দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার অভ্যাস এখন সবার মধ্যেই তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে কর্মজীবীরা বাধ্য হয়েই বসে কাজ করেন। শুধু অফিসের কারণেই নয়, অনেক তরুণরাও ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে ল্যাপটপ বা কম্পিউটার ব্যবহার করেন। আবার কেউ কেউ বসে দেখছেন টিভি। সব মিলিয়ে একটানা বা দিনের বেশিরভাগ সময় বসে থাকার ফলে নিজের অজান্তেই স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়াচ্ছেন অনেকেই।
দিনের বেশিরভাগ সময় বসে থাকা ৬০ বছরের কম বয়সী প্রাপ্তবয়স্কদের স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি থাকে বলে নতুন এক গবেষণায় উঠে এসেছে। এসকল লোকের তুলনায় শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকা মানুষের স্ট্রোকের ঝুঁকি কম বলেও উল্লেখ করা হয় গবেষণাটিতে।
স্ট্রোক ইন আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন বলেছে, যেসকল ব্যক্তি দৈনিক চার ঘণ্টারও কম সময় ধরে বসে থাকেন এবং প্রতিদিন অন্তত ১০ মিনিট ব্যায়াম করেন, তাদের চেয়ে দৈনিক আট ঘন্টা বা তার বেশি সময় ধরে বসে থাকা এবং শারীরিকভাবে সক্রিয় না থাকা ব্যক্তিদের স্ট্রোকের ঝুঁকি সাতগুণ বেশি।
গবেষকরা তাদের এ বিশ্লেষণে কানাডিয়ান কমিউনিটি হেলথ সার্ভে থেকে ১ লাখ ৪৩ হাজার প্রাপ্তবয়স্ক লোকের স্বাস্থ্য বিষয়ক তথ্য ব্যবহার করেছেন। গত ৯ বছরের মধ্যে স্ট্রোকের কোনো ইতিহাস নেই এরকম ৪০ বছর বা এর বেশি বয়সীদের অনুসরণ করেছিলেন তারা।
স্ট্রোকের লক্ষণ
কানাডার অন্টারিওতে ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল স্কলার লিড স্টাডি লেখক ডা রায়েদ জাউন্ডি বলেন, অলস সময়ে গ্লুকোজ নষ্ট হয় বলে ধরা হয়। এছাড়াও লিপিড বিপাক এবং রক্ত প্রবাহকে বাধা দেয় এবং শরীরে প্রদাহ বৃদ্ধি করে। এই পরিবর্তনগুলি সময়ের সাথে সাথে রক্তনালীর উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে এবং হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়।
জাউন্ডি বলেন, এগুলি হল সবচেয়ে সাধারণ ধরনের স্ট্রোক এবং এগুলি ঘটে যখন মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহকারী একটি ধমনী বন্ধ হয়ে যায়। যদি স্ট্রোকের দ্রুত চিকিৎসা না করা হয়, তাহলে মস্তিষ্কের কোষগুলি অক্সিজেনের অভাবে মারা যেতে শুরু করতে পারে।
মেরিল্যান্ডের বাল্টিমোর জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ মেডিসিনের অধ্যাপক কেরি স্টুয়ার্ট বলেছেন, এমন একাধিক লক্ষণ রয়েছে যা নির্দেশ করে যে কীভাবে স্ট্রোক হতে পারে। তিনি বলেন, সাধারণ উপসর্গগুলির মধ্যে রয়েছে আপনার বাহু, পা বা মুখে দুর্বলতা অনুভব করা, বিশেষ করে যদি আপনার শরীরের একপাশে বিচ্ছিন্ন অনুভূতি হয়। যদি আপনার হঠাৎ কোন গুরুতর মাথাব্যথা হয় যা আপনার অন্য কোন পরিচিত স্বাস্থ্য অবস্থার সাথে যুক্ত নয়, এটি স্ট্রোকের লক্ষণ হতে পারে।
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের নিটোরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মুহম্মদ সিরাজ-উল-ইসলাম বিবিসিকে বলছেন, দীর্ঘ সময় কাজ করার একটি বড় দিক হচ্ছে দীর্ঘ সময় চেয়ারে বসে থাকা। লম্বা সময় নড়াচড়া না করলে এতে অনেক সময় ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিস নামের একটি সমস্যা হতে পারে। যাতে পায়ের মাংসপেশির ভেতর দিয়ে যে শিরাগুলো রয়েছে সেই শিরায় রক্ত জমাট বেঁধে যায়। এই শিরাগুলোতে রক্ত চলাচল মস্তিষ্ক ও হৃদযন্ত্রের সুস্থতার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। শিরাগুলো হৃদযন্ত্র ও মস্তিষ্কে শরীরের অন্যান্য অংশের সাথে রক্ত চলাচলে সহায়তা করে। রক্ত জমাট বেঁধে গেলে সেই চলাচলে বাধা সৃষ্টি হয়।
যেসকল ব্যক্তি দৈনিক চার ঘণ্টারও কম সময় ধরে বসে থাকেন এবং প্রতিদিন অন্তত ১০ মিনিট ব্যায়াম করেন, তাদের চেয়ে দৈনিক আট ঘন্টা বা তার বেশি সময় ধরে বসে থাকা এবং শারীরিকভাবে সক্রিয় না থাকা ব্যক্তিদের স্ট্রোকের ঝুঁকি সাতগুণ বেশি।
