ফেসবুকে কতটা নিরাপদ আমাদের তথ্য, তা নিয়ে আলোচনা দীর্ঘদিনের। বারবার বিঘ্নিত হয়েছে নিরাপত্তা। কখনও হ্যাকারদের দ্বারা; তো কখনও ফেসবুকে কর্মরতদের দ্বারা। এবার নারীদের উপর গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ ফেসবুক ইঞ্জিনিয়ারদের উপর। ফেসবুকের অভ্যন্তরীণ সিস্টেমে রয়েছে তথ্যের বিশাল ভান্ডার; যেখানে ব্যবহারকারীর বছরের পর বছর ধরে করা ব্যক্তিগত কথপোকথন, কোন কোন ইভেন্টে যোগ দিয়েছেন, কোন কোন পোস্টে মন্তব্য করেছেন সবকিছুই জমা আছে।
ফেসবুকে কর্মরত যেকোনো ইঞ্জিনিয়ার তাই খুব সহজেই জানতে পারেন নির্দিষ্ট কারও ব্যক্তিগত লাইফস্টাইল কেমন, রাজনৈতিকভাবে তিনি কোন পন্থী, কুকুর ভালোবাসেন কিংবা দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় ছুটি কাটাতে ভালোবাসেন ইত্যাদি বহু বিষয়। দীর্ঘদিন মেশার পরে যেসব তথ্য কারো পক্ষে জানা সম্ভব হতো; তা তারা কয়েক মিনিটে ফেসবুক থেকে জেনে নিতে পারেন।
নিরাপত্তা বলয় নেই ফেসবুকে
ফেসবুকের ব্যবস্থাপকেরা জানিয়ে দিয়েছিলেন যে তাদের কর্মীরা ফেসবুকের সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে কারো ব্যক্তিগত তথ্য নেয়ার বা অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছেন জানা গেলে ওই কর্মীকে বরখাস্ত করা হবে। কিন্তু ব্যবস্থাপকেরা এটাও জানতেন যে, এই অপরাধ থামানোর জন্য কোনো নিরাপত্তা বলয় ফেসবুকের নেই।
তাদের সিস্টেম এমনভাবে তৈরি যেখানে কর্মীরা সব জায়গায় খোলামেলা প্রবেশাধিকার পায়। কর্মীরা যাতে স্বাধীনভাবে, দ্রুত কাজ করতে পারে এবং আরও কর্মদক্ষতা দেখাতে পারে, সেই লক্ষ্যে জাকারবার্গ এই পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এই নিয়ম করা হয়েছিল, যখন ফেসবুকের কর্মী সংখ্যা ছিল মাত্র কয়েক শত।
কিন্তু এরপর হাজারো ইঞ্জিনিয়ার সেখানে কাজ করছেন, তাই একমাত্র কর্মীদের সদিচ্ছাই পারবে তাদেরকে কোন ব্যবহারকারীর গোপন তথ্য নেয়া থেকে বিরত রাখতে।
জানুয়ারি, ২০১৪ থেকে আগস্ট, ২০১৫ পর্যন্ত এই অপরাধে ৫২ জন কর্মীকে ফেসবুক চাকরিচ্যুত করে। এদের মধ্যে অনেকেই শুধু অন্যের গোপন তথ্যে একবার চোখ বুলিয়ে গেছেন অথবা কেউ সামান্য কিছু বেশি দেখেছেন। কিন্তু কেউ কেউ এটিকে চরম পর্যায়ে নিয়ে গেছেন।
নারীদের উপর গুপ্তচরবৃত্তি
এর উপর টেলিগ্রাফে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ফেসবুকের মেনলো পার্কের অফিসে কর্মরত এক ইঞ্জিনিয়ার কদিন আগে ডেট করা এক নারীর উপর নিজের দাপ্তরিক ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে নজর রাখছিলেন। সেই নারী তার কোনো ক্ষুদেবার্তার উত্তর দিয়েছিল না। তাই প্রথম সাক্ষাতটি ভালোয় ভালোয় গেলেও, সেই নারী কেন দ্বিতীয়বার সাক্ষাতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না, তা জানার জন্য ক্ষমতার অপব্যবহার করে ওই ইঞ্জিনিয়ার।
