স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের শীর্ষ অর্থনীতিবিদদের মতে, ২০২২ থেকে ২০২৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে এবং এতে দেশের জিডিপির পরিমাণ দাঁড়াবে ৫০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ২০২৬ অর্থবছর নাগাদ মাথাপিছু আয় দাঁড়াবে ৩ হাজার ডলার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, মাথাপিছু আয় এখন দুই হাজার ২২৭ ডলার। জিডিপির আকার সাড়ে ৩০০ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি।
গতকাল বৃহস্পতিবার নিয়মিত বছরভিত্তিক গ্লোবাল রিসার্চ ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানিয়েছেন স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের অর্থনীতিবিদরা। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের আন্তর্জাতিক গবেষক দল পরিচালিত গ্লোবাল রিসার্চ ব্রিফিং একটি বার্ষিক কর্মসূচি। ব্যাংকটির এ ফ্ল্যাগশিপ ইভেন্টে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গি ও বৈশ্বিকভাবে বিদেশী মুদ্রা বিনিময়ের বিষয়ে আলোচনা হয়।
গতকাল বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত গ্লোবাল রিসার্চ ব্রিফিং সিরিজ ২০২১-এ গণমাধ্যমের সামনে গবেষণার তথ্য তুলে ধরে ব্যাংকটির গ্লোবাল রিসার্চ টিম। ভার্চুয়াল এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান এমপি। এছাড়াও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের প্রায় ৩০০ গ্রাহক অনুষ্ঠানে অংশ নেন।
অধিবেশনে আলোচ্য বিষয়গুলো উপস্থাপন করেন গ্লোবাল হেড অব রিসার্চ অ্যান্ড চিফ স্ট্র্যাটেজিস্ট এরিক রবার্টসন, হেড অব এএসএ এফএক্স রিসার্চ দিব্য দেবেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতিবিদ সৌরভ আনন্দ।
ব্রিফিংয়ে গবেষকরা জানান, মহামারী থাকা সত্ত্বেও গত বছর বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা সম্পর্কে আশাবাদী ছিলেন। এখনো বিশ্বব্যাপী মহামারী চলমান। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রেখেছে।
চলতি বছরের মধ্যে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির পুনরুদ্ধার ও অভ্যন্তরীণ ব্যয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের জিডিপির অগ্রগতি হবে। এছাড়া মধ্যমেয়াদি প্রাক্কলনও আশাপ্রদ জানিয়ে গবেষকরা বাংলাদেশের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড, ডিজিটালাইজেশন এবং নগরায়ণকে কাঠামোগত চালক হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন গতকাল।
২০২১-২২ থেকে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের মধ্যে ৭ শতাংশেরও বেশি প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত হবে। এছাড়া ওই সময়ের মধ্যে জিডিপির আকার ৫০০ বিলিয়ন ডলার হওয়ার পাশাপাশি মাথাপিছু আয় ৩ হাজার ডলারে উন্নীত হওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছেন স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের গবেষকরা।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের গ্লোবাল হেড অব রিসার্চ অ্যান্ড চিফ স্ট্র্যাটেজিস এরিক রবার্টসন বলেন, মহামারির মধ্যেও ২০২০ সালে সর্বোচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে শক্তিশালী পুনরুদ্ধার হয়েছে বাংলাদেশের। টিকাদান কর্মসূচি এবং কৌশলগত অবকাঠামো প্রকল্পের বাস্তবায়ন দেশটিকে স্বল্পোন্নত দেশের উত্তরণ আরও সহজে এগিয়ে নেবে।
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতিবিদ সৌরভ আনন্দ বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনীতি দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রত্যাশিত জিডিপি বৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। আশা করা যায় ২০২১-২২ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২ শতাংশে উন্নীত হবে। দেশের রফতানি চাহিদা পুনরুদ্ধার, শক্তিশালী রেমিট্যান্স প্রবাহ এবং সরকারি বিনিয়োগ দ্বারা এ প্রবৃদ্ধির বাস্তবায়ন সম্ভব।
