পুলিশ জনগণের বন্ধু। পুলিশ জনগণের জানমালের রক্ষাকর্তা; দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্বপ্রাপ্তও তারা। কিন্তু জনগণের রক্ষক যখন ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তখন কি আর পুলিশ জনগণের রক্ষক আর বন্ধু হতে পারে? জনগণের রক্ষক এ বাহিনীর অনেক সদস্য আজ জড়িয়ে পড়ছেন বহুবিধ অপরাধকর্মে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। ব্যাপক ক্ষমতা পাওয়ার পর দিনদিন আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে পুলিশ। ইয়াবাকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম পুলিশের নানা অপরাধ বাড়ছে যেন দুর্বার গতিতে। শুধু ইয়াবা বিক্রি ও পাচার নয়, সোনার বার লুটসহ নানা অপরাধে ঝুঁকে পড়ছেন চট্টগ্রাম পুলিশের কিছু সদস্য। মোটা অঙ্কের টাকা আয়ের লোভে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন বলে মনে করছেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
পুলিশ ও আদালত সূত্র জানায়, চট্টগ্রামে দুই দশকে (২০০১ থেকে ২০২১) পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হয়েছে ৩৮টি। এর মধ্যে ১৯টি ইয়াবাসংক্রান্ত। এরপর সোনার বার লুটের মামলা ১০টি। এ ছাড়া টাকা লুটের ৩টি, ডাকাতি ও খুনের ২টি, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের ২টি এবং অস্ত্র ও ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে আছে ২টি মামলা।
মামলায় আসামি ৫৩ জন। এর মধ্যে একজন করে পুলিশ সুপার (এসপি), সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) ও পরিদর্শক রয়েছেন। এ ছাড়া উপপরিদর্শক (এসআই) ২৪ জন, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) ৭ জন ও বাকি ১৯ জন কনস্টেবল। অপরাধে অভিযুক্ত ৪৩ জন পুলিশ সদস্য গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। বর্তমানে চট্টগ্রাম কারাগারে এক এসপিসহ সাতজন। বাকিরা জামিনে। এ পর্যন্ত তিন মামলায় সাবেক সাত পুলিশ সদস্যের সাজা হয়েছে।
গত ২৭ জুন নগরের কর্ণফুলী এলাকায় ১১ হাজার ৫৬০টি ইয়াবাসহ পুলিশের এক এসআইকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। তার নাম শেখ মাসুদ রানা (৩৫)। তিনি পিবিআই কক্সবাজার জেলায় কর্মরত ছিলেন।
মামলাটির তদন্ত চলছে জানিয়ে কর্ণফুলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দুলাল মাহমুদ বলেন, বেশি দামে বিক্রির জন্য কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামে এক মাদক ব্যবসায়ীর কাছে ইয়াবাগুলো নিয়ে আসছিলেন মাসুদ।
এভাবে জেলা ও নগর মিলে ইয়াবা বিক্রি, পাচার ও আত্মসাতের মামলাসংখ্যা এখন ১৯। এর মধ্যে ১৭টি মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। প্রতিটিতে অভিযুক্ত পুলিশের জড়িত থাকার সত্যতা পাওয়া গেছে বলে জানায় পুলিশ সূত্র।
পুলিশের কিছু সদস্য কেন ইয়াবা পাচারসহ নানা অপরাধে ঝুঁকছেন? ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম হয়ে সারা দেশে ইয়াবা পাচার হয়। ইয়াবা অনেকটাই সহজলভ্য। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বিমানবন্দর হয়ে অবৈধভাবে সোনা পাচারের অভিযোগ রয়েছে। ধরাও পড়ে। অবৈধভাবে আসা সোনার বারগুলো লুট হলেও ক্রেতা-বিক্রেতার বৈধতা না থাকায় আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। ফলে মোটা অঙ্কের টাকা আয়ের জন্য সহজ পথ মনে করা হয় ইয়াবা পাচার ও সোনার বার লুট।
কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম হয়ে সারা দেশে ইয়াবা পাচার হয়। ইয়াবা অনেকটাই সহজলভ্য। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বিমানবন্দর হয়ে অবৈধভাবে সোনা পাচারের অভিযোগ রয়েছে। ধরাও পড়ে। অবৈধভাবে আসা সোনার বারগুলো লুট হলেও ক্রেতা-বিক্রেতার বৈধতা না থাকায় আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। ফলে মোটা অঙ্কের টাকা আয়ের জন্য সহজ পথ মনে করা হয় ইয়াবা পাচার ও সোনার বার লুট।
