পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস প্রত্যাশার চেয়ে বড় জয় পেলেও নিজ আসনে হেরে গেছেন দলটির নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নন্দীগ্রামে নিজের আসনে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হেরে যাওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে— দল সরকার গঠন করলে তিনি কি মুখ্যমন্ত্রী হতে পারবেন? মমতার মুখ্যমন্ত্রিত্ব নিয়ে সেই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে দেখতে হবে দেশটির সংবিধান এ সম্পর্কে কি বলা হয়েছে।
ভারতীয় সংবিধানের ১৬৩ ও ১৬৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হতে হলে ভারতের নাগরিক হতে হবে এবং বয়স হতে হবে ২৫ বা তার বেশি। এছাড়া হতে হবে বিধানসভার সদস্য। তবে শর্তসাপেক্ষে বিধানসভার সদস্য না হয়েও মুখ্যমন্ত্রী হওয়া যাবে।
বিধানসভার সদস্য না হয়েও কেউ যদি মুখ্যমন্ত্রী পদে বসেন, সেক্ষেত্রে তাকে নিতে হবে রাজ্যপালের অনুমতি। হেরে যাওয়ার পরও দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে এবং দলের বিধায়করা কাউকে নেতা নির্বাচিত করলে তার মুখ্যমন্ত্রী হতে আইনগত কোনো বাধা নেই।
তবে ভোটে না জিতেও মুখ্যমন্ত্রী হলে তাকে ওই পদে বসার ১৮০ দিন অর্থাৎ ছয় মাসের মধ্যে যে কোনো একটি আসন থেকে জিতে আসতে হবে। তা না পারলে ছেড়ে দিতে হবে পদ। ফলে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সাংবিধানিকভাবে মুখ্যমন্ত্রী হতে কোনো বাধা নেই।
ভারতীয় গণমাধ্যম এবিপি-আনন্দের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সে ক্ষেত্রে মমতাকে নির্বাচনের পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে যে কোনো একটি আসন থেকে উপনির্বাচনে জিতে আসতে হবে। তার জন্য তৃণমূলের কোনো একজন নির্বাচিত বিধায়ককে পদত্যাগ করতে হবে। উপনির্বাচনে জয় পেলে মমতা অনায়াসে পাঁচ বছরের জন্য মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলাতে পারবেন।
এদিকে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার ২৯৪ আসনের মধ্যে এবার প্রার্থীর মৃত্যু হওয়ায় দুটি আসনের ভোটগ্রহণ স্থগিত রয়েছে। ফলে এর মধ্যে একটি আসনে ছয় মাসের মধ্যে জিতে এলেই মমতার মুখ্যমন্ত্রী পদে থাকার বাধা কাটবে।
তিন দশকের বাম শাসনের অবসান ঘটিয়ে ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হন মমতা। ভারতীয় গণমাধ্যমের খবর, ওই সময় তিনি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলেন। ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটে তিনি লড়েননি। পরে দল জয় পেলে তাকে মুখ্যমন্ত্রী পদে মনোনয়ন দেন তৃণমূলের বিধায়কেরা । এরপর লোকসভা থেকে পদত্যাগ করেন মমতা।
ভবানীপুরে সুব্রত বক্সির জেতা আসনে উপনির্বাচনে জিতে আসেন তিনি। পরে ২০১৬ সাল পুনরায় মুখ্যমন্ত্রী হন তিনি।
এবার নন্দীগ্রাম থেকে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন মমতা। প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিজেপির শুভেন্দু অধিকারী। শুভেন্দু এক সময় মমতার ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিলেন। এবার ভোটের আগে বিজেপিতে যোগ দেন তিনি। নন্দীগ্রামে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে মমতা-শুভেন্দুর।