অধ্যাপক মুহম্মদ সিরাজ-উল-ইসলাম বলছেন, সাধারণত এতে পায়ে ব্যথা হওয়ার সমস্যাই বেশি হয় কিন্তু এমনও হতে পারে যে একটি ছোট ক্লট (জমাট বাঁধা রক্ত) মস্তিষ্কে পৌঁছে গেল এবং কোন ধমনীতে আটকে গেল। এতে পক্ষাঘাত হতে পারে, স্ট্রোক হতে পারে। দেখা গেল ক্লট গিয়ে হৃদযন্ত্রের কোন অংশে আটকে গেল। তখন হৃদযন্ত্রে পর্যাপ্ত রক্ত পৌঁছায় না। এসব কারণে মানুষ মারাও যেতে পারে।
তিনি আরও বলেন, দীর্ঘ সময়ে চেয়ারে বসে কাজ করার কারণে মেরুদণ্ডের পাশের মাংসপেশিতে ব্যথা হয় এবং একপর্যায়ে মেরুদণ্ডেও ব্যথা হতে পারে। অনেক অল্প বয়সে এই সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারেন, তাতে কাজ করার সক্ষমতা কমতে থাকে।
কম্পিউটারের মনিটরের উচ্চতার সাথে যদি চোখের সামঞ্জস্য না থাকে এবং দীর্ঘ সময় কাজ করলে ঘাড়ে ব্যথা হতে পারে। দীর্ঘ সময় কম্পিউটারে কাজ করলে চোখেরও সমস্যা বাড়ে। দীর্ঘ সময় শারীরিক কোন শ্রম না করলে ডায়াবেটিস হতে পারে।
স্ট্রোকের সম্ভাবনা কমানোর উপায়
স্টুয়ার্ট বলেন, অলস সময় হ্রাস করা শারীরিক কার্যকলাপ বৃদ্ধি যাতে আপনার স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করতে পারে। এছাড়া দাঁড়িয়ে থাকা এবং কম বসার মাধ্যমে স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। লিফটের পরিবর্তে সিঁড়ি ব্যবহার শরীরের ছোট পরিবর্তন আনতে পারেন। হৃৎস্পন্দন বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট পরিমাণে ব্যায়াম করা এবং দ্রুত হাঁটা বা বাইক চালানোর মতো ঘাম হওয়া ক্রিয়াকলাপগুলি স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করতে পারে।
এছাড়া, আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের মতে, প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে ১৫০ মিনিট মাঝারি মানের শারীরিক ব্যায়াম করা উচিত। জাউন্ডি বলেছিলেন যে, প্রাপ্তবয়স্কদের একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে ব্যায়াম করা উচিত এবং প্রতিবারে তা ১০ মিনিটেরও বেশি সময় ধরে করা যেতে পারে।
তিনি বলেন, যখন আপনি আপনার হৃদস্পন্দন বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট পরিমাণে ব্যায়াম করছেন তখন তা মাঝারি তীব্রতার ব্যায়াম হিসেবে বিবেচিত হয়। দ্রুত হাঁটা বা বাইক চালানোর মত কাজ মাঝারি তীব্রতার ব্যায়াম।
স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে শুধুমাত্র বসে থাকার সময় কমিয়ে আনার চেয়ে অন্যান্য বিষয়ের উপরেও নজর দেওয়ার পরামর্শ দেন জাউন্ডি। তিনি বলেন, পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ, ধূমপান বন্ধ, উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসের মত রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার পাশাপাশি শারীরিক কাজকর্মের উন্নতিও স্ট্রোকের ঝুঁকি হ্রাসের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
অনেক পেশার জন্য দীর্ঘ সময় কাজ করা একটি বাস্তবতা। ব্যাংক, এনজিও কর্মী, ডাক্তার, সাংবাদিক এরকম অনেক পেশার মানুষ রয়েছে তাদের কাজের পরিধি নয়টা পাঁচটা থাকে না।
অধ্যাপক মুহম্মদ সিরাজ-উল-ইসলাম বলছেন, এসব মানুষদের উচিত হবে প্রতি এক ঘণ্টায় একবার পাঁচ মিনিটের জন্য জোরে জোরে একটু হেঁটে নেয়া। এতে রক্ত সঞ্চালন বাড়ে যা হৃদযন্ত্রের জন্য ভালো। কম্পিউটারের মনিটরের উচ্চতা এমনভাবে রাখতে হবে যাতে তা চোখের উচ্চতার সমান হয়। অনেকক্ষণ টাইপ করতে হলে হাতের কনুই চেয়ারের দুইপাশের হাতলে রেখে নিতে পারেন।
টাইপ করার মাঝেও বিরতি দেয়া উচিত। চোখের আরামের জন্য কিছুক্ষণ চোখ বুজে থাকা, সবুজ কোন গাছের দিকে তাকিয়ে থাকলে উপকার পাওয়া যায়।
কাজের ফাঁকে ছোট বিরতি নেবার কথা বলছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। কিছুক্ষণ বিরতি নিয়ে এক কাপ চা অথবা কফি নিয়ে সহকর্মীদের সাথে একটু গল্প করা, পছন্দের কারো সাথে ফোনে কথা বলা, পছন্দের কোন গান শোনা এসব পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭০৩
আপনার মতামত জানানঃ