গত বছরের জুন মাসে দগ্ধ হয়ে মারা যান খায়রুল। খায়রুলের প্রেমিকা নিথীর বাবাকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন নিহতের পিতা। প্রথমে পুলিশ তদন্ত করে এই মামলার, পরে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডিকে। এরপর মামলায় সাক্ষী করা হয় নিথীর মাকে। এমন পরিস্থিতিতে নিথী অভিযোগ করছেন তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ সিআইডি’র বিরুদ্ধে। তিনি বলছেন ঘুষ না দেওয়ায় সিআইডি তাদের টানা দু’দিন আটকে রেখেছে, বাধ্য করেছে সিআইডির শিখিয়ে দেওয়া জবানবন্দি দিতে।
নিহত খায়রুলের বাবার অভিযোগ
নিহত খায়রুলের বাসা উত্তর বাড্ডার ময়নারবাগ এলাকায়। ২০২০ সালের ২০ জুন বাড্ডার রসুলবাগ এলাকার একটি বাড়ির টিনে চালে তিনি দগ্ধ হন। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চারদিন পর, ২৪ জুন তিনি মারা যান। এই ঘটনায় নিহতের বাবা আব্দুল কুদ্দুস শিকদার বাড্ডা থানায় নাদিম আহম্মেদ নামে এক ব্যক্তিকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন।
আব্দুল কুদ্দুস শিকদার এজাহারে উল্লেখ করেন, ‘নাদিম আহম্মেদের বড়মেয়ে নাজনীন আহম্মেদ নিথীর (১৮) সঙ্গে তার ছেলে খায়রুল ইসলামের প্রায় পাঁচ বছর ধরে প্রেমের সম্পর্ক। এই সম্পর্ককে মেয়ের বাবা নাদিম আহম্মেদসহ তাদের পরিবার ভালোভাবে নেয়নি।’
‘নিথীর সঙ্গে খায়রুল বিভিন্ন জায়গায় দেখা সাক্ষাৎ করতো। গত বছরের ২০ জুন রাত সাড়ে ৮টার দিকে নিথীর সঙ্গে দেখা করতে উত্তর বাড্ডায় তার বাসায় যায় খায়রুল। তারা দুজনে নিথীদের বাড়ির ছাদে বসে কথা বলছিল। এসময় নিথীর বাবা নাদিম আহম্মেদ তাদের কথা বলা টের পেয়ে ছাদে যান, সেখানে গিয়ে খায়রুলকে মারধর করে ছাদ থেকে পাশের বাসার টিনের ছাদে ফেলে দেন।’
তিনি বলেন, ‘খায়রুল টিনের উপরে থাকা মোটা বিদ্যুতের তারে স্পৃষ্ট হয়ে দগ্ধ হয়। মূমুর্ষ অবস্থায় তাকে স্থানীয়রা শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে নিয়ে যায়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত বছরের ২৪ জুন তার মৃত্যু হয়।’
নিথীর জবানবন্দি
গত বছরের ২৭ জুলাই আদালতে এই মামলায় সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন নাজনীন আহম্মেদ নিথী। মামলাটি প্রথম ছয়মাস বাড্ডা থানা পুলিশ তদন্ত করেন। এসময় নাজনীন আহম্মেদ নিথী সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন। তখন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন বাড্ডা থানার এসআই সাইফুল ইসলাম ভূঁইয়া। তিনি নিথীর জবানবন্দি রেকর্ড করেন।
জবানবন্দিতে নিথী বলেন, ‘আমি মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। একটি কোচিং সেন্টারে কোচিং করতে গিয়ে খায়রুল ইসলামের সঙ্গে পরিচয় হয়। তার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক হয়।’
‘গত বছরের ২০ জুন আনুমানিক সাড়ে ৭টার দিকে খায়রুল আমাকে ছাদে ডাকে। আমি তার কল পেয়ে বাসার ছাদে উঠি। আমরা দুজনে ছাদে বসে কথা বলছিলাম। এমন সময় আমি একটা আওয়াজ পাই, মনে হয় যেন কেউ একজন ছাদে উঠে আসছে। কে আসছে- দেখতে আমি সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যাই। সিঁড়ির দিকে যেতেই বিকট শব্দ শুনতে পাই। ফিরে ছাদে গিয়ে দেখি খায়রুল ইসলাম আমাদের ভবনের পাশের একটি বাড়ির টিনের চালে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। সে বিদ্যুতের তারে আঘাত পেয়েছে। আমি চিৎকার করি, এলাকার লোকজন জড়ো হয়। তারা খায়রুলকে ধরে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে চারদিন পর তার মৃত্যু হয়।’
