বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের ওপর সাম্প্রতিক হামলার ঘটনায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যজুড়ে সংখ্যালঘু মুসলিমরা উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশের একের পর এক ঘটনা বিচলিত করেছে পশ্চিমবঙ্গের প্রগতিশীল মহলকে৷ এই মহলের একটা উল্লখযোগ্য অংশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষেরা৷ তারা দ্বিধাহীন কন্ঠে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের নিন্দা করেছেন৷ বাংলাদেশ সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন, অপরাধীদের পাকড়াও করে শাস্তি দেওয়া হোক৷
‘বেঙ্গল ইমাম অ্যাসোসিয়েশন’ এক বিবৃতিতে এই হামলাকে ‘ইসলামবিরোধী’ তকমা দিয়ে বলেছে, ‘ভারতের সংখ্যালঘু হিসেবে আমরা বুঝতে পারছি আমাদের হিন্দু ভাই-বোনেরা কী অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন৷’
বাংলার যৌথ জীবনের পরম্পরায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে কয়েকটি নাম৷ এর মধ্যে অন্যতম মুর্শিদাবাদের কান্দির প্রাক্তন বিধায়ক সফিউল আলম খান ওরফে বনু খান৷ তিনি প্রতি বছর দুর্গামূর্তি গড়েন৷ বাংলাদেশের কুমিল্লা, চট্টগ্রাম সহ বিভিন্ন জেলায় সেই প্রতিমাকে আক্রান্ত হতে দেখে কংগ্রেস নেতার হৃদয় রক্তাক্ত৷ তিনি জার্মানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলেকে বলেন, ‘বাংলাদেশে যা হয়েছে তা জঘন্যতম কাজ৷ মৌলবাদীদের কোনো জাত, ধর্ম নেই৷ মানুষের মধ্যে বিভেদ করার জন্যই এই ঘটনা৷ উগ্রবাদীরা ধর্মগ্রন্থ রেখে গিয়ে পরিকল্পিতভাবে হামলা চালিয়েছে৷ বাংলাদেশ সরকার দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে৷ এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া যাতে এখানে না হয়, আমরা চেষ্টা করছি৷’
মুর্শিদাবাদের সফিউলের মতো চমকে দেওয়ার কাহিনি রিষড়া পুর প্রশাসকমণ্ডলীর সদস্য শাকির আলির৷ প্রতি বছর দুর্গাপূজার সময় আরামবাগের শ্বশুরবাড়িতে চলে আসেন তিনি৷ এই বাড়ির মেয়ে, আরামবাগের সাংসদ অপরূপা পোদ্দার তার স্ত্রী৷ পারিবারিক পূজায় তিনি শুধু অংশই নেন না, ষষ্ঠীর দিন উপবাস করে ব্রত পালন করেন৷ বাংলাদেশে মন্দির ও মণ্ডপে হামলা প্রসঙ্গে তৃণমূল নেতার ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া, ‘এরা কি মানুষ? কোনো মানুষ এ কাজ করতে পারে না৷ এই বাংলায় সংখ্যালঘুদের উৎসবের আগে সরকার যেমন সতর্ক থাকে, বাংলাদেশ সরকারেরও সেটা করা উচিত৷’ বিভিন্ন হিন্দু ধর্মস্থানে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন৷ দুর্গাপূজার পর লক্ষ্মীপূজাতেও অংশ নিয়েছেন শাকির৷ তিনি বলেন, ‘আমার ধর্ম আছে আমার মনে৷ ধর্ম আছে মন্দির, মসজিদ, গির্জায়৷ তার বাইরে আছে মানবধর্ম৷ বাংলাদেশ সেটা পালন করা হয়নি৷’
কলকাতার সংখ্যালঘু অধ্যুষিত আলিমুদ্দিন স্ট্রিট এলাকায় নয় বছর পর একটি দুর্গাপূজা ফের শুরু হয়েছে৷ এর উদ্যোক্তাদের মধ্যে অন্যতম ব্যবসায়ী ও সমাজকর্মী মহম্মদ তৌসিফ রহমান বাংলাদেশের ঘটনায় স্তম্ভিত৷ তিনি বলেন, ‘আমাকে ঘন ঘন বাংলাদেশ যেতে হয়৷ সংখ্যালঘুরা সেখানে সমাজের সর্বস্তরে সম্পৃক্ত রয়েছেন৷ সেই দেশে এ ধরনের তাণ্ডবের খবর শুনে খুবই খারাপ লাগছে৷’
ধর্মনিরপেক্ষ দেশ ভারতে এমন একাধিক ভ্রাতৃঘাতী হিংসার সাক্ষী থেকেছে৷ বাবরি মসজিদ থেকে সাম্প্রতিককালে দিল্লির হিংসা বুঝিয়ে দেয়, সংখ্যালঘুদের বিপন্নতা একইরকম৷ এর সঙ্গে সরাসরি রাজনীতির যোগ রয়েছে, এমনই দাবি প্রবীণ শিক্ষিকা মীরাতুন নাহারের৷ তিনি ডয়েচে ভেলেকে বলেন, ‘সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে এই বাংলাতেও আমরা লালন করি না, এ কথা বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি? কেন্দ্র বা রাজ্যে যে শাসক দল আছে, তারা এই বিভাজনের সুযোগ নেন না, একথা জোর দিয়ে বলা যায়? সাধারণ মানুষের সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি থাকে না, অপরাজনীতি তাদের একে অপরের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করে৷ গোটা উপমহাদেশেই এটা ঘটছে৷’
এইসব সংঘাত, স্বার্থবুদ্ধির মধ্যে শান্তিকামী মানুষের ভরসা আসানসোলের নুরানি মসজিদের ইমাম ইমদাদুল্লা রশিদির মতো ব্যক্তিত্ব৷ ২০১৮ সালে হিংসার কবলে পুত্রকে হারাবার পর যিনি বলেছিলেন, ‘প্রতিহিংসা নয়৷ ইসলাম কখনো হিংসার শিক্ষা দেয় না৷ আর কাউকে যেন এভাবে মরতে না হয়৷’
‘আমার ধর্ম আছে আমার মনে৷ ধর্ম আছে মন্দির, মসজিদ, গির্জায়৷ তার বাইরে আছে মানবধর্ম৷ বাংলাদেশে সেটা পালন করা হয়নি৷’
এদিকে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর সাম্প্রতিক হামলার প্রতিবাদে পশ্চিমবঙ্গের ৫৫ জন সংখ্যালঘু বুদ্ধিজীবী যৌথভাবে একটি বিবৃতি দিয়েছেন।
