেন, “বেশিরভাগ রাজনৈতিক প্রভাবশালীই কানাডার বেগমপাড়া কিংবা মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম প্রোগ্রামে অর্থ পাচার করছে”।
তিনি বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংক, এটর্নি জেনারেলের কার্যালয়সহ সরকারের সংস্থাগুলো সমন্বিত উদ্যোগ নিলে পাচার প্রতিরোধ করে উল্টো পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা সম্ভব। সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার কারণে ২০১২ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ছেলের পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনা সম্ভব হয়েছে।
তিনি মনে করেন, আইনি কাঠামো আরও শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও সরকারের ইচ্ছা না থাকায় পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার নতুন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। তিনি বলেন, বাংলাদেশে কাজ করা বিদেশি লোকজন তাদের আয়ের বড় একটা অংশই পাচার করছেন। এর পরিমাণ বছরে ২ বিলিয়ন ডলার। আবার বাংলাদেশি শ্রমিকদের বিদেশ যেতে ভিসার জন্য টাকা পরিশোধের নিয়ম না থাকলেও এ খাতে বছরে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি পাচার হচ্ছে। এ সব ঘটনা গুরুত্ব দিয়ে দেখার পরামর্শ দেন তিনি।
ড. ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, ঋণখেলাপি, জালিয়াতি, প্রতারণাসহ বিভিন্নভাবে অর্থ পাচারের কথা সংবাদ মাধ্যমে আসছে। সরকারের পক্ষ থেকে এসবে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
বাংলাদেশ থেকে কী পরিমাণ অর্থ পাচার হয়, সে বিষয়ে ধারণা পেতে আমরা একটু পেছনে ফিরে তাকাতে পারি। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) এর এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০০৬ থেকে ২০১৫ সাল অব্দি বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ৬ হাজার ৩০৯ কোটি ডলার বা ৫ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এটি আনুমানিক হিসাব। প্রকৃত পাচারের পরিমাণ আরও বেশি হতে পারে।
এদিকে, সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি) এর ‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড ২০১৭’ শীর্ষক বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে জানা গিয়েছিল, সুইস ব্যাংকে ২০১৭ সালে বাংলাদেশি নাগরিকদের জমার পরিমাণ ছিল ৪৮ কোটি ১৩ লাখ সুইস ফ্রাঁ। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় ৪ হাজার ৬৮ কোটি টাকা (১ সুইস ফ্রাঁ = সাড়ে ৮৪ টাকা হিসাবে)। ২০২০ সাল শেষে দেশটির ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ৫৬ কোটি ২৯ লাখ সুইস।
বাংলাদেশের নিয়ম অনুযায়ী যে কোনো ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন অন্তত ৫০০ কোটি টাকা হতে হয়৷ সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের যে টাকা এখন জমা আছে, তা অন্তত ১০টি ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধনের সমান৷
বেকার ও দারিদ্রতা বাড়ছে
পিপিআরসি ও ব্র্যাকের সাম্প্রতিক গবেষণা জরিপ বলছে, করোনার এক বছরে দেশের প্রায় ১৫ শতাংশ মানুষের জীবনমান নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে, সংখ্যায় তা প্রায় ২ কোটি ৪৫ লাখ। করোনার আগে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমে সাড়ে তিন কোটিতে নেমে এসেছিল। সংস্থা দুটির প্রাক্কলন বিবেচনায় নিলে এখন দরিদ্রের সংখ্যা প্রায় ছয় কোটি।
এর পাশাপাশি বাড়ছে বেকারত্ব। গবেষণা সংস্থা বিআইডিএসের এক জরিপে উঠে এসেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৬৬ শতাংশ বেকার।
বাংলাদেশে বর্তমানে মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি ৪৬ লাখ। এর মধ্যে ৪৯ শতাংশ তরুণ, যাদের বয়স ২৪ বছর বা এর নিচে। আর কর্মক্ষম জনসংখ্যা ১০ কোটি ৫৬ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার ৬৬ শতাংশ এবং তাদের সবার বয়স ১৫ থেকে ৬৪ বছরের মধ্যে। দেশের এ জনসংখ্যা নিঃসন্দেহে দেশের সম্পদ।
এটি যে কোনো দেশের জন্য ভালো খবর। কিন্তু হতাশার ব্যাপার হল, এ বিশাল জনশক্তির অধিকাংশই বেকার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে বর্তমান অশিক্ষিত বেকার যুবকের সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ। আর শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৪ লাখ।
কেন এই অর্থ পাচার?
