বহুতল সরকারি ভবন নির্মাণে চলছে দুর্নীতি আর অনিয়ম। প্রকল্প ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে দ্বিগুণ। সময়ও লাগছে বেশি। অথচ কোনো কোনো অংশের সাটারিংয়ের কাজে স্টিলের পরিবর্তে বাঁশ ব্যবহার করা হচ্ছে। ঘটনাটি ঘটেছে খুলনায়। বালু-সিমেন্ট-কংক্রিটের নরম মিশ্রণ জমাট বাঁধার জন্য লোহা, কাঠ বা বাঁশ দিয়ে যে সাপোর্ট দেওয়া হয় সেটাই সাটারিং। এই ভবনের সাটারিংয়ের কাজের জন্য স্টিল ব্যবহারের কথা ছিল।
নির্মাণাধীন ১০ তলা ভবনটি খুলনার বাংলাদেশ শিল্প কারিগরি সহায়তা কেন্দ্রের (বিটাক)। ভবনটি নারীদের হোস্টেলের জন্য ব্যবহার করা হবে। এখন ভবনটির পাঁচতলার নির্মাণকাজ চলছে। ‘বিটাক চট্টগ্রাম, খুলনা ও বগুড়া কেন্দ্রে নারী হোস্টেল স্থাপন (প্রথম সংশোধন)’ প্রকল্পের আওতায় খুলনার বিটাক কেন্দ্রে নারী হোস্টেলটি নির্মাণ করা হচ্ছে।
স্টিলের পরিবর্তে বাঁশ
গত জুনে প্রকাশিত পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনে ভবনটি নির্মাণে সাটারিংয়ের কাজে কোনো কোনো অংশে স্টিলের পরিবর্তে বাঁশ ব্যবহারের এই তথ্য উঠে এসেছে।
আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পের ভবন নির্মাণে সাটারিংয়ের কাজে স্টিল ব্যবহারের কথা। কিন্তু খুলনা সাইটে হোস্টেল ভবন নির্মাণকাজে স্টিল সাটার ব্যবহারের সঙ্গে বাঁশের সাটারিং ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে যেকোনো সময় দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে।
আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পের ভবন নির্মাণে সাটারিংয়ের কাজে স্টিল ব্যবহারের কথা। কিন্তু খুলনা সাইটে হোস্টেল ভবন নির্মাণকাজে স্টিল সাটার ব্যবহারের সঙ্গে বাঁশের সাটারিং ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে যেকোনো সময় দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে।
প্রকল্প পরিচালক, খুলনার বিটাক প্রধান ও ঠিকাদার বিষয়টি স্বীকার করলেও কয়টি তলার সাটারিংয়ের কাজে বাঁশ ব্যবহার করা হয়েছে, তা নিয়ে তারা ভিন্ন ভিন্ন তথ্য দিয়েছেন। কেউ বলেছেন, শুধু প্রথম তলায় বাঁশ ব্যবহার হয়েছে। আবার কেউ বলেছেন, প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় বাঁশ ব্যবহার করা হয়েছে।
ঠিকাদার ও প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, সাটারিংয়ের কাজে স্টিলের পরিবর্তে যখন বাঁশ ব্যবহার করা হয়েছে, তখন কোনো সমস্যা হয়নি। তাই এখন আর ঝুঁকি নেই। তা ছাড়া ভবনের বাকি তলার সাটারিংয়ের কাজে স্টিল ব্যবহার করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক এস কে সেকেন্দার আলী বলেন, ‘বাঁশ দিয়ে সাটারিং করলে ফিনিশিংয়ে সমস্যা হয়। মানে ভবনের সার্ফেস স্মুথ হবে না। তবে এটি প্লাস্টার করে ঠিক করা যাবে।’
খুলনা সাইটের বিষয়ে বিটাকের পরিচালক (পরিকল্পনা) ও প্রকল্পের পরিচালক মো. জালাল উদ্দিন বলেন, ‘সাটারিং করে যখন ঢালাই করা হয়, তাতে যে সাপোর্ট দেওয়া হয়, সেখানে উচ্চতার হেরফের ছিল। তাদের (ঠিকাদারের) যে স্টিলের কাঠামো, ওই জায়গায় তারা ম্যাচিং করতে পারছিল না। ঠিকাদার গণপূর্তের সঙ্গে আলাপ করে সে অংশে বাঁশ ব্যবহার করেছে। একটা ফ্লোরের একটা অংশে তারা বাঁশ ব্যবহার করেছে। এখন আর তারা কোনো ফ্লোরে বাঁশ ব্যবহার করছে না। সেই ফ্লোরের কাজটা হয়ে গেছে অনেক আগে। এসব ক্ষেত্রে সঙ্গে সঙ্গে দুর্ঘটনা হয়। যেহেতু তখন দুর্ঘটনা হয়নি, তাই এখন আর হওয়ার আশঙ্কা নেই।’
