মোঘল আমলে বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে নির্মিত দূর্গ ‘লালবাগ কেল্লা। বাংলা ও বাঙালি মুসলিমের ইতিহাসের অনেক কিছুকেই ধারণ করছে এই প্রাচীন ও জননন্দিত স্থাপনা। তবে কালের আঘাতে এব সরকারের যথাযথ পরিকল্পনা না থাকায় এই স্থাপনার অনেক কিছু ইতিমধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে বা হারিয়ে গেছে। ভবনগুলো জরাজীর্ণ। ছাদে ফাটল ধরেছে, সিঁড়িগুলো ক্ষয়ে যাচ্ছে, কার্নিশগুলো দুর্বল হয়ে পড়ছে। কেল্লাটির ভেতরে থাকা তিনটি স্থাপনার মধ্যে অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত অংশ হাম্মামখানা। দ্বিতল এই হাম্মামখানাটি নতুন করে সংস্কার ও সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
বাংলাদেশে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের ‘অ্যাম্বাসাডরস ফান্ড ফর কালচারাল প্রিজারভেশন (অঋঈচ)’-এর সহযোগিতায় ‘গবেষণা, ডকুমেন্টেশন, সংস্কার ও সংরক্ষণ’ শীর্ষক এ প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়েছে। লালবাগ কেল্লার সাংস্কৃতিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক প্রামাণ্য সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় ২০২২ সালের অক্টোবরে শেষ হবে এ হাম্মামখানার ডকুমেন্টেশন, সংস্কার ও সংরক্ষণের কাজ।
গতকাল বুধবার সকালে হাম্মামখানার ছাদে আলোকচিত্র ধারণকারী কয়েকটি ড্রোন চালিয়ে প্রকল্পের কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ ও বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে গবেষণা ও ডকুমেন্টেশনের মাধ্যমে এই ভবনের পরিপূর্ণ সংস্কার পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং ইতোপূর্বে শনাক্তকৃত ক্ষতি প্রশমনের নিমিত্তে জরুরি কিছু সংস্কার-সংরক্ষণ কাজ সম্পাদন। প্রকল্পের আওতায় যে কাজগুলো সম্পন্ন হবে সেগুলো হচ্ছে-হেরিটেজ ইম্প্যাক্ট এসেসমেন্ট, ত্রিমাত্রিক স্থাপত্তিক ডকুমেন্টেশন, হাম্মানখানা ভবনের সংস্কার ও সংরক্ষণ এবং ভবনের বৈদ্যুতিক কাজ ও পানি নিষ্কাসন ব্যবস্থার উন্নয়ন। জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীতে এমন একটি মহতী কাজে সহায়তার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার বলেন, লালবাগ কেল্লার হাম্মানখানার সংস্কার ও সংরক্ষণ প্রকল্পটি বাংলাদেশের মানুষের জন্মগত অধিকার রক্ষায় আমেরিকার অংশিদারিত্বের আরও একটি সাক্ষ্য। বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও মূল্যবোধের মধ্যে গ্রথিত আমাদের বন্ধুত্বকে আরও জোরদার করার জন্য এর চেয়ে ভালো সময় আর নেই। লালবাগ কেল্লার সামাজিক মূল্য রয়েছে। এটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও স্থাপত্যশৈলী আমাকে মুগ্ধ করেছে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় নিজের সফরের বিষয় তুলে ধরে রাষ্ট্রদূত বলেন, লালবাগ কেল্লায় এটা আমার প্রথম সফর। তবে এদেশের প্রতিটি বিভাগেই আমি একবার করে গিয়েছি। এদেশের আঞ্চলিক গান আমার খুবই ভালো লাগে এবং আঞ্চলিক খাবারগুলোও খুবই সুস্বাদু। এমন একটি ঐতিহাসিক স্থাপত্যশৈলীর সংস্কার কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরে যুক্তরাষ্ট্র সরকার গর্বিত।
কয়েক বছর আগে বুয়েটের একটি দল দ্বিতীয়তলাটি পরীক্ষা করে এটি ঝঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে বলে জানা যায়। তার পর থেকেই এখানে সাধারণের প্রবেশ বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। তবে বর্তমান সংস্কার কাজের অংশ হিসেবে দ্বিতীয়তলার কাজও করা হবে বলে জানা যায়। দ্বিতীয়তলায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে মেঝের অনেক অংশেই ফাটল রয়েছে। অনেক দেয়ালের আস্তরণ খসে গেছে। পাশাপাশি সিলিংয়ের অংশ চুয়ে পানি পড়ে দেখা যায়। সংস্কার হবে ওপরে ছাদের অংশেও। কেল্লার ভেতর পরী বিবির সমাধির অংশে বেশকিছু অংশে পাথরের জালি রয়েছে যেগুলো দিয়ে আলো-বাতাস চলাচল করে। একই ধরনের লোহার জালি থাকার কথা দরবার হল ও হাম্মামখানার অংশেও। কিন্তু সেখানে আগে যে সংস্কার কাজ করা হয়েছিল তাতে শুধু পরী বিবির সমাধির আদলে কাজ রয়েছে যা সিমেন্টের। সেখানে আলো-বাতাস প্রবেশেরও কোনো সুযোগ নেই।
বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে মানুষের উদ্বেগ-আপত্তির শেষ নেই। মুসলিমপ্রধান সমাজ হওয়ায় ইরাক আক্রমণ ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা একেবারেই তলানিতে। এ অবস্থায় মুসলিম স্থাপত্য হিসেবে চিহ্নিত একটি প্রাচীন স্থাপনা সংস্কারের জন্য মার্কিন অনুদান অনেকের মধ্যে কৌতূহল সৃষ্টি করেছে। জানা গেছে, অনুদানের অর্থের পরিমাণ প্রায় দেড় কোটি টাকা।
কলেজ শিক্ষার্থী ইরফান হোসেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ অনেক ক্ষেত্রেই যে এগিয়ে আছে, এটা এলাকার লোকজন বলছেন। তারা অমুসলিম হয়েও লালবাগ কেল্লার মতো মসজিদে টাকা দিয়েছেন, এতে সবাই অবাক হয়েছে এবং প্রশংসাও করেছে। তবে টাকার যা অঙ্ক, তাতে এমন মন্তব্যও এসেছে যে, সরকার চাইলে এই টাকা নস্যি। এখানে বিদেশি সাহায্যের দরকার ছিল না।
১৬৭৮ সালে মোগল সুবেদার মুহাম্মদ আজম শাহ এটির নির্মাণকাজ শুরু করেছিলেন। ১৯৯৯ সালে লালবাগ কেল্লা বাংলাদেশের ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্য সম্ভাব্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। আর দুইতলা হাম্মামখানা মোগল সুবাদারদের দরবার হল হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বর্তমানে এটি একটি জাদুঘর।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৪৪৫
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি।
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