পুনরায় তালিবান আফিগানিস্তানের ক্ষমতা নিজেদের দখলে নিয়েছে কাবুল জয়ের মধ্য দিয়ে। এরপর থেকেই দেশটিতে বিশৃঙ্খলা ও আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি আতঙ্কে রয়েছে নারীরা। তাদের উপর নানারকম নিয়মকানুন চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে যা গতবার ক্ষমতায় থাকাকালীনও ছিলো।
যদিও তালিবান জানিয়ে দিয়েছে, এবার তারা নারীদের ব্যাপারে কিছুটা হলেও ভিন্ন পথে এগোবে। কিন্তু আফগানিস্তান নারী ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক খালিদা পোপাল এতে ভুলছেন না। উত্তরসূরিদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে আছেন খালিদা। তিনি বর্তমান ফুটবলারদের বলে দিয়েছেন, নিরাপত্তার স্বার্থে সব জার্সি পুড়িয়ে ফেলতে, ফুটবলার হিসেবে তাদের যত ছবি আছে, সব নষ্ট করে ফেলতে।
সাবেক এই ফুটবলার থাকেন কোপেনহেগেনে। সেখান থেকে গতকাল বুধবার (১৮ আগস্ট) এক ভিডিও সাক্ষাৎকারে এখনকার খেলোয়াড়দের উদ্দেশে খালিদা বলেছেন, খেলোয়াড়ি সত্তা বোঝায় এমন সবকিছু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে মুছে ফেলতে। তালিবান শাসনে চলে যাওয়া দেশটিতে নিরাপত্তার স্বার্থে খেলোয়াড়দের পেজগুলোও বন্ধ করে দিতে বলেছেন, বলছেন জার্সিও পুড়িয়ে ফেলতে।
খালিদার ধারণা করছেন, তালিবান এর আগে মেয়েদের নির্বিচারে খুন, ধর্ষণ করেছে, পাথর নিক্ষেপ করে মেরেছে। তাই বর্তমান ফুটবলারদেরও ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। আফগান ফুটবল লিগেরও সহপ্রতিষ্ঠাতা খালিদা বলেছেন, একসময় তিনি মেয়েদের ‘শক্ত থাকতে, সাহসী হতে এবং প্রকাশে আসা’র আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন উল্টোটাই করতে বলছেন তিনি। ‘আজ আমি ওদের ডেকে বলছি, নাম সরিয়ে নাও, তোমাদের পরিচয় মুছে ফেলো, নিরাপত্তার জন্য ছবি মুছে ফেলো। এমনকি তোমাদের জাতীয় দলের জার্সিও পুড়িয়ে ফেলতে বা ফেলে দিতে বলছি আমি।’
এমন কিছু বলতে যে তার যে অনেক কষ্ট হচ্ছে, সেটাও স্বীকার করে নিয়েছেন খালিদা, ‘আমার মতো একজন সমাজকর্মী, যে কিনা সব সময় প্রতিবাদ করেছে এবং যে “জাতীয় নারী দলের একজন খেলোয়াড়” পরিচয়টা পাওয়ার জন্য লড়াই করেছে, তার জন্য এটা খুবই কষ্টকর। জার্সির এই ব্যাজ অর্জন করা, দেশের হয়ে খেলার অধিকার আদায় ও সম্মান অনেক গৌরবের একটা ব্যাপার।’
এদিকে ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা বলেছে, তারা আফগানিস্তানের অবস্থা দেখে ‘চিন্তিত’, ‘আমরা আফগানিস্তান ফুটবল ফেডারেশন ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। নিয়মিত সেখানকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখা হবে এবং সামনের সপ্তাহ ও মাসে সাহায্য করা হবে।’
১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালের শাসনামলে তালেবান মেয়েদের চাকরি নিষিদ্ধ করেছিল। মেয়েদের স্কুলে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল এবং মেয়েদের সব সময় বাইরে বোরকা পরা বাধ্যতামূলক ছিল এবং পুরুষ কোনো সঙ্গী নিয়েই বের হতে হতো। তবে এবার তালিবান বলেছে, ইসলামি নিয়ম মেনে নারীদের অধিকারের ব্যাপারে সচেতন হবে তারা।
তালিবান শাসনে আফগান নারীদের অবস্থা নিয়ে সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানে একটি নিবন্ধ লিখেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আফগান নারী। কাবুলের বাসিন্দা পরিচয়ে তিনি লিখেছেন, ‘সবাই বাড়ি ফিরতে চাইলাম। কিন্তু আমরা গণপরিবহন ব্যবহার করতে পারিনি। চালকরা আমাদের তাদের গাড়িতে উঠতে দিচ্ছিল না। কারণ তারা একজন নারীকে বহনের দায়িত্ব নিতে চায়নি। ডরমিটরির নারীদের অবস্থা ছিল ছিল আরও খারাপ। যারা কাবুলের বাইরে থেকে এসেছে তাদের কোথায় যাওয়া উচিত তা নিয়ে তারা ভীত হয়ে পড়ে।
এদিকে চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষরা নারীদের নিয়ে মজা করছিল। মেয়েদের ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থা দেখে তারা হাসাহাসি করছিল। একজন বললো, ‘যাও বোরকা পর। আরেকজন বললো, ‘তোমাদের রাস্তায় বের হওয়ার এটাই শেষ দিন।’ তৃতীয় জন বললো, ‘একদিন আমি তোমাদের চারজনকে বিয়ে করবো।’
‘সরকারি অফিস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমার বোনকে বাড়ি ফেরার জন্য শহরে কয়েক মাইল দৌড়াতে হয়েছিল। অনেক বেদনা নিয়ে আমি আমার কম্পিউটার বন্ধ করে দিয়েছি। গত চার বছর ধরে এটি আমাকে আমার জনগণ ও সম্প্রদায়ের সেবা করতে সাহায্য করেছে। অশ্রুসিক্ত চোখে আমার ডেস্ক ছেড়ে দিয়ে সহকর্মীদের বিদায় জানালাম। আমি জানতাম এটা আমার চাকরির শেষ দিন। আমি আফগানিস্তানের সেরা দুই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রায় একই সময়ে দুইটি ডিগ্রি প্রায় সম্পন্ন করেছি। নভেম্বরে আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব আফগানিস্তান এবং কাবুল ইউনিভার্সিটি থেকে আমার গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আজ সকালে আমার চোখের সামনে সবকিছু ধরা দিলো।’
এমন পরিস্থিতি যেখানে নারীরা অফিসে কাজ পর্যন্ত করতে পারছে না, বাইরে একা বের হতে পারছে না সেখানে নারীদের ফুটবল খেলতে পারা প্রায় অসম্ভবের পর্যায়ে। তাই সাবেক অধিনায়ক খালিদা এই পদক্ষেপ নিতে বলার জন্য অনেকটা বাধ্যই হয়েছেন।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/২২৫৫
আপনার মতামত জানানঃ