নাম, পিতার নাম, এলাকার নাম ইত্যাদি নামের সাথে কিঞ্চিৎ মিল থাকার কারণে কর্তৃপক্ষের ভুলে দেশে প্রায়ই নিরপরাধীর সাজা হয়ে থাকে। যেন তদন্ত করে আসল আসামি ধরায় তাদের কোনো আপত্তি আছে, এমনি দায়সারাভাবে আসামি ধরতে গিয়ে ধরে আনেন অন্যকোনো নিরীহ। সম্প্রতি এমনি আরেক ঘটনা ঘটেছে। নামের মিল থাকায় ১৬ মাস ধরে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে নগরের কর্ণফুলী থানার একটি মাদক মামলায় সাজা খাটছেন হাসিনা বেগম নামের এক নারী। প্রকৃত আসামি হাসিনা আক্তার পলাতক রয়েছেন।
দুজনের বাড়ি কক্সবাজারের টেকনাফ পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডে। দুজনের স্বামীর নামও হামিদ হোসেন। তবে শ্বশুরের নাম ও বাড়ির ঠিকানা আলাদা। হাসিনা বেগমের শ্বশুরের নাম মৃত কবির আহম্মদ আর হাসিনা আক্তারের শ্বশুরের নাম মৃত জলিল আহমেদ।
আদালত সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি নগরের কর্ণফুলী থানার মইজ্জারটেক এলাকায় ২ হাজার ইয়াবা বড়ি নিয়ে স্বামী ও দুই সন্তান মো. আনিস, নুর ফাতেমাসহ গ্রেপ্তার হন ২৭ বছরের হাসিনা আক্তার। এই ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করে। তদন্ত শেষে হাসিনা ও তার স্বামী হামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ।
ওই বছরের ২৭ নভেম্বর জামিনে মুক্তি পান তারা স্বামী-স্ত্রী। পরে পলাতক হয়ে যান। আসামিরা পলাতক থাকা অবস্থায় ২০১৯ সালের ১ জুলাই পঞ্চম অতিরিক্ত চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ হাসিনা ও তার স্বামী হামিদকে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন। পরে তাদের সাজা পরোয়ানাগুলো আদালত থেকে টেকনাফ থানায় যায়।
থানা-পুলিশ সাজা পরোয়ানায় ২০১৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর টেকনাফ পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ইসমাঈল হাজিবাড়ির হাসিনা বেগমকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায়। কিন্তু প্রকৃত আসামি একই এলাকার চৌধুরীপাড়ার হাসিনা আক্তার ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়।
এদিকে কারাগারে থাকা হাসিনা বেগম গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার স্বামী হামিদ পরিবার ছেড়ে চলে যান। তার দুই মেয়েকে দেখাশোনা করছেন শাশুড়ি হাজরা খাতুন। বড় ছেলে শামীম নেওয়াজ চট্টগ্রাম শহরে এক ব্যক্তির বাসায় কাজ নেন। ওই বাসার গৃহকর্তার মাধ্যমে একজনের সাজা আরেকজন খাটার বিষয়টি জানতে পারেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী গোলাম মুরাদ। এরপর তিনি সবকিছু যাচাইবাছাই করে নিশ্চিত হওয়ার পর গত ২২ মার্চ আদালতে হাসিনা বেগমের মুক্তির জন্য আবেদন করেন। আদালত টেকনাফ থানা-পুলিশকে তদন্তের নির্দেশ দেন।
তদন্ত শেষে টেকনাফ থানার পরিদর্শক (অভিযান) খোরশেদ আলম আদালতে প্রতিবেদন দেন গত বৃহস্পতিবার। সেখানে বলা হয়, প্রকৃত আসামি হাসিনা আক্তার। তার পরিবর্তে জেলে আছেন হাসিনা আক্তার। দুজনের স্বামীর নাম মিল থাকলেও শ্বশুরের নামের পার্থক্য রয়েছে। ছেলে-মেয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে।
হাসিনা বেগমকে আইনি সহায়তা করা আইনজীবী গোলাম মুরাদ প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের প্রতিবেদনটিসহ আজ রোববার(গতকাল) চতুর্থ অতিরিক্ত চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতে জামিনের আবেদন করা হয়। আদালত চট্টগ্রাম কারা কর্তৃপক্ষকে ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার হওয়া হাসিনা আক্তারের আর তার পরিবর্তে গ্রেপ্তার হওয়া হাসিনা বেগমের ছবির মিল আছে কি না, কারা নিবন্ধন যাচাইবাছাই করে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেন। আগামী মঙ্গলবার প্রতিবেদনের জন্য দিন ধার্য রেখেছেন। প্রকৃত আসামিকে না ধরে নিরীহ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি জড়িত পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আবেদন করা হবে ওই দিন।
