গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো করোনায় বিপর্যস্ত সময়ে ডেঙ্গুর কবলে দিশেহারা মানুষ। চলতি মাসে গড়ে প্রতিদিন প্রায় আড়াইশ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। তবে করনোর মতোই প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা থেকে যাচ্ছে অজানা। করোনাভাইরাসের পাশাপাশি দেশে ডেঙ্গু সংক্রমণও মহামারি পর্যায়ে চলে এসেছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশে ডেঙ্গি পরিস্থিত পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০০৭ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত এ রোগের প্রকোপ তুলনামূলকভাবে কম ছিল। ওই ৮ বছরে কখনোই ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দুই হাজার ছাড়ায়নি। ২০১৫ সাল থেকে রোগটির প্রকোপ বাড়তে শুরু করে। ২০১৭ সালে কিছুটা কমে ২০১৮ সালে আবার বেড়ে যায়। তবে এবার ছাড়িয়ে গেছে গত যেকোনো বারের সংক্রমণকে। বাড়ছে তীব্রতা, রোগীর সংখ্যা; তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আমাদের অসচেতনতা এবং কর্তৃপক্ষের উদাসিনতা।
ডেঙ্গু মহামারি
সংক্রমণ গত বছরের তুলনায় আশঙ্কাজনকহারে বেশি। পরিসংখ্যান বলছে, গত বছরের জুন ও জুলাই মাসের তুলনায় ২০২১ সালের দুই মাসে ডেঙ্গু রোগী বেড়েছে ৯৯ গুণ। একই সময়ে চলতি আগস্টের প্রথম ছয় দিনে এটা বেড়ে দাঁড়িয়ে যায় ৮১ গুণে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ৩২ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৯ জন, মার্চে ১৩ জন, এপ্রিলে ৩ জন, মে মাসে ৪৩ জন, জুন মাসে ২৭২ জন, জুলাই মাসে ২২৮৬ জন এবং আগস্টের ৬ দিনে ১৪৫৭ জন। অন্যদিকে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ১৯৯ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৪৫ জন, মার্চে ২৭ জন, এপ্রিলে ২৫ জন, মে মাসে ১০ জন, জুন মাসে ২০ জন, জুলাই মাসে ২৩ এবং আগস্ট মাসে ৬৭ জন।
চলতি বছর আগস্ট মাসের প্রথম ৬ দিনে আক্রান্ত হয়েছেন ১৪৫৭ জন, অন্যদিকে গত বছরের এই সময়ে আক্রান্ত ছিলেন মাত্র ১৮ জন। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় এ বছর এই সময়ে আক্রান্ত বেড়েছে ৮১ গুণ।
অধিদপ্তর থেকে মাত্র ৪১টি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে তথ্য দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অনেক বেসরকারি হাসপাতাল তথ্য ঠিকমতো দেয় না। অন্যদিকে রাজধানীর অনেক হাসপাতালে ডেঙ্গু চিকিৎসা হয়ে থাকে। যারা কোনো তথ্যই অধিদপ্তরকে দেয় না। এতে প্রকৃত তথ্য থেকে যায় অজানা।
হেমোরেজিক ফিভার বা শক সিনড্রোম
এ বছর দেশে ডেঙ্গু সংক্রমণ হচ্ছে ডেন-৩ এর মাধ্যমে। এই সেরোটাইপে আক্রান্ত রোগীদের ‘হেমোরেজিক ফিবার’ হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। এতে রক্তের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান প্লাটিলেট অস্বাভাবিক দ্রুততার সঙ্গে কমে রোগীর জীবন ঝুঁকিতে পড়তে পারে। শিশুরাও এ রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। এরই মধ্যে ৫ শিশুর মৃত্যু ঘটেছে।
ঢাকা শিশু হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের জুন মাসে সেখানে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নেয় ১৪ শিশু, জুলাই মাসে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১০৪ জনে। ৬ আগস্ট পর্যন্ত শিশু হাসপাতালে ভর্তি আছে প্রায় ৫০ জন। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৪ জনের। এছাড়া বাইরের অন্য হাসপাতালে আরেক শিশুর মৃত্যু হয়।