বিশ্লেষকদের মতে, দেশে ব্যাপক অবৈধ আয়ের সুযোগ আছে৷ অবৈধ আয়ের সুযোগ বন্ধ না করে অর্থ পাচার বন্ধ করা কঠিন৷ অর্থ পাচার বেআইনি৷ মানি লন্ডারিং আইনে তা ধরে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ আছে৷ আর বিদেশি ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশি অ্যাকাউন্ট হোল্ডারদের তথ্য জানতে সরকারি পর্যায়ে চুক্তি করতে হবে৷ আর তা না করা গেলে বাংলাদেশ বিপূল পরিমান অর্থ হারাবে৷ ট্যাক্স হারাবে৷ বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে৷
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, টাকা পাচারের বিষয়টি গভীর উদ্বেগজনক। কারণ সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের যে টাকা রাখা হয়েছে, সেটা মূলত দুর্নীতির।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের মূলত তিনটি কারণ। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে দুর্নীতি। দুর্নীতি বেড়েছে বলেই অর্থ পাচারও বেড়েছে। এছাড়া দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ না থাকা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার কারণেও অর্থ পাচার বাড়ছে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) -এর অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘‘বৈধ পথে ৩ হাজার ডলারের বেশি অর্থ দেশের বাইরে নেয়ার সুযোগ না থাকায় চিকিৎসা, শিক্ষাসহ ব্যক্তিগত প্রয়োজন মেটানোর জন্য এক শ্রেণির নাগরিক অবৈধভাবে অর্থ পাচার করেন৷ আবার কেউ বৈধভাবে আয় করছেন, কিন্তু দেশের বাইরে বিনিয়োগ করতে চান৷ সুযোগ না থাকায় তারা পাচার করেন৷”
তিনি বলেন, “আরেক শ্রেণি আছে, যারা দেশে বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থ আয় করেন৷ তারা সেই অর্থ নিরাপদ রাখতে দেশের বাইরে পাচার করেন বা বিনিয়োগ করেন৷ প্রথম দুই শ্রেণির জন্য সরকার ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে পারে৷ আইনের আওতায় সুযোগ দেয়া যায় কিনা ভাবতে পারে৷ কিন্তু তৃতীয় পক্ষ দেশের জন্য ক্ষতিকর৷ তাদের আয় অবৈধ এবং তারা পাচার করে দেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে৷”
তিনি বলেন, ‘‘এই অবৈধ আয়ধারী অর্থ পাচারকারীদের আমরা চিনি, কিন্তু নাম বলি না৷ আমার জানা মতে, বাংলাদেশ থেকে সিঙ্গাপুরে এখন বড় একটি বিনিয়োগ হচ্ছে অবৈধ অর্থ পাচারের মাধ্যামে৷ যারা এটা করছেন, তাদের একটি টেলিভিশন চ্যানেলও আছে৷’”
ড. নাজনীন আরো বলেন, ‘‘অবৈধ অর্থ দেশের বাইরে পাচার করে সুইস ব্যাংকসহ বিভিন্ন বিদেশি ব্যাংকে জমা রাখা হয়৷ আর ওইসব ব্যাংক ক্লায়েন্টের তথ্য গোপন রাখে৷ কেউ বাড়ি কেনেন, কেউবা বিনিয়োগও করেন।”
আইন আছে প্রয়োগ নেই
অর্থ পাচার রোধে দেশে প্রয়োজনীয় আইন রয়েছে। আইনে পাচারকারীর দ্বিগুণ জরিমানা, ৪ থেকে ১২ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং সম্পদ বাজেয়াপ্তের বিধান আছে। কিন্তু আইন প্রয়োগের দৃষ্টান্ত নেই বললেই চলে। ফলে দেশ থেকে অর্থ পাচার ঠেকানো যাচ্ছে না।
জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনডিপি, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিক সংগঠন আইসিআইজে প্রকাশিত পানামা ও প্যারাডাইস পেপার্স এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে নিয়মিত অর্থ পাচারের তথ্য আসছে। কিন্তু হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াচ্ছেন পাচারকারীরা। তাদের মধ্যে সংসদ সদস্য, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা, ঠিকাদার এবং দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তারা রয়েছেন। এরা এতটাই প্রভাবশালী যে কেউ তাদের কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না।
অন্যদিকে পাচার রোধে যে সব সংস্থা কাজ করছে, তাদের মধ্যেই প্রয়োজনীয় সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। সবমিলিয়ে অর্থ পাচার রোধ এবং আগে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনাতে তেমন আশার আলো নেই। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অর্থনীতিবিদরা ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাচার রোধে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি। এক্ষেত্রে চিহ্নিতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মাধ্যমে কঠোর বার্তা দিতে হবে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, দেশে একটি অদ্ভুত পরিস্থিতি বিরাজ করছে। একদিকে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ নেই। অপরদিকে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কী কারণে এটি হচ্ছে, তা বোঝা দরকার।
তিনি বলেন, এ টাকা পাচারের কয়েকটি কারণ হতে পারে। যেমন তারা বিনিয়োগের পরিবেশ পাচ্ছে না। দ্বিতীয়ত প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় টিকে থাকতে পারছে না। অথবা বাংলাদেশের ভবিষ্যতের প্রতি তাদের আস্থা নেই। তার মতে, উচ্চবিত্তরা দেশে টাকা রাখে না। এটি অত্যন্ত দুশ্চিন্তার বিষয়। তিনি এ ধরনের কাজ আইনের আওতায় না এনে প্রশ্রয় দেওয়া হয়। এতে পাচার বাড়তে থাকবে।
জানা গেছে, অর্থ সংক্রান্ত অপরাধ ঠেকাতে সরকার এ সংক্রান্ত আইন আধুনিকায়ন করেছে। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ নামে এটি পরিচিত। এই আইনের ৪(২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি মানি লন্ডারিং বা মানি লন্ডারিং অপরাধ সংঘটনের চেষ্টা, সহায়তা বা ষড়যন্ত্র করিলে তিনি অন্যূন ৪ (চার) বৎসর এবং অনধিক ১২ (বার) বৎসর পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির দ্বিগুণ মূল্যের সমপরিমাণ অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’
আইনের ১৭(১) ধারায় বলা আছে, ‘এই আইনের অধীন কোনো ব্যক্তি বা সত্তা মানি লন্ডারিং অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইলে আদালত অপরাধের সহিত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত দেশে বা দেশের বাহিরে অবস্থিত যে কোনো সম্পত্তি রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করিবার আদেশ প্রদান করিতে পারিবে।’ কিন্তু আইনটির কার্যকর প্রয়োগের অভাবে পাচার বাড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এসডব্লিউ/এসএস/১২৩৩
আপনার মতামত জানানঃ