বিশ্বে টানা দ্বিতীয় মাসের মতো খাদ্যের দাম বেড়েছে। ফলে গত ১০ বছরের মধ্যে বিশ্বে খাদ্যের দাম বর্তমানে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। রোম-ভিত্তিক বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশন (এফএও) বৃহস্পতিবার (৭ অক্টোবর) এ তথ্য জানিয়েছে। এর আগে চলতি বছরের মে মাসে বিশ্ব বাজারে খাদ্যের দাম গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল বলে জানিয়েছিল জাতিসংঘের খাদ্য সংস্থা।
আন্তর্জাতিক সংস্থাটির ধারণা- ২০২১ সালে বিশ্বে গম যব ও বার্লির মতো খাদ্যপণ্যের উৎপাদনে রেকর্ড সৃষ্টি হবে তারপরও এসব ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়বে।
এফএও’র সূচকে প্রতি মাসের বৈশ্বিক খাদ্য বাজারের দরদামের হালনাগাদ তথ্য দেওয়া হয়। গম, যব ও ডালজাতীয় দানাশস্য, নানা রকম তৈলবীজ, দুগ্ধজাত পণ্য, মাংস, চিনির বাজারদরের হিসাব ধরে সূচকটি তৈরি করা হয়।
ওই সূচকে বলা হয়েছে, ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের পর থেকে শুরু এ পর্যন্ত গত মে মাসে বিশ্ব খাদ্য বাজার সর্বোচ্চ গরম ছিল। এ ছাড়া মে পর্যন্ত গত ১২ মাস ধরে বিশ্ব খাদ্যমূল্য বেড়েই চলেছে। মে মাসে যেখানে গড়ে ১২৭ দশমিক ১ পয়েন্ট দেখানো হয়েছে। আগের মাস এপ্রিলে যা ১২১ দশমিক ৩ পয়েন্ট। গত বছরের মে মাসের তুলনায় এ বছরের মে মাসে বিশ্ব বাজারে খাদ্যের দাম ৩৯ দশমিক ৭ শতাংশ বেশি।
ভোজ্যতেলের দাম মে মাসে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়েছে। মূলত পাম ও সয়াবিন তেলের বাজার উঠতির দিকে। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় উৎপাদনে ধীরগতির জন্য পামতেলের বাজারে উর্দ্ধগতি দেখা দিয়েছে বলে জানা গেছে।
আগুন লেগেছে চিনির বাজারেও। বিশ্বের বৃহত্তম চিনি রপ্তানিকারক ব্রাজিল মহামারি করোনাভাইরাসে পর্যুদস্ত থাকায় কাঁচামাল উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে এপ্রিলের চেয়ে মে মাসে বিশ্ব বাজারে চিনির দাম দশমিক ৮ শতাংশ বেড়ে গেছে।
সব ধরনের মাংসে গড়ে এপ্রিলের চেয়ে মে মাসে ২ দশমিক ২ শতাংশ দাম বেড়েছে। চীনসহ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো থেকে আমদানি করা মাংসে এমন মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে।
দুগ্ধজাত পণ্যে মাসিক হিসেবে ১ দশমিক ৮ শতাংশ আর বছরের হিসেবে ২৮ শতাংশ দাম বেড়েছে বলে জাতিসংঘের খাদ্য সংস্থার সূচক জানায়।
এ ছাড়া এবারই প্রথম পৃথিবীজুড়ে মোট দানাশস্য উৎপাদনের হালনাগাদ তথ্য নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এফএও। ২০২১ সালে ২০২০ সালের চেয়ে ১ দশমিক ৯ শতাংশ বেশি অর্থাৎ ২ দশমিক ৮২১ বিলিয়ন টন দানাশস্য উৎপাদন হতে পারে।
দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় উৎপাদনে ধীরগতির জন্য পামতেলের বাজারে উর্দ্ধগতি দেখা দিয়েছে বলে জানা গেছে। গত বছর কৃষি পণ্যের দাম বাড়ার মূল কারণ ছিল ফসল কাটার ক্ষেত্রে বিপর্যয় এবং চীনের চাহিদা বৃদ্ধি। করোনাভাইরাসের কারণে কৃষি মজুরির সংকট দেখা দিয়েছে যা চিনি ও ভোজ্যতেল থেকে শুরু করে শাকসবজির মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলেছে।
জাতিসংঘের ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশন (ফাও)য়ের পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, করোনা মহামারি শুরু হবার পর থেকে বিশ্বব্যাপী খাদ্যের দাম বাড়তে থাকে। চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, গম, বার্লি, বিভিন্ন ডেইরি পণ্য, মাছ, মাংস সবকিছুর দাম বেড়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পণ্যগুলোর উৎপাদন কমে যাওয়া আবার কোনো ক্ষেত্রে দেশগুলোর অতিরিক্ত মজুতদারি বাড়ানোর কারণে দাম বেড়েছে।
বিশ্ববাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ত না হলেও গত এক বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশে নিত্যপণ্যের দাম ব্যাপক বেড়েছে। সরকারের ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-এর হিসাব অনুযায়ী, গত এক বছরে মোটা চালের দাম বেড়েছে ৩৭ দশমিক ১৪ শতাংশ। পাইজাম চালের দাম বেড়েছে ২২ শতাংশের বেশি। এসময় সবচেয়ে বেশি বেড়েছে পামওয়েলের দাম। এক বছরের ব্যবধানে এ পণ্যের দাম বৃদ্ধির হার প্রায় সাড়ে ৩৯ শতাংশ। ফাও বলেছে, আবহাওয়ার কারণে ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে পামের উৎপাদন কম হওয়ার কারণে দাম বেড়েছে। আবার চীনা ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত পাম ওয়েল মজুদ করার কারণে বাজারে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এদিকে শুধু পামওয়েল নয়, বিশ্ববাজারের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশেও সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে।
বাংলাদেশে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১১৬ থেকে ১২১ টাকায়। এছাড়া বাংলাদেশে এক বছরের ব্যবধানে আটার দাম বেড়েছে ১০ দশমিক ৭১ শতাংশ, ময়দার দাম বেড়েছে সাড়ে ৭ শতাংশ। মসুরডালের দাম এক বছরে ৯ শতাংশ বেড়েছে বলে টিসিবি জানিয়েছে। মাংসের মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ব্রয়লার মুরগির দাম। গত এক বছরে এটি বাড়ার হার ২৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
ফাও বাংলাদেশের নিত্যপণ্যের ওপর একটি সিচুয়েশন রিপোর্ট দিয়েছে। করোনাকালে নিত্যপণ্যের দাম কেন বাড়বে সে বিষয়ে এতে বিস্তারিত বলা হয়েছে। ফাও বাংলাদেশ অফিস বলছে, করোনা শুরু হবার পর বাংলাদেশের সরবরাহ ব্যবস্থা একেবারেই ভেঙে পড়ে। বিশেষ করে লকডাউনের সময় এ সরবরাহ ব্যবস্থা নিরবচ্ছিন্ন ছিল না। এর কারণে পণ্যের দামে যে ঊর্ধ্বগতি ছিল তা এখনো অব্যাহত রয়েছে।
এদিকে, লকডাউনের সময় সাধারণ জনগণের মধ্যে পণ্য মজুদের প্রবণতা শুরু হয়। যার ফলে লকডাউনের প্রথম সপ্তাহে বাজারে পণ্যমূল্য ১৬ শতাংশ বেড়ে যায়। এর পরে তা আরো বেড়ে ২০ শতাংশে উন্নীত হয়।
এসডব্লিউ/এসএস/১১০৪
আপনার মতামত জানানঃ