এ প্রসঙ্গে শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. সৈয়দ শফি আহমেদ বলেন, হাসপাতালে গড়ে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ শিশু ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি হয়, আবার অনেকে সুস্থ হয়ে ফিরে যায়। বর্তমানে প্রায় ৫০ জন চিকিৎসাধীন। এর মধ্যে আইসিইউতে (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) আছে ৮ জন।
তিনি বলেন, আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে শক সিনড্রোম, হেমোরেজিক ফিবার এবং ওয়ার্নিং ফিভার লক্ষ করা যাচ্ছে। এ পর্যন্ত যে চারজনের মৃত্যু হয়েছিল তাদের মধ্যে একজনের মস্তিষ্কে ইনফেকশন ছিল, একজন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ছিল। বাকি দুজন অনেক দেরিতে হাসপাতালে এসেছিল।
সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জ্বর নিয়ে যারা হাসপাতালে যাচ্ছেন, রক্ত পরীক্ষায় তাদের ডেঙ্গু ধরা পড়ছে। আক্রান্ত অনেক রোগীর রক্তের প্লাটিলেট দ্রুত কমে যাচ্ছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে আগস্ট মাসে ডেঙ্গুর হার ভয়াবহ পর্যায়ে চলে যেতে পারে। ডেঙ্গুর অস্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য এডিস মশাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।
রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এসএম আলমগীর বলেন, এবারের ডেন-৩ সংক্রমণ হচ্ছে। এ পর্যন্ত তারা যতগুলো নমুনা পরীক্ষা করেছেন তার মধ্যে ডেন-৩ পাওয়া গেছে।
তিনি বলেন, করোনার কারণে এখন সবাই বাসায় থাকে, তাই সংক্রমণ বেশি হচ্ছে। যেহেতু শিশুরা বাসায় থাকে তাই তাদের আক্রান্তের ঝুঁকি বেশি।
ড. আলমগীর বলেন, ডেঙ্গুতে মৃত্যুর অন্যতম কারণ দেরিতে ডাক্তারের কাছে যাওয়া। জ্বর হলেই করোনা ও ডেঙ্গি পরীক্ষা করাতে হবে। যদি প্রথমবার ডেঙ্গি ইনফেকশন হয় তাহলে তেমন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তবে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হলে হেমোরেজিক ফিভার বা শক সিনড্রোম দেখা দিতে পারে।
তিনি বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে প্রথমে ১০৪ থেকে ৫ ডিগ্রি পর্যন্ত জ্বর ওঠে। তিন থেকে পাঁচ দিন এই জ্বর থাকে। জ্বর কমলে অনেকে মনে করেন তিনি সুস্থ হয়ে উঠেছেন। কিন্তু এই সময় সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। কারণ জ্বর কমার পরেই ডেঙ্গু রোগীর বিপজ্জনক সময় শুরু হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে করণীয় কী
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিটি করপোরেশনের অবহেলা ও অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের কারণে এডিস মশার প্রাদুর্ভাব লক্ষণীয়। বছরজুড়ে যেখানে মশক নিধন চলার কথা থাকলেও দুই সিটি করপোরেশন এই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে ডেঙ্গু প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। এতে সংক্রমণ রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের (সিডিসি) তথ্যমতে, বিশ্বের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ ডেঙ্গুপ্রবণ এলাকায় বসবাস করে। এশিয়া, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল, আমেরিকা, আফ্রিকা ও ক্যারেবীয় অঞ্চলের প্রায় ১০০টি দেশে এ রোগের বিস্তার রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে প্রতিবছর ৫ থেকে ১০ কোটি মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়। যার মধ্যে ৫ লাখ মানুষ হেমোরেজিক জ্বরে ভোগেন আর কমপক্ষে ২২ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। যাদের মধ্যে একটি বড় অংশই শিশু।