বিটাকের অতিরিক্ত পরিচালক (অ. দা.) ও খুলনা কেন্দ্রের প্রধান এম মোর্শেদ আলম বলেন, ‘প্রথম দিকে লোহার পরিবর্তে বাঁশ ব্যবহার করেছে ঠিকাদার। ভবনের প্রথম ও দ্বিতীয় তলার কাজে বাঁশ ব্যবহার করা হয়েছিল। তবে দ্বিতীয় তলায় খুব কম বাঁশ ব্যবহার করা হয়েছিল। কিন্তু প্রথম তলায় তারা স্টিলের ফ্রেমের সঙ্গে বাঁশ ব্যবহার করেছিল। তৃতীয় তলা থেকে তারা আর বাঁশ ব্যবহার করেনি। এখন সবই স্টিলের কাঠামো ব্যবহার করছে তারা।’
সাটারিংয়ের কাজে স্টিলের পরিবর্তে বাঁশ ব্যবহার করায় ভবনটি ঝুঁকির মধ্যে পড়ল কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে এম মোর্শেদ আলম বলেন, ‘এটা তো পিডব্লিউডি (গণপূর্ত অধিদপ্তর) ভালো বলতে পারবে। তবে পিডব্লিউডির প্রকৌশলীরা বলেছেন, এতে কোনো সমস্যা নেই।’
প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষায় ত্রুটি থাকায় মূল ডিপিপি অনুমোদনের প্রথম বছরেই সংশোধনের প্রয়োজন দেখা দেয়। প্রথম সংশোধনে প্রকল্পের খরচ দ্বিগুণের বেশি বাড়িয়ে করা হয় ৭৪ কোটি ৫৯ লাখ ৭৮ হাজার টাকা। এ ছাড়া সময় বাড়ানো হয় ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত।
ভবনটির নির্মাণকাজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান শফিক ট্রেডার্স ও মার্ক বিল্ডার্স। তবে ভবনের নির্মাণকাজ করছেন একটি পাটকলের মালিক ফেরদৌস ভূঁইয়া। শফিক ট্রেডার্সের সঙ্গে অংশীদারত্ব রয়েছে জানিয়ে ফেরদৌস ভূঁইয়া বলেন, ‘বাঁশ প্রথমে ব্যবহার করেছিলাম, এটা ঠিক আছে। প্রথম তলায় বাঁশ ব্যবহার করেছিলাম। কিন্তু সেখানে তখন কোনো স্টিল দেওয়ার সুযোগ ছিল না। প্রথম তলা অনেক লম্বা ছিল। ১৪ থেকে ১৫ ফুট। তাই দু-চারটা বাঁশ ব্যবহার করা হয়েছিল। পরে বাঁশ দেওয়া বাদ দিয়েছি। বলার সাথে সাথে আমরা বাঁশ বাদ দিয়ে সব স্টিলের কাজ করছি। এখন পাঁচতলার কাজ চলছে। লকডাউনের মাঝেও কাজ চলছে।’
প্রকল্প ব্যয় বেড়েছে, বেড়েছে সময়
আইএমইডির তথ্যমতে, ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিল্প মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে যান। তখন তিনি বিটাক চট্টগ্রাম, খুলনা ও বগুড়া কেন্দ্রে নারী হোস্টেল স্থাপনের নির্দেশনা দেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে শিল্প মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বাংলাদেশ শিল্প কারিগরি সহায়তা কেন্দ্র প্রকল্পটি ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন মেয়াদে ৩১ কোটি ৬০ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে বাস্তবায়ন শুরু করে।
প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষায় ত্রুটি থাকায় মূল ডিপিপি অনুমোদনের প্রথম বছরেই সংশোধনের প্রয়োজন দেখা দেয়। প্রথম সংশোধনে প্রকল্পের খরচ দ্বিগুণের বেশি বাড়িয়ে করা হয় ৭৪ কোটি ৫৯ লাখ ৭৮ হাজার টাকা। এ ছাড়া সময় বাড়ানো হয় ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত।
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক জালাল উদ্দিন বলেন, ‘গণপূর্তের একটা রেট শিডিউল আছে। ২০১৪ সালের রেট শিডিউল অনুযায়ী প্রাক্কলন করা হয়েছিল। ২০১৪ সালের পরিবর্তে ২০১৮ সালে আরেকটা রেট শিডিউল বের হয়। তখন ব্যয় বেড়ে যায়। প্রথমে ভবনগুলো ৫ তলা করার কথা ছিল। পরে এগুলোকে ১০ তলা করা হয়। এতে ব্যয়ও বেড়ে গেছে। আর ৫ তলা থেকে ১০ তলার অনুমোদন নিতে ১ বছর চলে গেছে।’
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/৩৭৮৫
আপনার মতামত জানানঃ