কাবুল বিমানবন্দরে ভয়াবহ আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহতের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়েছে। অধিকাংশই বেসামরিক আফগান নাগরিক; সংখ্যাটি প্রায় ৯০। এছাড়া ১৩ জন মার্কিন সেনা রয়েছেন। শুক্রবার (২৭ আগস্ট) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল। এদিকে এই হামলার দায় স্বীকার করে নিয়েছে নিষিদ্ধঘোষিত আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)। তবে তদন্তের আগে হামলার ঘটনার পরপরই মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের হামলায় তালিবানের জড়িত থাকার সন্দেহ উড়িয়ে দেয়া নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি বাইডেনের প্রতিশোধের হুঙ্কার হয়তো আরও একটি ইরাক বা আফগানিস্তান দেখার ক্ষেত্র প্রস্তুত করলো।
লাশের স্তূপ কাবুল বিমানবন্দরে
সংবাদমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চালানো ওই হামলায় নিহত বেসামরিক আফগানের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে কমপক্ষে ৯০ জনে।
এছাড়া নিহত কমপক্ষে আরও ১৩ মার্কিনিসহ হামলায় প্রাণ হারানো মানুষের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়েছে। নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
কাবুল বিমানবন্দরে হওয়া ভয়াবহ এই আত্মঘাতী বোমা হামলায় এখন পর্যন্ত ১৫০ জনেরও বেশি মানুষের আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। আহতদের মধ্যে ১৮ জন মার্কিন সেনা ও চাকরিজীবী রয়েছেন বলেও নিশ্চিত করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা।
সূত্র মতে, বৃহস্পতিবারের হামলার পর বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আরও হামলার আশঙ্কা করছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন সামরিক বাহিনীর মেরিন কমান্ডার জেনারেল ফ্রাংক ম্যাকেঞ্জি সাংবাদিকদের কাছে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
যা ঘটেছিল কাবুল বিমানবন্দরে
গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে কাবুল বিমানবন্দরে পরপর দু’টি বিস্ফোরণ ঘটে। প্রথম বিস্ফোরণটি হয় অ্যাবেই গেটের কাছে। যেখানে মার্কিন ও ব্রিটিশ বাহিনী বিমানবন্দরের দায়িত্বে ছিল। হামলার পর গোলাগুলির ঘটনাও ঘটে।
এর কিছুক্ষণ পরেই দ্বিতীয় বিস্ফোরণ ঘটে ব্যারন হোটেলের পাশে। যেখানে ব্রিটিশ কর্মকর্তারা যুক্তরাজ্যে ভ্রমণ প্রত্যাশী আফগানদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দিচ্ছিল।
আফগান সাংবাদিক বিলাল সারওয়ারি এক টুইটে বলেছেন, বিমানবন্দরের অ্যাবেই গেটের বাইরে কাগজপত্র যাচাই-বাছাইয়ের জন্য একটি পয়ঃনিষ্কাশন খালের পাশে নারী শিশুসহ অনেক আফগান অপেক্ষা করছিলেন।
সেখানেই ভিড়ের মধ্যে আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এক হামলাকারী নিজেকে উড়িয়ে দেয়। বিস্ফোরণের পর আরেক হামলাকারী গুলিবর্ষণ শুরু করে।
কাবুলে বিবিসির প্রতিনিধি সেকেন্দার কারমানি বলেন, অনলাইনে শেয়ার করা ভিডিওতে কাবুলের বিমানবন্দরে লাশের স্তূপ দেখা গেছে। যে কারণে নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। কাবুল বিমানবন্দরের বাইরের বিস্ফোরণের ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, বিস্ফোরণটি ‘সত্যিই শক্তিশালী’ ছিল।
তদন্তের আগেই তালিবান দায়মুক্ত
আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে হামলার দায় স্বীকার করেছে নিষিদ্ধঘোষিত আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)।
যুক্তরাষ্ট্রের আগে থেকেই বদ্ধমূল ধারণা, এ হামলার পেছনে আছে আইএসের হাত। তবে এই হামলায় তালিবান ও আইএসের মধ্যে কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাচ্ছেন না মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
এ প্রসঙ্গে বাইডেন বলেন, ‘কাবুলে কাজ করা কমান্ডারদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে যেসব নথিপত্র আমাকে দেওয়া হয়েছে, সেখান থেকে এটা কোনোভাবেই নিশ্চিত হওয়া যায় না যে এই হামলাকে কেন্দ্র করে আইএস ও তালিবানের মধ্যে কোনো ধরনের যোগসূত্র রয়েছে।’
তবে বাইডেন আইএসের সঙ্গে তালিবানের সম্পর্ক না পেলেও গবেষকেরা এই দুই সংগঠনের মধ্যে সম্পর্ক খুঁজে পাচ্ছেন। তালিবানের গুরুত্বপূর্ণ শাখা হাক্কানি নেটওয়ার্কের সঙ্গে আইএসের সম্পর্ক রয়েছে বলে প্রচলিত আছে। হাক্কানি নেটওয়ার্কের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তালিবানের। হাক্কানি নেটওয়ার্কের নেতা সিরাজুদ্দিন হাক্কানি তালিবানেরও নেতা।
প্রতিশোধের আভাস যুক্তরাষ্ট্রের
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইঙ্গিত দেন যে, কাবুল দখলের পর তালিবান কারাগারগুলো উন্মুক্ত করে দেওয়ায় হয়তো সেখান থেকেই হামলাকারীরা বেরিয়ে এসেছে। তিনি এই হামলার জন্য আইএস-কে গ্রুপকে অভিযুক্ত করেন। যদিও বাইডেনের আগেই কাবুলের এই জোড়া হামলার জন্য দায় স্বীকার করে নিয়েছে জঙ্গি গোষ্ঠীটি।
বর্বর এই হামলার ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। হামলার পেছনে দায়ীদের খুঁজে বের করে শাস্তি নিশ্চিত করার কথাও জানিয়েছেন তিনি।
স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার (২৬ আগস্ট) জো বাইডেন বলেছেন, ‘আমরা ক্ষমা করবো না। আমরা এই হামলার কথা ভুলেও যাবো না। আমরা হামলাকারীদের অবশ্যই খুঁজে বের করবো এবং জড়িতদেরকে এর মূল্য দিতে হবে।’
প্রেসিডেন্ট বাইডেন জোর দিয়ে বলেন, সন্ত্রাসীদের ভয়ে যুক্তরাষ্ট্র কখনোই চুপ করে বসে থাকবে না। তার ভাষায়, ‘আমরা এই মিশন বন্ধ করবো না। আমরা (কাবুল থেকে) আমাদের এই প্রত্যাহার প্রক্রিয়া চালিয়ে যাবো।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভয়াবহ এই হামলা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আফগান নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার যে কাজ যুক্তরাষ্ট্র কাঁধে তুলে নিয়েছিল, তা বেশ জটিল করে দিল। তবে এসব ছাপিয়ে হামলাকে কেন্দ্র করে জো বাইডেনের তালিবানের একপ্রকার পক্ষাবলম্বনকে বিশেষজ্ঞরা ভালো চোখে দেখছে না বিশ্বরাজনীতির জন্য। সম্প্রতিই কাবুল বিমানবন্দরে প্রবেশে আফগান নাগরিকদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল তালিবান। এরপরেও থামেনি মানুষের ঢল। তালিবানের গুরুত্বপূর্ণ শাখা হাক্কানি নেটওয়ার্কের সঙ্গে আইএসের সম্পর্ক নিয়ে গুঞ্জন অনেকদিনের। এসব এড়িয়ে বাইডেনের প্রতিশোধের ঘোষণা হয়তো চতুর শেয়ালের কুমিরের বাচ্চা দেখানোর গল্পটার পুনরাবৃত্তি। হয়তো আরও একটি ইরাক বা আফগানিস্তান দেখার অপেক্ষায় আছে বিশ্ব।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৩০৬
আপনার মতামত জানানঃ