নিথী বলেন, ‘আমি ধারণা করছি, হয়তো তাড়াহুড়ো করে খায়রুল ছাদ থেকে চলে যাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়েই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েছে।’
সিআইডির বিরুদ্ধে অভিযোগ
২০২০ সালের ২৯ অক্টোবর মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব বাড্ডা থানা থেকে সিআইডির কাছে হস্তান্তর করা হয়। সিআইডির ঢাকা মেট্রো উত্তরের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. খালিদুল হক হাওলাদার প্রথমে পুলিশ পরিদর্শক হারুন অর রশীদকে মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করেন। কিছুদিন পর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়। এবার এসআই দোলন মজুমদারকে তদন্তকারী অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। সিআইডির এসআই দোলন মজুমদার মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হওয়ার পর একটি টিম নিয়ে চলতি বছরের ৮ জুন নিথীদের বাসায় যান।
নিথী বলেন, ‘আমার বাবা, মা, মামাসহ সবাইকে সিআইডি সদর দফতরে যেতে বলা হয়। সে অনুযায়ী ১০ জুন সকালে আমরা সিআইডি অফিসে যাই। সেখানে আমাদের সকলের কাছ থেকে ঘটনার লিখিত বিবরণ নেওয়া হয়। এরপর একজন একজন করে বিশেষ পুলিশ সুপার মো. খালিদুল হক হাওলাদারের কক্ষে নিয়ে যায়। সেখানে তিনি হুমকি দেন। বলেন, তারা যেভাবে বলে সেভাবে জবানবন্দি লিখতে।
নিথী বলেন, ‘আমাকে লিখতে বলা হয়, খায়রুলকে আমার বাবা মারধর করেছে। তারপর বাবা তার বন্ধু ইয়াকুব আলীকে দিয়ে কেরোসিন আনিয়ে খায়রুলের গায়ে আগুন দিয়েছে। আর এতেই তার মৃত্যু হয়েছে। আমরা মাকেও একই কথা বলে তারা।’
তাদের কথা অনুযায়ী সাক্ষী না দিলে আমাদের টর্চার করা হবে বলে ভয় দেখায়। আমাদের সামনেই এসআই দোলনকে নির্দেশ দেয় মারধর করার জন্য। তারপরও তাদের কথায় রাজি না হলে দুদিন আমাদের সিআইডি কার্যালয়ে আটকে রাখা হয়। নির্যাতন করা হয়। মাকে ভয় দেখানো হয়।
দুদিন পর আমাদের আদালতে নেয় তারা, আমার মাকে দিয়ে বাবার বিরুদ্ধে এবং ইয়াকুব আলী নামে এক বেকারি ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে জবানবন্দি দেওয়াতে বাধ্য করে। নির্যাতনের কারণে মা বাধ্য হয়েছে আদালতে তাদের শেখানো মতো কথা বলতে।
নিথী বলেন, থানা পুলিশের মাধ্যমে আগেই আমার জবানবন্দি আদালতে দেওয়া থাকায় সিআইডি আর আমাকে দিয়ে আর এই মিথ্যা কথা বলাতে পারেনি।
১০ লাখ টাকা না দেয়ায় নির্দোষকে ফাঁসানোর অভিযোগ
সিআইডি মামলা তদন্ত করতে গিয়ে উত্তর বাড্ডার বেকারি ও রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী ইয়াকুব আলী নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে। সিআইডি দাবি করেছে, ইয়াকুব আলী মামলা আসামি নাহিদ আহম্মেদের বন্ধু। নিথীর মা যে জবানবন্দি দিয়েছে সেখানে নাহিদ আহম্মেদের যে বন্ধুর কথা বলা হয়েছে সেই ব্যক্তি এই ইয়াকুব আলী। এরপর ইয়াকুব আলীকে তার উত্তর বাড্ডার স্বাধীনতা সরণির বেকারির অফিস থেকে গত ১০ জুন রাত ৩টার দিকে সিআইডির একটি টিম আটক করে।
ইয়াকুব আলী বলেন, ‘সিআইডি কার্যালয়ে নিয়ে তাকে নির্যাতন করা হয়। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে ১২ জুন তাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স হাসপাতালে নিয়ে যায়।’
তিনি অভিযোগ করেন, ‘সিআইডির এসআই ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দোলন মুজমদার তার কাছে ১০ লাখ টাকা দাবি করেন। বলেন, এ টাকা না দিলে আরও নির্যাতন করা হবে এবং মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া হবে।’
