বাবুনগরীর মৃত্যুর পর নতুন নেতৃত্ব বাছাই করা হেফাজতের জন্য সহজ হবে না। বেশ আগে থেকেই নেতৃত্বহীন হেফাজত; সেই আল্লামা শফীর মৃত্যুর পর থেকেই। তার মৃত্যুর পর হাটহাজারী মাদ্রাসা পরিচালকের পদ ফাঁকা ছিল প্রায় এক বছর। এদিকে, গত কয়েক মাসে বাবুনগরী হেফাজতের ভেতর দুই পক্ষের কাউকে সন্তুষ্ট করতে তো পারেনইনি বরং বিরাগভাজন হয়েছেন সবার। ১০ বছরের নেতা শাহ আহমদ শফীর যতটা নিয়ন্ত্রণ ছিল হেফাজতে ইসলামীতে, ততটা ছিল না জুনায়ের বাবুনগরীর।
তার নেতৃত্বে আসা নিয়ে সংগঠনে ভাঙন ধরে কমিটি গঠনের আগেই। আবার কমিটি গঠনের পরেও অন্তত দুই জন নায়েবে আমির বাবুনগরীরে নেতৃত্বে অনাস্থার দেখিয়ে সংগঠন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। তবে হেফাজতে বাবুনগরীর দৃশ্যত কোনো বিকল্প ছিল না। যে কারণে, সংগঠন কমিটি ভেঙে দেয়ার পরেও তিনিই ছিলেন নেতৃত্বে।
তবে তার মৃত্যুতে সংগঠনের জন্যও তৈরি হয়েছে সমস্যা। কারণ নেতৃত্বে আসার মতো একক কোনো নাম নেই সংগঠনে। আবার নেতৃত্ব বেছে নিতে যে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, তার সুযোগ আছে কি না, তা নিয়ে আছে সংশয়।
নেতৃত্বহীন হেফাজতে ইসলাম
২০১০ সালে হেফাজত গঠনের পর থেকে এখন পর্যন্ত নেতৃত্ব ধরে রেখেছে চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসা। হেফাজত নেতৃত্ব তাদের মধ্যেই রাখতে আগ্রহী। কিন্তু দ্বন্দ্ব-বিরোধের আশঙ্কায় আল্লামা শফীর মৃত্যুর পর মাদ্রাসার মুহতামিমই নির্বাচিত করা যায়নি কাউকে। এই অবস্থায় হেফাজতের নেতৃত্বে একজনকে আনাটা কঠিন হবে তাদের জন্য।
হেফাজতের মহাসচিব নুরুল ইসলাম জেহাদী এখন দৃশ্যত প্রধান নেতা হলেও তার প্রভাব সংগঠনে কম। ৯০ বছর বয়সী সংগঠনের জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির মুহিব্বুলাহ বাবুনগরীর হাটহাজারী মাদ্রাসার শিক্ষক নন। তাকে ভারপ্রাপ্ত আমির করা হলেও তিনি পূর্ণাঙ্গ আমিরের পদ পাবেন কি না, তা নিয়ে আছে সংশয়।
২০২০ সালে আল্লামা শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর পর, কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক আলোচিত এ ধর্মীয় সংগঠনটি গত নভেম্বরে যে জাতীয় সম্মেলন করে তাতে প্রয়াত আমির আল্লামা শফীর অনুসারীরা পদ পদবি পাননি। তারপর থেকে ওই অংশ বর্তমান কমিটির বিরোধিতা করে আসছে।
ফলে এক দফা ভাঙনের মুখে পড়ে সংগঠনটি। বাবুনগরীর মৃত্যুর পর সংগঠনটি আরেকদফা ভাঙনের মুখে পড়বে কি না সেটি এখন দেখার বিষয়।
বাবুনগরীর অনুসারী হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা মীর ইদ্রিস বলেন, ‘বাবুনগরী মৃত্যুর কারণে সংকট তৈরি হবে। তবে আশা করি সেটি বেশিদিন স্থায়ী হবে না। সংকট দ্রুত কেটে যাবে। নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করা হবে।’
তবে সংগঠনের পরবর্তী নেতৃত্বে কে আসবে- সে প্রসঙ্গে হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব আব্দুল আওয়াল বলেন, ‘এখনও এ বিষয়ে কোন সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত হয়নি। এ নিয়ে আমি এখন কিছুই বলতে পারব না। তবে দ্রুতই এ বিষয়ে আমরা বসে সিদ্ধান্ত নেব।’