জানতে চাইলে সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজের (সিজিএস) চেয়ারম্যান ও কীটতত্ত্ববিদ ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, এই মুহূর্তে প্রয়োজন উড়ন্ত (অ্যাডাল্ট) মশা মারা। কারণ উড়ন্ত মশা আক্রান্ত করছে এবং রোগ ছড়িয়ে দিচ্ছে। যেসব এলাকা থেকে রোগী বেশি আসছে সেসব এলাকায় ওষুধ সপ্তাহে তিন দিন (প্রথম, তৃতীয় ও সপ্তম) ছিটাতে হবে। একটি মশা ৩ থেকে ৪ সপ্তাহ বাঁচলে মানবদেহ থেকে একাধিকবার রক্ত নেবে এবং একাধিক মানুষকে আক্রান্ত করবে।
ড. মঞ্জুর বলেন, অ্যাক্টিভ ক্লাস্টারে (যেখান থেকে রোগী পাওয়া যায়) বাড়তি এবং বাড়ির বাইরে সব মশা মেরে ফেলতে হবে। সব এডাল্ট মশা মেরে ফেলতে হবে- নয়তো ‘ট্রান্সমিশন চেইন’ বন্ধ করা সম্ভব হবে না। ঢাকায় ডেঙ্গু এপিডেমিক (মহামারি) পর্যায়ে চলে গেছে। তাই এটি নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। যদি দেখা যায়, সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার পরে অ্যাক্টিভ ক্লাস্টার থেকে দুই সপ্তাহে রোগী আসছে না, তাহলে বুঝতে হবে নিয়ন্ত্রণে এসেছে।
ড. মঞ্জুর বলেন, ঢাকার বাইরে কুরবানির সময় অনেকে ভাইরাস পরিবহণ করে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে গেছেন। এজন্য দেশের অনেক এলাকায় কিছু কিছু রোগী পাওয়া যাচ্ছে। এটা ওইসব এলাকায় ডেঙ্গুর ফার্স্ট সাইকেল। আগস্টের শেষদিকে শুরু হবে এর সেকেন্ড সাইকেল। তখন পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। তাই ঢাকার বাইরে যেসব এলাকায় ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে, সেই এলাকাগুলোর জনপ্রতিনিধিরা যেন এখনই মশা মারার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. খান আবুল কালাম আজাদ বলেন, ডেঙ্গুর চারটি সোরটাইপ রয়েছে। এর মধ্যে ডেন-২ ও ডেন-৩ এর সংক্রমণ ভয়াবহ হয়। তাই এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ এই দুই ধরনের ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে রোগীরা হেমোরেজিক ও শক সিনড্রোমে পড়তে পারে।
তিনি বলেন, দেশে ভাইরাস রয়েছে এবং মশাও রয়েছে। তাই রোগী হবে এটা নিশ্চিত জেনেই মশা মারার ওপর জোর দিতে হবে। বাড়ির চারপাশ শুষ্ক রাখতে হবে, বাড়ির ভেতরে ও বাইরে নিয়মিত মশা মারার কার্যক্রম চালাতে হবে। এই সময়ে জ্বর হলেও অবশ্যই ডেঙ্গু এবং কোভিড পরীক্ষা করাতে হবে।
ডেঙ্গু পজিটিভ হলে যদি ওয়ার্নিং সাইন দেখা না দেয় (তীব্র জ্বর, মাধাব্যথা, প্রচণ্ড পেটে ব্যথা, শরীর থেকে রক্ত নির্গত হওয়া) তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শে বাসায় চিকিৎসা নিতে হবে। যদি এ ধরনের কোনো লক্ষণ দেখা দেয় তাহলে হাসপাতালে যেতে হবে। যেহেতু বৃদ্ধ এবং শিশুরা ডেঙ্গুতে বেশি আক্রান্ত হন তাই বাসা মশামুক্ত রাখতে হবে, প্রয়োজনে মশারির মধ্যে থাকতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৩১৮
আপনার মতামত জানানঃ