বিবৃতিতে বুদ্ধিজীবীরা বলেন, ‘দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশের নানা প্রান্তে। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর আক্রমণ নেমে এসেছে। বহু জায়গায় মণ্ডপ ভেঙে ফেলা হয়েছে, আগুন দেওয়া হয়েছে, ভয় দেখানো হয়েছে, খুন করা হয়েছে। এই আক্রমণ শুধু ঘৃণ্য নয়, এই আক্রমণ সভ্যতার পরিপন্থী। এই আক্রমণ মানবতার বিরুদ্ধে ঘটানো অপরাধ। এখনই সময় এই আক্রমণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর। এখনই সময় সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে যুক্ত সমস্ত ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়াটা আমাদের দায় নয়, কর্তব্য।’
বিবৃতিতে বুদ্ধিজীবীরা বলেন, ‘বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের আমরা তীব্রভাবে প্রতিবাদ করি। অবিলম্বে এই হিংস্রতা বন্ধ হোক। রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিক। বাংলাদেশের শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা এক জোট হোন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের আবেদন, বাংলাদেশের সংখ্যালঘু মানুষেরা যেন পরিপূর্ণ জীবন নিরাপত্তা ফিরে পান এবং শান্তিতে বসবাস করতে পারেন তার দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হোক।’
বিবৃতিতে বুদ্ধিজীবীরা বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, আসুন, আমরা সম্প্রীতির পক্ষে এক যৌথতার পথে হাঁটি।
এদিকে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের ওপর সাম্প্রতিক হামলার ঘটনায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যজুড়ে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। উৎসবের মৌসুমে যে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি মোকাবিলায় সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর পুলিশ ও প্রশাসনকে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া রাজ্যের সব পুলিশ কমিশনার, পুলিশ সুপার, রেলওয়ের ডিজিপিসহ অন্যান্য পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছেও চিঠি পাঠিয়ে সতর্ক করা হয়েছে।
সহিংসতার প্রতিবাদে গেল রবিবার কলকাতায় বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনের সামনে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে ইসকনের কলকাতা শাখা। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিজেপির সহ সভাপতি জয় প্রকাশ মজুমদার বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে ইসকন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেন।
এ দিকে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর সাম্প্রতিক হামলার নিন্দা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের একজন মুখপাত্র এই নিন্দা জানিয়েছেন বলে মঙ্গলবার এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি ও বার্তা সংস্থা পিটিআই।
জো বাইডেন প্রশাসনের ওই মুখপাত্র জানান, ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রতিটি মানুষের জন্য অধিকার। বিশ্বের সকল মানুষের নিরাপদে নিজেদের উৎসব পালনের অধিকার রয়েছে। বিগত দিনে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হওয়া আক্রমণের ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
এ দিকে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের কাছে হিন্দুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী বাংলাদেশি হিন্দুদের নেতা প্রাণেশ হালদার। এছাড়া বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর চলা নির্যাতন জনসমক্ষে প্রকাশের জন্য মার্কিন মিডিয়া ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কাছেও আবেদন জানিয়েছেন তিনি।
এর আগে গেল ১৩ অক্টোবর কুমিল্লায় পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন শরিফ অবমাননার ঘটনায় প্রতিবাদ জানিয়ে হামলা করে একদল মানুষ। এর জেরে পরবর্তী কয়েক দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে পূজামণ্ডপ, মন্দির ও হিন্দুদের বাড়িতে আক্রমণ ও প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।
হামলার ঘটনার পরপরই উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছিল ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপি ২০১৪ সালে নির্বাচনে জিতে ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র হুমকিতে পড়েছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়—বিশেষ করে মুসলিমরা—দিনে দিনে কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। শুধু ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে পিটিয়ে হত্যার মত বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে এবং উগ্র হিন্দুত্ব-বাদীদের উদ্ধত আচরণকে রাষ্ট্রীয়ভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া নিয়ে ভারতের ভেতরেই অনেক অভিযোগ উঠছে। আর এজন্যই বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ভারতে ধর্মীয় সহিংসতা জাগিয়ে তুলতে পারে বলে এক ধরনের চাপা আশঙ্কা চলছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৩২
আপনার মতামত জানানঃ