হেফাজতের নতুন নেতা বেছে নেয়া যে সহজ হবে না, তা হাটহাজারী মাদ্রাসার নেতৃত্ব শূন্যতাই বলে দেয়। হাটহাজারী মাদ্রাসার তাফসির বিভাগের একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, ‘মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটি নামে আছে। সবকিছু জুনায়েদ বাবুনগরী নিয়ন্ত্রণ করতেন। তার কথায় মাদরাসা চলত। তিনি মারা যাওয়াতে মাদ্রাসায় নতুন মহাপরিচালক নির্বাচন নিয়ে সংকট তৈরি হবে।’
যেভাবে নেতৃত্বে ব্যর্থ হন বাবুনগরী
গত বছরের সেপ্টেম্বরে হাটহাজারী মাদ্রাসায় হাঙ্গামার কদিনের মধ্যেই আল্লামা শফীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ফাটল ধরে সংগঠনে। মাদ্রাসায় হাঙ্গামার সময় তাকে চিকিৎসা দিতে বাধা, এমনকি অক্সিজেনের নল খুলে ফেলার মতো গুরুতর অভিযোগ এনেছে প্রয়াত আমিরের পরিবার। আর শফীর শ্যালক এই ঘটনায় হত্যা মামলা করেন বাবুনগরীর অনুসারীদের বিরুদ্ধে।
এরই মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তদন্ত সংস্থা পিবিআই। এতে অবহেলাজনিত নরহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। তবে এখনও বিচার শুরু হয়নি। গত নভেম্বরে জাতীয় সম্মেলন করে বাবুনগরীকে আমির করে যে কমিটি ঘোষণা করা হয়, তাতে শফী অনুসারী কাউকে রাখা হয়নি। এই কমিটিতে স্থান দেয়া হয় বিএনপি-জামায়াত জোটের শরিক শতাধিক নেতাকে।
আর নতুন কমিটি গঠন করার পর হঠাৎ করেই তারা সরকারবিরোধী অবস্থান নিয়ে আন্দোলনে নামার হুমকি দিতে থাকেন। নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সহিংসতা করে। বিশেষ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া তাণ্ডব ছিল নজিরবিহীন। হেফাজত নেতারা এ সময় বলতে থাকেন, দেশ চালাতে হলে সরকারকে তাদের কথা শুনেই চালাতে হবে।
কিন্তু এপ্রিলের শুরুতে হেফাজত নেতা মামুনুল হক নারায়ণগঞ্জের সোনারগায়ের রয়্যাল রিসোর্টে নারীসঙ্গীসহ অবরুদ্ধ হওয়ার পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। হেফাজত নেতারা তাৎক্ষণিক সহিংসতা চালিয়ে ত্রাস তৈরি করলেও কয়েকদিন পরেই পাল্টে যায় পরিস্থিতি। সরকার যখন অভিযান শুরু করে, তখন হেফাজত চুপসে যায়।
গত ২৬ এপ্রিল নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার অভিযানের মুখে সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় ব্যর্থ হওয়ার পর হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। নানা নাটকীয়তার পর গত ৭ জুন ৩৩ সদস্যের নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়। আগের কমিটির মধ্যে যারা বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক ছিলেন, তাদের সবাইকেই বাদ দেয়া হয়।
এই সিদ্ধান্ত আবার সংগঠনের বাদ পড়া নেতারা মেনে নিতে পারেননি। আগের কমিটির নায়েবে আমির মাওলানা আবদুর রব ইউসুফী ফেসবুক স্ট্যাটাসেই বাবুনগরীর সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছিলেন। আল্লাম শফীর অনুসারীদের সঙ্গে সমঝোতার অংশ হিসেবে প্রয়াত আমিরের বড় ছেলে ইউসুফ মাদানীকে সহকারী মহাসচিব করা হয়। তবে ওই দিনই ইউসুফ মাদানী তা প্রত্যাখান করেন। এভাবে বাবুনগরী সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করতে গিয়ে কার্যত দুই কূলই হারান।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৫০১
আপনার মতামত জানানঃ