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক মো. শফিকুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, দুজনের ছবির মধ্যে মিল নেই। আরও যাচাইবাছাই করে আদালতে প্রতিবেদন দেওয়া হবে।
সাজা ভোগ করা হাসিনা বেগমের ছেলে শামীম নেওয়াজ বলেন, ‘মা গ্রেপ্তার হলে বাবা আমাদের ছেড়ে চলে যায়। দুই বোন নানির কাছে। আমি মানুষের বাসায় কাজ করি। আমার মাকে মুক্তি দিয়ে আমাদের পরিবারটি রক্ষা করা হোক।’
এর আগে গত মার্চ মাসে চট্টগ্রাম কারাগারে একজনের সাজা আরেকজন খাটার ঘটনা জানাজানি হয়। খুনের মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কুলসুমা আক্তার তার জায়গায় তিন বছর ধরে সেই সাজা খাটছেন মিনু আক্তার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনের ভাষায় একটা কথা বিশ্বব্যাপী প্রচলিত আছে, প্রয়োজনে দশজন অপরাধী ছাড়া পেয়ে যাক তবুও যেন একজন নিরপরাধীর সাজা না হয়। বিশ্বের সমস্ত বিচার ব্যবস্থায় এই কথাটি মোটা অক্ষরে স্মরণে রাখা হয়। নিরপরাধীর সাজা যেন না হয় সেজন্য সজাগ দৃষ্টি রাখা হয়। তারিখের পর তারিখ, বিভিন্ন সাক্ষ্য প্রমাণ যাচাই বাছাই শেষে আদালত এইজন্যই বিচারের রায় প্রদান করে থাকেন যাতে ফাঁক-ফোঁকরে কোনো নিরপরাধীর সাজা না হয়ে যায়। বাংলাদেশেও এই রীতি রয়েছে। তবুও কোথায় কার যেন ভুলে কীভাবে যেন নিরপরাধীর সাজা হয়ে যায়। এদেশে এই সংখ্যাটা নেহাত কম নয়।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশে নিরপরাধীর সাজাভোগের উদাহরণ খুঁজে দেখলে দেখা যাবে প্রকৃত আসামির সংখ্যার চেয়ে অতো একটা কম নয়।
তারা জানান, একটা মানুষের খুন হওয়ার ঘটনা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, দ্রুততম সময়ে আসামির ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাও তেমনি গুরুত্বপূর্ণ। বছরের পর বছর কারাভোগের পর কেউ খালাস পেলেও তাকে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এবিষয়ে উচ্চ মহলের কড়া নজরদারির আহ্বান জানান তারা।
তারা বলেন, স্পষ্টত হয়রানির উদ্দেশ্যে বিচারব্যবস্থার নামে এমন অপব্যবহার আশঙ্কাজনক। এই অপব্যবহার রোধে আদালতের নির্দেশ অনুসারে ওই ঘটনার দ্রুত ও সুচারু তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। যাতে এর সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত হয়। একই সঙ্গে ভুক্তভোগীকে কয়েক লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তারা।
তবে বিচারকদের সদিচ্ছার ঘাটতি আছে বলে মনে করেন না তারা। কিন্তু জনসংখ্যা, অপরাধ ও যে হারে মামলা বাড়ছে, সেই তুলনায় বিচারকসহ অন্যান্য অবকাঠমো বাড়ছে না। ফলে মামলার চাপ রয়ে গেছে এবং এ ধরনের সমস্যা হচ্ছে বলে মনে করেন।
তারা মনে করেন, মামলার গুরুত্ব এবং জঘন্যতম অপরাধী না হলে সেগুলো পৃথক করে দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিতে হবে। আসামি দীর্ঘদিন কারাগারে থাকলে এবং সদাচরণ করলে সরকার মুচলেকা নিয়ে তাদের প্যারোল দিতে পারে। তাহলে কারাগারে আসামির সঙ্গে দুর্ভোগও কমে আসবে। প্রয়োজনে মামলার চাপ ও ভুক্তভোগীদের দুর্ভোগ কমাতে সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিশন করা যেতে পারে। তারা মনে করেন, বিচারের নামে তো অবিচার কারও কাম্য নয়। এ অবস্থা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া দরকার।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৫৪
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