এদিকে, আরও জানা যায় এক ইঞ্জিনিয়ার এমন একজন নারীকে তার সাথে দেখা করতে বাধ্য করেন, যার সাথে তিনি একবার ইউরোপে ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন, কিন্তু ভ্রমণে তাদের দুজনের ঝগড়া হয় এবং ঐ নারী হোটেল ত্যাগ করে নতুন হোটেলে ওঠেন। ইঞ্জিনিয়ার ওই নারীকে ট্র্যাক করে নতুন হোটেলের ঠিকানাও খুঁজে বের করেন।
আরেক ইঞ্জিনিয়ার ডেটে যাওয়ার আগেই জনৈক নারীর ফেসবুক পেজে প্রবেশ করেন। জানতে পারেন যে ঐ নারী প্রতিনিয়ত ডলোরেস পার্কে যান এবং ইঞ্জিনিয়ার একদিন সেখানে গিয়ে হাজির হন।
সূত্র মতে, চাকরিচ্যুত হওয়া ইঞ্জিনিয়াররা নির্দিষ্ট আইডি দেখতে তাদের কর্মস্থলের ল্যাপটপ ব্যবহার করেন। এই অস্বাভাবিক কার্যক্রমের ফলে সেসব ইঞ্জিনিয়ারদের ম্যানেজাররা টের পেয়ে যান যে তারা সীমা লঙ্ঘন করছেন। তবে বাকি আরও কিছু অপরাধীকে কেন ধরা যায়নি তা এখনো অজানা।
যেভাবে সামনে আসলো এই সমস্যা
২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথম মার্ক জাকারবার্গ এই সমস্যার কথা জানতে পারেন। ফেসবুকের তৎকালীন প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা, অ্যালেক্স স্ট্যামোস আসার তিন মাস পরে এটি জাকারবার্গের কানে তোলা হয়।
জাকারবার্গের শীর্ষ কার্যনির্বাহীদের সামনে স্ট্যামোস প্রথম যে প্রস্তাব দিলেন, তা হলো ফেসবুকের তৎকালীন নিরাপত্তা পরিস্থিতির একটি সার্বিক মূল্যায়ন করা। বাইরের কারো দ্বারা এটাই ছিল প্রথম মূল্যায়ন।
এর পরপরই ফেসবুকে শীর্ষ কার্যনির্বাহীদের মধ্যে কানাকানি শুরু হয়ে গেল। তারা ভাবলেন এত অল্প সময়ের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন করাটা অসম্ভব হবে এবং স্ট্যামোস যেই রিপোর্টই দিক না কেন তাতে কিছু ভাসা ভাসা সমস্যা থাকবেই। ফেসবুক তখন সাফল্যের শিখরে, ইনস্টাগ্রামও ততদিনে যুক্ত হয়েছে এ কোম্পানির সাথে এবং এক বিলিয়ন ব্যবহারকারীও জুটে গেছে।
নিরাপত্তার বিষয় এড়িয়ে যাচ্ছে ফেসবুক
সেই সময় রিপোর্টের বদলে স্ট্যামোস ফেসবুকের মূল পণ্যসমূহ, কাজের গতি ও কোম্পানির কাঠামোর নানা সমস্যা নিয়ে বিস্তারিত এক প্রেজেন্টেশন দিয়ে দিলেন। তিনি জানালেন, কোম্পানি তাদের ওয়েবসাইটের নিরাপত্তা নিয়ে এত ব্যস্ত যে হোয়াটস অ্যাপ ও ইনস্টাগ্রামের মত অ্যাপগুলোর নিরাপত্তার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে।
স্ট্যামোসের মতে, ফেসবুকের নিরাপত্তার বিষয়টি পুরো কোম্পানি জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেখাশোনা করা হচ্ছে। তিনি আরও মনে করেন যে, ফেসবুক তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের সাথে টেক্কা দিতে প্রযুক্তিগত বা সাংস্কৃতিকভাবে প্রস্তুত নয়।
