মার্কিন বিচারক জিয়া ফারুকির সেপ্টেম্বরে দেওয়া এক নির্দেশে ফেসবুককে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা উসকে দিতে সরকার সমর্থিত অ্যাকাউন্টগুলোর কনটেন্ট প্রকাশ করার জন্য বলা হয়। একই সঙ্গে গণহত্যার উসকানির বিষয়ে ফেসবুকের অভ্যন্তরীণ তদন্ত সংশ্লিষ্ট নথিগুলোও প্রকাশের নির্দেশ দেন।বিচারকের নির্দেশে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর দেশটির সেনাবাহিনীর গণহত্যা সংশ্লিষ্ট অভ্যন্তরীণ নথি প্রকাশের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই শুরু করছে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক। এসব নথিতে গণহত্যা সহিংসতার উসকানি দেওয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্ট সম্পর্কিত তথ্য রয়েছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ এখবর জানিয়েছে।
পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়ার পক্ষ থেকে এসব নথি চাওয়া হয়েছে। রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের গণহত্যার অভিযোগ এনে ২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মামলা করেছে দেশটি।
বুধবার আদালতে দাখিল করা এক আবেদনে ফেসবুক বলেছে, তারা গাম্বিয়ার সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী এবং মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলায় কয়েকশ মিলিয়ন পৃষ্ঠা সংশ্লিষ্ট প্রকাশ্য নথি সরবরাহ করতে রাজি আছে। কিন্তু কোম্পানিটি দাবি করেছে বিচারক তার নির্দেশে অপ্রকাশ্য তথ্য প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছেন। যার মধ্যে রয়েছে ফেসবুকের অভ্যন্তরীণ তদন্তের প্রতিবেদন। যা যুক্তরাষ্ট্রের গোপনীয়তা ও মত প্রকাশের অধিকার পরিপন্থী।
বিচারক ফারুকি তার নির্দেশে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের স্টোরড কমিউনিকেশন অ্যাক্ট অনুসারে গাম্বিয়ার সব অনুরোধ অনুমোদন যোগ্য ।
রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো সহিংস ঘটনার সব তথ্য প্রকাশের জন্য ফেসবুককে নির্দেশ দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের একটি আদালত। এর আগে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বর্বর নির্যাতনের বিভিন্ন তথ্য সহিংস বলে প্রকাশ করা বন্ধ করে দিয়েছিল এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।
মিয়ানমারের সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর চলা নির্যাতন ও সহিংসতা-সংশ্লিষ্ট তথ্য, আন্তর্জাতিক অপরাধের মামলার বিচারকার্য সহায়তার জন্য অনুসন্ধানকারীদের দিতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে ওয়াশিংটন ডিসির ওই বিচারক ফেসবুকের সমালোচনা করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের আইনের অজুহাত দিয়ে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ সেসব তথ্য-উপাত্ত প্রকাশের বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করেছিল। কিন্তু বিচারক বলেন, যেসব তথ্য সরানো হয়েছে, সেগুলো আইনভঙ্গের মধ্যে পড়ে না। এ নির্দেশনার পর ফেসবুক কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য করেনি।
রোহিঙ্গা গণহত্যা এবং ১৯৪৮ সালের জেনোসাইড কনভেনশনে করা চুক্তি ভাঙার অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করে গাম্বিয়া। যদিও মিয়ানমার সেনাবাহিনী নির্যাতন ও সহিংসতার অভিযোগ বরাবরই প্রত্যাখ্যান করে আসছে। হেগের আদালতে মামলা চালাতে যাবতীয় তথ্য হাজির করার জন্য বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত প্রয়োজন গাম্বিয়ার। কিন্তু এসব তথ্য ফেসবুক সরিয়ে ফেলায় বিপাকে পড়েছে দেশটি।
২০১৮ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার এক তদন্তের তথ্যানুযায়ী, মিয়ানমারে ঘৃণামূলক বক্তব্য ও অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরিতে ফেসবুক মূল ভূমিকা পালন করছে। একই সময়ে রয়টার্সের এক তদন্তে দেখা যায়, এক হাজারের বেশি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে রোহিঙ্গা ও মুসলিমদের বিকৃত ভাষায় কটাক্ষ করা হয়। এমনকি তাদের গুলি করে হত্যার অনুরোধও করা হয়। ফেসবুক জানায়, সে সময় তাদের ভুয়া তথ্য এবং ঘৃণা ছড়ানো বক্তব্য ও কনটেন্ট প্রতিরোধ ব্যবস্থা অনেকটা ধীরগতিতে চলছিল।
এক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০১৪ সালে মিয়ানমারের ৫ কোটি ৩০ লাখ জনসংখ্যার মাত্র এক শতাংশ মানুষের কাছে ইন্টারনেট ছিল। কিন্তু মাত্র দু’বছরের ব্যবধানে ২০১৬ সালে মিয়ানমারে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১ কোটি ৪০ লাখ।
রোহিঙ্গা গণহত্যায় ফেসবুকের ভূমিকা সুপ্রতিষ্ঠিত। ২০১৮ সালে ফেসবুকের নিয়োগকৃত একটি কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা উসকে দিতে এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করা হয়েছে। ওই বছরের আগস্টে ফেসবুক মিয়ানমারে ২০ টি সংগঠন ও ব্যক্তিকে নিষিদ্ধ করে। এদের মধ্যে একজন সামরিক কমান্ডারও রয়েছেন।
২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাবিরোধী সামরিক অভিযানের শুরু করে দেশটির সেনাবাহিনী। সেই অভিযানে রোহিঙ্গাদের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, ব্যাপকমাত্রায় গণহত্যার শিকার হয় রোহিঙ্গারা। বহু রোহিঙ্গা নারীকে ধর্ষণ করে মিয়ানমারের সেনাসদস্যরা। সেনাবাহিনীর নির্যাতন থেকে বাঁচতে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন।
জাতিসংঘ ও বিভিন্ন দেশ ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছে, রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নির্মূলের ইচ্ছাতেই রাখাইনে অভিযান চালিয়েছিল সেনাবাহিনী। মিয়ানমারের তৎকালীন সরকার ও সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ জনগণের মধ্যে তখন এই নির্মম নির্যাতনের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ দেখা যায়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বে চলছে সোশ্যাল মিডিয়ার রাজত্ব। যুগের চাহিদায় দিন দিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জনপ্রিয়তা বেড়েই চলছে। ফেসবুক ছাড়া এখন ভাবাই অসম্ভব। কী নেই এখানে? চাইলেই সবকিছু মেলে নেট দুনিয়ায়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে ফেসবুক। ভুয়া তথ্য প্রচার, অশালীন মন্তব্য ও ঘৃণা ছড়ানোর অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছে এ মাধ্যম। এ ছাড়া ফেসবুকের বিরুদ্ধে মৌলবাদ-জঙ্গিবাদে সমর্থন ও পক্ষপাতমূলক আচরণের অভিযোগ তুলেছেন বিশ্বের অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা। মানুষকে বিপথগামী করতে রীতিমতো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০৪৩
আপনার মতামত জানানঃ