অ্যানিমেল রেইন একটি বিরল ঘটনা যেখানে উড়তে অক্ষম প্রাণীর আকাশ থেকে পড়তে দেখা যায়। ইতিহাস জুড়ে অনেক দেশে বহুকাল আগে থেকেই বিভিন্ন সময়ে এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। এ ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীদের অনুমান টর্নেডিক ওয়াটারস্পাউটগুলো কখনও কখনও মাছ বা ব্যাঙের মতো প্রাণীকে তুলে নিয়ে যায় এবং কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত বহন করে। এরপর ওগুলো মাটিতে পতিত হয়। যা মূলত অ্যানিমেল রেইন নামে পরিচিত।
ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে ওড়ার ক্ষমতাহীন প্রাণী ও জিনিসের বৃষ্টি হবার ঘটনা ঘটেছে। খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে রোমান প্রকৃতিবিদ প্লিনি দ্য এল্ডার ‘ব্যাঙ ও মাছ’ বৃষ্টির কথা নথিভুক্ত করেছিলেন। ১৭৯৪ সালে ফরাসি সৈন্যরা লিলি শহরের নিকটবর্তী লালাইনে ভারী বৃষ্টির সময় আকাশ থেকে টুডো পড়তে দেখেছিল। ইওরো, হন্ডুরাসের গ্রামীণ বাসিন্দারা দাবি করেন, প্রতি গ্রীষ্মে সেখানে মাছের বৃষ্টি হয়। এই ঘটনাকে তারা ‘জুভিয়া দে পেতেস’ বলে থাকে। স্প্যানিশ এর অর্থ হল ‘মাছের বৃষ্টি’।
ফরাসী পদার্থবিদ আন্দ্রে-মেরি আম্প্রে (১৭৭৫-১৮৩৬) প্রথমদিককার বিজ্ঞানীদের মধ্যে একজন, যে গুরুত্ব সহকারে অ্যানিমেল রেইনের তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। সোসাইটি অফ ন্যাচারাল সায়েন্সের তথ্যানুসারে আম্প্রে বলেছিলেন, সে সময়ে গ্রামাঞ্চলে প্রচুর ব্যাঙ এবং টোড ছিল। প্রায়ই সেখানে ঝড়ো বাতাস তাদের বহন করে অনেক দূরে নিয়ে যেত।
১৮৬২ সালে সিঙ্গাপুরে মাছের বৃষ্টির পরে ফরাসী প্রকৃতিবিদ ফ্রান্সিস ডি ল্যাপার্টে ক্যাসেলেনাউ অনুমান করেন যে এটি ছিল ক্যাটফিশের অভিবাসন প্রক্রিয়া। যা বৃষ্টির পরে তাদের ভূমির উপর দিয়ে এক জলাশয় থেকে অন্য জলাশয়ে নিয়ে গিয়েছিল।
এদিকে, মে থেকে জুলাই মাসের মধ্যে এমন ‘মাছ বৃষ্টি’ প্রতি বছরই হয় হন্ডুরাসের বিভিন্ন জায়গায়। আকাশ থেকে অঝোরে ঝরে পড়তে থাকে মাছ, স্কুইড, ব্যাঙ। স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ সময় রীতিমতো লোক নিয়োগ করে রাস্তাঘাট পরিষ্কার করাতে হয়।
এই নিয়ে সেখানকার মানুষের মধ্যে প্রচলিত আছে কুসংস্কারও। উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি (১৮৫৬ সাল–১৮৬৪ সাল) সময়ে খ্রিস্ট ধর্মযাজক হোসে সুবিরানা হন্ডুরাসে আসেন। তার সময়ে এই অঞ্চলের বেশির ভাগ মানুষ দারিদ্রতার মধ্যে দিন কাটাতেন। এ সময় তাদের দুর্দশা দূর করতে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেন তিনি। হোসে সুবিরানার প্রার্থনার পর থেকেই দারিদ্র্যের কষ্ট দূর করতে ঈশ্বর আকাশ থেকে ‘মাছের বৃষ্টি’ করেন বলে বিশ্বাস করতে শুরু করেন এই অঞ্চলের মানুষ।