স্ট্যামোস আরো জানান যে, ডজনখানেক কর্মীকে চাকরিচ্যুত করার পরেও ফেসবুক আসলে একটা সিস্টেমেটিক সমস্যা সমাধানের কোনো চেষ্টাই করছে না।
ইঞ্জিনিয়াররা কিভাবে নতুন পণ্য তৈরির জন্য তাদেরকে দেয়া ডেটার অপব্যবহার করছেন অন্য ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য নেয়ার মাধ্যমে, সেটিও স্ট্যামোস দেখান। স্বভাবতই, এই বিষয়গুলো সাধারণ মানুষের কানে গেলে তারা ক্ষুব্ধ হবে।
জাকারবার্গ স্ট্যামোসের প্রতিবেদন দেখে যারপরনাই হতাশ ও স্তম্ভিত হয়েছিলেন। তিনি জানতে চেয়েছিলেন, কেন ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবস্থাপনার লোকেরা এসব সমস্যা জানার পরেও তাকে জানাননি এতদিন, কেন কেউ কাজের প্রক্রিয়া পুনঃমূল্যায়নের চেষ্টাও করেননি যাতে এই অপরাধ থামানো যায়।
নতুন নয় এই সমস্যা
নিরাপত্তার সমস্যা নতুন নয়। এ বছরের প্রথম ভাগে ৫৩ কোটি ৩০ লাখ ফেসবুক ব্যবহারকারীর সব তথ্য অনলাইনে ছেড়ে দিয়েছে হ্যাকাররা৷ এর ফলে বিশ্বের শতাধিক দেশের কোটি মানুষের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে৷
জানা যায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের ৫৩৩ মিলিয়ন বা ৫৩ কোটি ৩০ লাখ ব্যবহারকারীর পূর্ণ নাম, ই-মেইল ঠিকানা, ফোন নাম্বার থেকে শুরু করে প্রায় সব তথ্যই একটি হ্যাকিং ফোরামে প্রকাশ করে দেয়া হয়৷
সেখানে ১০৬ টি দেশের ফেসবুক ব্যবহারকারীর তথ্য রয়েছে বলে জানা যায়৷ ৫৩ কোটি ৩০ লাখের মধ্যে তিন কোটি ২০ লাখ যুক্তরাষ্ট্রের, এক কোটি ১০ লাখ যুক্তরাজ্যের, ৬০ লাখ ভারতের এবং ৩৮ লাখ ১৬ হাজার ৩৩৯ জন বাংলাদেশের৷
ফেসবুকের মুখপাত্র লিজ শেফার্ড ব্যবহারকারীদের যাবতীয় তথ্য ফাঁস হওয়ার খবর স্বীকার করে বলেছিলেন, ‘‘তথ্যগুলো পুরোনো, ২০১৯ সালে বিষয়টি জানা যায়৷ ২০১৯ সালের আগস্টে বিষয়টি আমরা জানতে পারি এবং ব্যবস্থা নিই৷”
তবে তথ্য নিরাপত্তা এবং সাইবার অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এক বছর আগের তথ্য হলেও হ্যাকাররা তা ব্যবহার করে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের ক্ষতি করতে পারে৷
এর আগেও অনেকবার ফেসবুক ব্যবহারকারীদের তথ্য ফাঁস হয়েছে৷ ২০১৯ সালে বিশ্বের ২৬ কোটি ৭০ লাখ ফেসবুক ব্যবহারকারীর তথ্য ফাঁস হয়৷ এর এক বছর আগে ব্রিটেনের রাজনৈতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকার বিরুদ্ধে কয়েক কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারীর তথ্য সংগ্রহের অভিযোগ ওঠে৷
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৭৪০
আপনার মতামত জানানঃ