দেশে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ আসার পর ভয়াবহ গতিতে ছড়াচ্ছে সংক্রমণ। ‘হট স্পট’ ঢাকার বাইরে বিভাগীয় শহর, জেলা-উপজেলায়ও করোনার সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী। কোথাও কোথাও সংক্রমণ কয়েক দিনের ব্যবধানে লাফিয়ে বহু গুণ বেড়েছে। চট্টগ্রামে এপ্রিলের ১২ দিনে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৪১ জন। প্রতিদিনই নতুন রেকর্ড করছে।
গত বছরের চেয়ে এ বছরের সংক্রমণের মাত্রা দ্বিগুণ গতি পেয়েছে। আক্রান্ত বাড়তে থাকায় চাপ বাড়ছে হাসপাতালে। কোনো কোনো হাসপাতালে তো রোগী ধারণের জায়গাই নেই। এ ছাড়া আইসিইউ শয্যা সংকটে সেবা পাচ্ছেন না গুরুতর রোগীরা। ফলে মৃত্যু বাড়ছে।
গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ৬ জন নগরের ও একজন উপজেলা পর্যায়ের বাসিন্দা। একই সময়ে ২ হাজার ৬০৩ জনের নমুনা পরীক্ষা করে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত শনাক্ত হয়েছেন ৫৪১ জন। নতুন শনাক্তদের মধ্যে ৪৫২ জন নগরের ও ৮৯ জন উপজেলার বাসিন্দা।
সোমবার (১২ এপ্রিল) দুপুরে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি এসব তথ্য জানান। তিনি জানান, চট্টগ্রামে এ পর্যন্ত শনাক্ত ৪৪ হাজার ৮৬০ জনের মধ্যে ৩৫ হাজার ৩৫০ জন নগরের ও ৮ হাজার ৭৫৯ জন উপজেলা পর্যায়ের বাসিন্দা। এখন পর্যন্ত করোনায় মারা গেছেন মোট ৪৩০ জন। এর মধ্যে ৩১৫ জন নগরের ও ১১৫ জন উপজেলার বাসিন্দা।
সিভিল সার্জন জানান, নতুন শনাক্ত ৫৪১ জনের মধ্যে ১২৭ জনের বয়স ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। এছাড়া ২১ থেকে ৩০ বছর বয়সী ১০৭ জনও নতুন শনাক্তদের মধ্যে আছেন। ৬০ বছরের বেশি ৯৪ জন মানুষ আছেন নতুন আক্রান্তের তালিকায়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবে ২৯৭ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ১২১ জন, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল এন্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস (বিআইটিআইডি) ল্যাবে ৭৫৯ জনের নমুনা পরীক্ষায় ৭৯ জন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) ল্যাবে ৪৩৮ জনের নমুনা পরীক্ষায় ২৮ জন এবং চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি এন্ড এনিম্যাল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় (সিভাসু) ল্যাবে ২৮৯ জনের নমুনা পরীক্ষায় ৯৫ জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়েছে।
এছাড়া ইম্পেরিয়াল হাসপাতাল ল্যাবে ৩২১ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ১০৩ জন, শেভরণ ক্লিনিক্যাল ল্যাবরেটরিতে ৪৩২ জনের নমুনা পরীক্ষায় ৮৮ জন, চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল ল্যাবে ৫১ জনের নমুনা পরীক্ষায় ২৩ জন এবং জেনারেল হাসপাতালের রিজিওনাল টিবি রেফারেল ল্যাবরেটরিতে (আরটিআরএল) ১৬ জনের নমুনা পরীক্ষায় ৪ জনের শরীরে করোনা ধরা পড়েছে। তবে এদিন কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ ল্যাবে চট্টগ্রামের কোনো নমুনা পরীক্ষা হয়নি।
আইসিইউর জন্য হাহাকার
চট্টগ্রামে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে করোনা রোগী। এদের অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক হলেও হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল ঘুরে স্বজনরা আইসিইউ জোগাড় করতে পারছেন না। আইসিইউ শয্যার জন্য গোটা জেলায় হাহাকার চলছে। এমন পরিস্থিতিতে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এক বছরেও আইসিইউ শয্যা না বাড়ায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, চট্টগ্রামে করোনা রোগীদের জন্য এতদিন ২০টি আইসিইউ শয্যা ছিল। গত বৃহস্পতিবার ৮টি শয্যা বাড়ানো হয়। এর সবই সরকারি ব্যবস্থাপনায় কভিড বিশেষায়িত জেনারেল হাসপাতাল ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের। বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে আরও ৭০টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে। কিন্তু গতকাল রবিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত জেলার সরকারি-বেসরকারি কোনো হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা ফাঁকা পাওয়া যায়নি। ফলে স্বজনরা অনেক ঘুরেও রোগীকে ভর্তি করাতে পারছেন না। করোনা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। এর ফলে হাসপাতালের ওপর চাপ বাড়ছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ অসহায়ত্ব প্রকাশ ছাড়া কিছুই করতে পারছে না বলে অভিযোগ করছেন রোগীর স্বজনরা।
গত বছর করোনার প্রকোপ বাড়লে আইসিইউ সংকট দেখা দেয়। এ সময় চমেকে ১০টি ও জেনারেল হাসপাতালে ১০টি আইসিইউ শয্যার ব্যবস্থা করা হয়। তবে দ্বিতীয় ঢেউয়ে রোগী বাড়তে থাকলে গত বৃহস্পতিবার মামলা জটিলতায় দীর্ঘ পাঁচ বছর গুদামে আটকে থাকা ৮টি আইসিইউ শয্যা চালু করা হয়। সোম-মঙ্গলবার থেকে এখানে রোগী ভর্তি করা হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট কর্র্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
গতকাল সকালে চট্টগ্রামের বিশেষায়িত কভিড জেনারেল হাসপাতালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, আইসিইউর জন্য হাহাকার করছেন রোগীর স্বজনরা। নগরীর কোতোয়ালির এক রোগীর স্বজন হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘আন্টির জন্য আইসিইউ প্রয়োজন। এখানকার ১০টিতেই রোগী রয়েছে। শনিবার থেকে রবিবার (গতকাল) সকাল পর্যন্ত তিন রোগীর মৃত্যু হয়। এরপর সিরিয়ালে আগে থাকা রোগীদের আইসিইউ শয্যায় স্থানান্তর করা হয়।’
জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. তানজিমুল ইসলাম বলেন, ‘কোনো রোগী মারা গেলেই কেবল অপেক্ষমাণদের আইসিইউতে স্থানান্তর করতে পারছি। কারণ এখানে একটি আইসিইউ শয্যাও খালি নেই। যে হারে রোগী বাড়ছে, তা খুবই উদ্বেগজনক। নতুন যুক্ত হওয়া ৮টি আইসিইউ শয্যা সোম অথবা মঙ্গলবার থেকে চালু করা সম্ভব হবে।’
জনস্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব ডা. সুশান্ত বড়ুয়া বলেন, ‘করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিভিন্ন দেশের পরিস্থিতি খারাপ হলেও তা থেকে আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কোনো শিক্ষা নেয়নি। ফলে এক বছরেও বাড়েনি আইসিইউ শয্যা। এজন্য চিকিৎসা ছাড়াই রোগীদের মরতে হচ্ছে।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৯১৩
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