তবে ১৯৭০ সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলের পক্ষ থেকে একটি বিশেষ দলকে পাঠানো হয় হন্ডুরাসে। ওই দলের সদস্যরা এই ‘মাছের বৃষ্টি’র ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেন।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলের ওই সদস্যরা জানান, এই অঞ্চলে আকাশ থেকে যে সব মাছের বৃষ্টি হয়, তা কোনো সমুদ্রিক মাছ নয়। সেগুলো মিষ্টি জলের মাছ। অর্থাৎ, আকাশ থেকে বৃষ্টির মতো ঝরে পড়া মাছগুলো কোনো নদী, পুকুর বা হ্রদের মতো মিষ্টি জলের জলাশয়ের মাছ।
এছাড়া বেশির ভাগ মাছই প্রায় একই প্রজাতির। যদিও ১৯৭০ সালে হন্ডুরাসে ‘মাছের বৃষ্টি’র সত্যতা যাচাইয়ের জন্য সদস্য দল পাঠানোর বিষয়টি স্বীকার করেনি ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল কর্তৃপক্ষ।
আটলান্টিক মহাসাগর থেকে প্রায় ২০০ মাইল দূরে এই মাছের বৃষ্টি হয়। অনেকে মনে করেন, টর্নেডো বা সামুদ্রিক ঝড় আটলান্টিক মহাসাগরের বিভিন্ন অংশের মাছ উড়িয়ে এনে এই অঞ্চলে এনে ফেলে। কিন্তু এমন ঘটনা প্রতি বছর কী করে সম্ভব? এখনও এই ঘটনা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে।
তবে এমন অনেকগুলো ঘটনার ক্ষেত্রেই সর্বজনগৃহীত ব্যাখ্যাটি হল, এখানে আকাশ থেকে কোনও মাছ পড়ার ঘটনা আদৌ ঘটছেই না। মূলত প্রাণীগুলি বাতাস বা কোনও প্রকারের প্লাবন বা পানির ধারার মাধ্যমে পরিবাহিত হয়। এরপর উৎস থেকে দূরে পতিত হয়।
এ সংক্রান্ত বর্তমান বৈজ্ঞানিক অনুমানের সাথে জড়িত আছে জলোচ্ছ্বাস; মূলত টর্নেডো যা পানির দ্বারা গঠিত। এই অনুমানের অধীনে একটি জলোচ্ছ্বাস জলাশয়ের প্রাণীকে তুলনামূলকভাবে উচ্চ উচ্চতায় নিয়ে যায় এবং তাদেরকে বহন করে অনেক দূরে নিয়ে গিয়ে ফেলে। এই অনুমানটি বৃষ্টিতে যে ধরনের প্রাণী পড়ার ঘটনা ঘটে সাধারণত, তাকে সমর্থন করে; যেমন ছোট এবং হালকা, সাধারণত জলজ প্রাণী। পাশাপাশি অ্যানিমেল রেইন প্রায়শই ঝড়ের আগে পরে হয়। তবে, প্রতিটি পৃথক ঘটনার সাথে জড়িত সমস্ত প্রাণীর ক্ষেত্রে এই একটি মাত্র তত্ত্ব দিয়ে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করা যায় না।
যেমন পাখির ক্ষেত্রে ঝড় উড়তে থাকা একটি ঝাঁককে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারে। এতে পাখি বাতাসের সাথে মিলে যায় এবং এরা উড়ন্ত অবস্থায় মারা যেতে পারে, তারপর মাটিতে পড়ে যায়।
কখনও কখনও এ ঘটনা বেশ বড় দলগুলোতেও ঘটে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, ডিসেম্বর ৩১, ২০১০ সালে বিবি, আরকানসাস, যুক্তরাষ্ট্রে আকাশ থেকে ব্ল্যাকবার্ডস পড়ার ঘটনা। এটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা যে খারাপ আবহাওয়া বা দাবানলে পাখিরা দিশেহারা হয়ে গাছ বা বিল্ডিংয়ের মতো বস্তুর সাথে সংঘর্ষে, তাদের মৃত্যু হতে পারে। এবং এভাবেই আকাশ থেকে পাখি পড়ার ঘটনা ঘটতে পারে।
এরপরও বিশ্বজুড়ে আকাশ থেকে পাখিদের পড়ার আরও ঘটনা সামনে আসে; যেমন সুইডেন এবং ইতালিতে একই ঘটনা ঘটেছিল। যদিও অনেক বিজ্ঞানী দাবি করেন যে এই জাতীয় গণহত্যার ঘটনা খুবই স্বাভাবিক এবং সাধারণত নজরে পড়ে না না। তবে স্থলচরদের বৃষ্টির জন্য এখনও উপযুক্ত কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৭৪০
আপনার মতামত জানানঃ