সৌরভ আনন্দ আরো বলেন, আশা করা যায় ২০২৫-২৬ অর্থবছর নাগাদ বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার হতে পারে ৫০০ বিলিয়ন ডলার। পাশাপাশি মাথাপিছু আয় ৩ হাজার ডলারে উন্নীত করাসহ মধ্যম আয়ের পথে রূপান্তরের পূর্বশর্ত হলো নীতি সহায়তা।
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নাসের এজাজ বিজয় বলেন, বাংলাদেশ সরকারের দূরদর্শী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপগুলোর কারণে বাংলাদেশ মহামারীকালের বিভিন্ন চড়াই-উতরাই বেশ ভালোভাবেই অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির স্থিতিস্থাপকতা নিয়ে আমরা আশাবাদী। এছাড়া টিকা কর্মসূচি যেহেতু অব্যাহত রয়েছে, তাই অর্থনীতিও ক্রমান্বয়ে ত্বরান্বিত হচ্ছে। এছাড়াও অপেক্ষাকৃতভাবে কম ডেবট-জিডিপি রেশিও দেশের জন্য একটি ফিসকাল রানওয়ে তৈরি করেছে। টেকনোলজি অ্যাডাপশন, টেকনোলজি ইনক্লুসিভনেস ও আইটিইএস সেক্টরের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর উল্লেখযোগ্য সুযোগ রয়েছে। সহায়ক নীতি বেসরকারি বিনিয়োগ এবং এফডিআইকে ত্বরান্বিত করবে।
ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে আলোচনায় প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। আলোচনায় তিনি বলেন, জনগণ, সরকার ও ব্যবসায়ী সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় করোনার ক্ষতি থেকে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের সঠিক পথেই হাঁটছে বাংলাদেশ। ব্যবসা সহায়ক পরিবেশ গড়ে তুলতে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বাভাস
এর পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস বাড়িয়েছে বিশ্বব্যাংকও। বিশ্বব্যাংক গত জুন মাসে বলেছিল, বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার বা মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫ দশমিক ১ শতাংশ বাড়তে পারে। বৃহস্পতিবার এক প্রতিবেদনে সংস্থাটি পূর্বাভাস বাড়িয়েছে। ‘সাউথ এশিয়া ইকোনমিক ফোকাস’ নামে ছয় মাস অন্তর প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে। অবশ্য সরকারের পূর্বাভাস প্রবৃদ্ধি হবে ৭ দশমিক ২ শতাংশ।
বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কেন বাড়ানো হলো তার ব্যাখ্যায় বিশ্বব্যাংক বলেছে, কোভিড সংক্রমণ কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে রপ্তানি বাড়ছে। অন্যদিকে, দেশে ভোগও বাড়ছে। অর্থনীতিতে গত অর্থবছরের শেষ ছয় মাসে পরিমিত পুনরুদ্ধার হয়েছে। যদি করোনার টিকার সরবরাহ বাড়ে এবং অতিমারির ক্ষতিজনিত প্রভাব নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, তাহলে চলতি অর্থবছরে পুনরুদ্ধার ত্বরান্বিত হতে পারে। অবশ্য করোনার নতুন ঢেউ এলে অর্থনীতিতে ঝুঁকি তৈরি করবে। তখন রপ্তানি পণ্যের চাহিদা কমে যেতে পারে। একই সঙ্গে বিদেশে কর্মী পাঠানোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। অন্যদিকে, বিশ্বব্যাংক মনে করছে, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের প্রভাবে দারিদ্র্য কমবে। আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য রেখা (১.৯ ডলার আয়) অনুযায়ী গত অর্থবছরে অতিদারিদ্র্যের হার ১২ দশমিক ৫ শতাংশে নামতে পারে।
দক্ষিণ এশিয়ার ওপর বিশ্বব্যাংকের এবারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনিশ্চয়তা থাকা সত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথে আছে। কেননা বিশ্বে চাহিদা বাড়ছে। করোনা মোকাবিলায় লক্ষ্যভিত্তিক পদক্ষেপ চলমান রয়েছে। তবে অগ্রগতি দুর্বল এবং অসম। করোনার আগের অবস্থা থেকে বেশিরভাগ দেশ এখনও অনেক পিছিয়ে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৫৩
আপনার মতামত জানানঃ