এছাড়া গত ২ ফেব্রুয়ারি আনোয়ারা উপজেলার বৈরাগ গ্রামে নগর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে গিয়ে আবদুল মান্নান নামের এক ঠিকাদারকে দুই ঘণ্টা বিভিন্ন স্থানে ঘোরানোর পর ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা নিয়ে মুক্তি দেওয়া হয়। এই ঘটনায় নগর পুলিশের ছয় কনস্টেবলকে গ্রেপ্তার করা হয়। ছয় পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় পিবিআই অভিযোগপত্র চূড়ান্ত করেছে। তবে এখনো জমা দেয়নি। তবে টাকা লুটের অপর দুই মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ।
এ ছাড়া ২৮টি সোনার বার লুটের অভিযোগের মামলায় গোয়েন্দা পুলিশের এসআই এ কে এম আবুল হোসেন, ৮টি সোনার বার লুটের ঘটনায় এনায়েত বাজার পুলিশ ফাঁড়ির এসআই মিজানুর রহমান ও কনস্টেবল খান এ আলম গ্রেপ্তার হয়ে জামিনে আছেন। সোনার বার লুটের ১০ মামলা বিচারাধীন।
যে কোনো দেশে পুলিশের কাজ অপরাধ দমন; অপরাধ করা নয়। দক্ষিণ-এশীয় দেশগুলোয় পুলিশের অপরাধ করার প্রবণতা সাধারণত অপরাধীদের গ্রেপ্তারের পর নির্যাতনের কথা প্রায়ই শোনা যায়। মিথ্যা অজুহাতে এনকাউন্টারের মাধ্যমে কোনো নিরীহ ব্যক্তি বা অপরাধীকে হত্যা করার ঘটনাও বিরল নয়। নারীর শ্লীলতাহানিও এর মধ্যে রয়েছে। ভারতের কয়েকটি রাজ্যে এমন ঘটনার কথা প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায় কিছু পুলিশ সদস্যের ভূমিকা ও এসব ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে ঐতিহ্যবাহী এ বাহিনীর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সংশ্লিষ্টরা উদ্বিগ্ন। তারা বলছেন, সাধারণ মানুষের কাছে পুলিশ একটি আতঙ্কের নাম হয়ে উঠছে। একের পর এক অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে পুলিশ।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্নীতিগ্রস্ত কিছু পুলিশ সদস্য একের পর এক অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ায় পুলিশের অন্য সদস্যদের মধ্যেও অপরাধপ্রবণতা দেখা দিচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, বর্তমান সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য পুলিশবাহিনীর আমূল পরিবর্তন দরকার। এ বাহিনীতে বর্তমানে কমিটমেন্ট ও রিসোর্সের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। পুলিশের বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ আসে। কিন্তু সব অভিযোগই যে সত্য এটা সঠিক নয়। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছরে অর্ধলক্ষাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে পুলিশ সদর দপ্তরের সিকিউরিটি সেল ও ডিসিপ্লিন বিভাগে। অপরাধী যেই হোক, তার শাস্তি নিশ্চিত করাই হলো অপরাধ দমনের প্রথম পদক্ষেপ। আর অপরাধ দমনের দায়িত্বে নিয়োজিতদের মধ্যে যারা নিজেরাই অপরাধে লিপ্ত হবে, তাদের শাস্তি অধিকতর কঠোর হওয়া দরকার।
তাদের শাস্তি দুইভাবে হতে পারে জানিয়ে তারা বলেন, প্রচলিত আইন অনুযায়ী ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থায় বিচার হওয়া উচিত। দুর্ভাগ্যজনক, দেশে কোনো পুলিশ সদস্য অপরাধ করলে তার শাস্তি হয় কদাচিৎ। কখনো কখনো শাস্তিমূলক পদক্ষেপ হিসেবে কোনো কোনো পুলিশ সদস্যকে ক্লোজ করা হয়। এ ক্লোজ করার অর্থ জেল, জরিমানা বা চাকরি থেকে বরখাস্তের মতো কিছু নয়। এর অর্থ হলো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কাউকে সাসপেন্ড করা। সাসপেনশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তাকে আবার চাকরিতে বহাল করা হয়। চাকরিতে বহাল হওয়ার পর শাস্তিপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্য আবার নতুন উদ্যমে আগের মতোই তার অপরাধমূলক কাজ চালিয়ে যায়। বর্তমানে এ অবস্থার পরিবর্তন জরুরি হয়ে পড়েছে। অপরাধ জগতের দুর্বৃত্তদের মতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও একে একে অপরাধে জড়িয়ে পড়তে থাকলে একপর্যায়ে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়াতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬২২
আপনার মতামত জানানঃ