আটকের তিনদিনের মাথায় ১৩ জুন ইয়াকুব আলীকে সাতদিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠায় সিআইডি। আদালত একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। ওইদিন পুরান ঢাকার রায় সাহেব বাজার মোড়ে এসআই দোলন ইয়াকুব আলীর ছোট ভাই রাজুর সঙ্গে কথা বলেন।
রাজুকে এসআই দোলন বলেন, ‘তোমার ভাইকে বলেছিলাম আমাকে ১০ লাখ টাকা দিতে। আমার কথা মতো টাকা দিলে তোমার ভাইয়ের আজ এই পরিণতি হতো না। এখনও সময় আছে ভেবে দেখো।’
এসময় ইয়াকুব আলীর ছোটভাই এসআই দোলনকে অনুরোধ করে তার ভাইকে যেন আর মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো না হয়। সেজন্য নগদ ২ লাখ টাকা দেয়। এ প্রসঙ্গে রাজু গণমাধ্যমকে বলেন, ‘রায় সাহেব বাজারে বসে আমি টাকা দিয়েছি, ওই তারিখের সেখানে থাকা সিসি ক্যামেরার ফুটেজে খুঁজলে সেই ফুটেজও পাওয়া যাবে।’
এরপর গত ২৮ জুলাই জামিন পেয়ে ইয়াকুব আলী জানান, ‘নাদিম আহম্মেদের সঙ্গে আমার পরিচয় রয়েছে। শুনছি তার মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে এসে একটা ছেলে মারা গেছে। ঘটনার পর নাদিমকে বলেছি, তোমার মেয়ে দোষী না হলে তোমাদের সমস্যা কি? কিন্তু সেই মামলাতেই আমাকে ফাঁসানো হলো। আমি এর কিছুই জানি না। আমি ব্যস্ত মানুষ, আমার রেস্টুরেন্ট, বেকারি নিয়ে ব্যস্ত থাকি। কেবল টাকা পাওয়ার লোভেই সিআইডি আমাকে ফাঁসিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমি কীভাবে কখন কেরোসিন নিয়ে গিয়েছি, তা প্রমাণ করুক সিআইডি। আমাকে অবৈধভাবে ৬০ ঘণ্টা সিআইডি কার্যালয় আটকে রাখা হয়েছে, নির্যাতন করা হয়েছে।’
এসব অভিযোগের বিপরীতে এসআই দোলন মজুমদার ‘তদন্তাধীন বিষয়’ নিয়ে প্রথমে কথা বলতে রাজি হননি। পরে তিনি বলেন, ‘সব আমার ঊর্ধ্বতন স্যাররা জানেন।’
ময়নাতদন্ত রিপোর্টে সিআইডি মিথ্যাচার ফাঁস
নিহত খায়রুলের ময়নাতদন্ত রিপোর্ট দেওয়া হয় এ বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি। ঢামেক হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ এ রিপোর্ট প্রদান করেন। মৃত্যুর কারণ হিসেবে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘বিদ্যুৎস্পৃষ্টে খায়রুলের শরীরের ৬০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। এতে তার মৃত্যু হয়েছে।’
তার শরীরে কেরোসিন বা দাহ্য পদার্থ কোনও কিছুর অস্থিত্ব পায়নি ঢামেক ফরেনসিক বিভাগ। তাহলে কেরোসিন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়ার বিষয়টি কিভাবে পেলো সিআইডি? এ বিষয়ে এসএস খালিদুল হক হাওলাদার বলেন, ‘নিথী ও তার মা ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে কেরোসিনের কথা বলেছেন। ইয়াকুব আলীকে ফোনে কেরোসিন নিয়ে আসতে বলেছিলেন তারা। সেই কেরোসিন গায়ে ঢেলেই তাতে আগুন দিয়ে খায়রুলকে দগ্ধ করা হয়।’
তবে তিনি দুজনের স্বীকারোক্তির কথা বললেও নীথির স্বীকারোক্তির কোথাও কেরোসিনের কথা নেই। তবে তার মা কেরোসিনের কথা বললেও তা ফরেনসিক রিপোর্টের সঙ্গে তা মিলছে না। এদিকে, খায়রুলের শরীরে কেরোসিনের অস্তিত্ব ছিল বলে কোনও প্রমাণ দেখাতে পারেনি সিআইডি।
আসামিদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া ও নির্যাতনের বিষয়ে খালিদুল হক হাওলাদার বলেন, ‘হত্যা মামলার আসামিরা অনেক কথাই বলে থাকেন।’ তবে সিআইডির তদন্তে অভিযোগ ওঠার পর পুলিশের এই তদন্ত সংস্থাটির প্রধান মামলার তদন্তভার এই টিমের কাছ থেকে নিয়ে সিরিয়াস ক্রাইম টিমকে দিয়েছেন। মামলাটি এখন সিরিয়াস ক্রাইম টিম তদন্ত করছে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৬০১
আপনার মতামত জানানঃ