শুকিয়ে যাচ্ছে প্রমত্তা পারানা নদী। দক্ষিণ আমেরিকায় আমাজনের পর দীর্ঘতম এই নদীটির এমন শীর্ণকায় চেহারা এর আগে কখনও দেখেনি আর্জেন্টিনাবাসী। নদীটি আগে সেকেন্ডে ১৭ হাজার কিউবিক মিটার পানি পরিবহন করত, তা এখন নেমে এসেছে মাত্র ৬ হাজার ২০০ মিটারে।
ব্রাজিল থেকে উৎপত্তির পর প্যারাগুয়ে হয়ে আর্জেন্টিনার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আটলন্টিক মহাসাগরে শেষ হয়েছে পারানা নদীটি। এর দৈর্ঘ্য ৪ হাজার ৪৮০ কিলোমিটার। মহাদেশটিতে এর চেয়ে দীর্ঘ নদী কেবল আমাজন, যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৭ হাজার কিলোমিটার।
ব্রাজিলীয় আদিবাসীদের ভাষায় পারানা মানে হল ‘সাগরের মতো’। নদীটির বিশালত্বই তাকে এই নাম দিয়েছিল, তা স্পষ্ট। কিন্তু এখন বদলে যাচ্ছে চিত্র। নদীটিতে পানির ধারা হয়ে পড়েছে সংকীর্ণ, তীরজুড়ে তৈরি হয়েছে বালুচরা। একই সাথে খরার পুড়ছে আর্জেন্টিনা।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অতি-উচ্চ ঝুঁকিতে বাংলাদেশসহ দ. এশিয়ার ৪ দেশের শিশুরা
পারানা নদী শুকিয়ে যাওয়া আর্জেন্টিনার অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। পানি কমে যাওয়ায় বাণিজ্যিক নৌচলাচল বন্ধ হওয়ার উপক্রম। নদীর পানির স্তর এরই মধ্যে জাহাজ চলাচলের জন্য গ্রহণযোগ্য সীমার ৫ ফুট নিচে নেমে গেছে।
আর্জেন্টিনার অর্থনীতির প্রাণ এই নদী দেশটির পণ্য পরিবহনে প্রধান জলপথও। কিন্তু পানি কমে যাওয়ায় জাহাজগুলোর তলা মাটিতে লেগে যাচ্ছে বলে ধারণ ক্ষমতার অর্ধেক নিয়ে এখন চলতে হচ্ছে।
আর্জেন্টিনার ৮০ ভাগ পণ্য পরিবহন হত এই নদী দিয়ে। পণ্য পরিবহনে এখন বাধ্য হয়ে স্থলপথ ব্যবহার করতে হচ্ছে, যার ফলে পরিবহন ব্যয় বেড়ে বাড়িয়ে দিচ্ছে পণ্যের দাম।
পারানা নদীর মধ্য দিয়ে আর্জেন্টিনার ৮০ শতাংশ কৃষিপণ্য আটলান্টিক মহাসাগরে পৌঁছে দেয়া হয়। সেখান থেকে বড় বড় কার্গো বোঝাই করে এসব পণ্য রফতানির উদ্দেশ্যে ক্রেতা দেশগুলোতে পাঠানো হয়।
পারানায় পানি কমে যাওয়ায় আর্জেন্টিনা ও প্যারাগুয়ে উভয় দেশেরেই জলবিদ্যুৎ উৎপাদন বাধাগ্রস্ত করছে। ভূতত্ত্ববিদ কার্লোস রামোনেল বলেন, “পানামা আর্জেন্টিনার দীর্ঘতম নদীই কেবল নয়, এটি জীববৈচিত্র্যের এক বড় আধার। তাছাড়া দেশটির আর্থসামাজিক অবকাঠামোর জন্যও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।”
গ্রিনল্যান্ডে প্রথম বৃষ্টি: জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘটে যাওয়া এক বিপর্যয়
পারানা নদীতে প্রবাহ কমে যাওয়ায় এর সংলগ্ন খালগুলো এখন পানিশূন্য। পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে কমে গেছে মাছ, ফলে বিশাল এই নদী ঘিরে থাকা মৎস্যজীবীরা পড়েছে জীবিকার সঙ্কটে। পাশাপাশি ৪ কোটি মানুষ তাদের সুপেয় পানির উৎস নিয়েও পড়েছে দুঃশ্চিন্তায়।
জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ ধ্বংসের প্রভাব যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে, পারানা নদীটির বর্তমান অবস্থাকে তার বড় উদাহরণ হিসেবে দেখাচ্ছেন গবেষকরা। সম্প্রতি খরার কারণে উত্তর আমেরিকার কলোরাডো নদীতে পানি প্রবাহ কমে যাওয়াও একই রকম উদ্বেগ ছড়াচ্ছে।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৭৭ বছরে এখনই সবচেয়ে কম পানি প্রবাহ দেখা যাচ্ছে পারানা নদীতে। পরিবেশবিদরা ধারণা বন ধ্বংস আর জলবায়ু পরিবর্তন নদীটিতে এই খরার কারণ।
ব্রাজিলের দক্ষিণাঞ্চল, যেখানে পারানা নদীর জন্ম, সেখানে এবার গত তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। যার ফল হিসেবে পারানাতে জলপ্রবাহ এক-তৃতীয়াংশ কমে গেছে। পারানার এই খরা পরিস্থিতি ২০২২ সাল নাগাদ চলতে পারে বলে পরিবেশবিদরা আভাস দিয়েছে।
তিনটি দেশের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া পারানা আর প্যারাগুয়ে ও উরুগুয়ে নামে আরও দুটি নদীর সঙ্গে মিলে যে অববাহিকা তৈরি করেছে, তার নাম রিও দে লা প্লাতা। আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, প্যারাগুয়ে দেশ তিনটি এই অববাহিকারই অংশ।
শুধু আর্জেন্টিনা কিংবা প্যারাগুয়েই শুধু নয়, পারানা নদীর এই সঙ্কট ভোগাবে সারা বিশ্বকেও। বিশ্বের শীর্ষ সয়াবিন রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে দুটি হল এই দেশ দুটি। পারানায় খরা এই কৃষিপণ্য উৎপাদনের পাশাপাশি তা সান্তা ফের মতো বন্দরে নিয়ে যাওয়াও সঙ্কটাপন্ন করে তুলেছে।
আর্জেন্টিনা বিশ্বের শীর্ষ সয়ামিল রফতানিকারক দেশ। এছাড়া বৈশ্বিক ভুট্টা রফতানিতে দেশটির অবস্থান তৃতীয়। নদী শুকিয়ে যাওয়ায় কৃষিসমৃদ্ধ দেশটির রফতানি কমছে।
আর্জেন্টিনার চেম্বার অব পোর্ট ও মেরিটাইম অ্যাক্টিভিটিজের ব্যবস্থাপক গ্যালেরমো ওয়েইড বলেন, বর্তমানে বেশি পণ্য বোঝাই করলে জাহাজগুলো নদীর তলদেশে আটকে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে প্রতিটি জাহাজে স্বাভাবিকের তুলনায় ১০ হাজার টন কম পণ্য বোঝাই করা হচ্ছে।
করোনাভাইরাস মহামারীর খাঁড়ার মধ্যে নদীর এই সঙ্কটে আর্জেন্টিনা সরকার দেশবাসীকে পানির ব্যবহার সীমিত করার আহ্বান জানিয়েছে। সরকার দেশবাসীকে বলেছে পানি অপচয় না করতে, বৃষ্টির পানির ব্যবহার বাড়াতে। নদীর ধারের বনে আগুন না জ্বালাতে বলা হয়েছে, কেননা তা থেকে দাবানল সৃষ্টি হতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৬০৩
আপনার মতামত জানানঃ