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে সবচেয়ে হাইভোল্টেজ আসন নন্দীগ্রাম নিয়ে গতকাল সারাদিন চলে নানা নাটকীয়তা। তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জয়ী ঘোষণার পর শুরু হয় টানাপোড়েন। রাতে নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করে— নন্দীগ্রামে ১৭৩৬ ভোটে জিতেছেন বিজেপি প্রার্থী শুভেন্দু অধিকারীই। এদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় কমিশনের প্রকাশ করা তথ্যে দেখা যায়, নন্দীগ্রামে এক লাখ ৯ হাজার ৬৭৩ ভোট পেয়েছেন শুভেন্দু। মুখ্যমন্ত্রী মমতা পেয়েছেন এক লাখ ৭ হাজার ৯৩৭ ভোট। সংযুক্ত মোর্চা সমর্থিত মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায় ছয় হাজার ১৯৮ ভোট পেয়েছেন। এরপর রাতেই ওই আসনের ভোট পুনর্গণনার আবেদন করে তৃণমূল। তবে তা খারিজ করে দিয়েছে কমিশন।
ভোট গণনা বন্ধ ও স্থগিতের পর নির্বাচন কমিশন পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার নন্দীগ্রাম আসনে বিজেপির প্রার্থী শুভেন্দু অধিকারীকে বিজয়ী ঘোষণা করেছে। তার এক সময়ের ‘ডানহাত’ ও সম্প্রতি দল বদলে বিজেপিতে যাওয়া শুভেন্দুর কাছে হেরেছেন মমতা।
ঘোষণার পর তৃণমূল কংগ্রেস জানায়, এর বিরুদ্ধে তারা আদালতে যাবে। এরপরই ভারতের নির্বাচন কমিশন ভোট পুনর্গণনা বিষয়টি বিবেচনা করছে। যে কারণে নন্দীগ্রামের ফল নিয়ে ধোঁয়াশার তৈরি হয়েছে। যদিও মমতা ব্যানার্জি বলেছেন, নন্দীগ্রামের মানুষ যে রায় দিয়েছে তা আমি মাথা পেতে নেব।
তিন যুগের বাম শাসনের অবসান ঘটিয়ে ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় বসে। ২০১৬ সালের নির্বাচনেও ক্ষমতা ধরে রাখে তৃণমূল।
২০১৬ সালের নির্বাচনে ২৯৪ আসনের মধ্যে তৃণমূল পেয়েছিল ২১১টি আসন। বিজেপি সেবার জিতেছিল মাত্র ৩টি আসনে। আর কংগ্রেস ৪৪টি এবং বাম ফ্রন্ট ৩২টি আসন জিতেছিল।
তবে এবার মমতার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে আসে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি। এবারই মমতাকে ক্ষমতা থেকে হটানোর ঘোষণা দিয়ে নামেন বিজেপি নেতারা। মহামারীর মধ্যেও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী থেকে শুরু করে বিজেপির শীর্ষ নেতারা বারবার পশ্চিমবঙ্গ সফর করেন।
তবে এবার বিধানসভার নির্বাচনে ২১০টির বেশি আসন পেয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসল মমতা বন্দোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস।
আনন্দবাজার জানায়, এ নির্বাচনে ৫০ ভাগ ভোট পড়েছে নারীদের। জয়ের বন্দরে পৌঁছে দিতে তারাই ভূমিকা রেখেছেন বলে জানান খোদ মমতা। ৭৫টির বেশি আসনে জিতে বিরোধী দল এবার বিজেপি।
এদিকে জানা গেছে, ২০১১ সালে গো-হারা হয়ে বামফ্রন্ট সমর্থকরা মমতার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপিকে ঢালাওভাবে ভোট দিয়েছেন। সেই বামফ্রন্ট এবার হিন্দুত্ববাদী বিজেপিকে আটকাতেই ঢালাওভাবে তৃণমূলকে ভোট দেওয়ার ফলেও তৃণমূলের কাছে এ জয়ের রাস্তা তৈরি হয়েছে বলেও অনেকে মনে করছেন। যদিও এবার তারা বিধানসভার একটি আসনও না পেয়ে রাজনৈতিকভাবে চরম অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে।
অন্যদিকে ২০০ আসনে জয় নিয়ে তৃণমূলকে হটিয়ে বাংলার মসনদে বসার যে আত্মবিশ্বাসের ঢেকুর তুলেছিলেন বিজেপি, তাদের খুশি থাকতে হচ্ছে মমতার বিরোধীদলের চেয়ার নিয়েই।
রাজ্যটিতে গত ২৭ মার্চ থেকে ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত আট দফায় ভোট হয় ২৯২টি আসনে। করোনায় দুজন প্রার্থী মারা যাওয়ায় দুটি আসনে ভোটগ্রহণ স্থগিত করে নির্বাচন কমিশন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩১২
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