লন্ডন থেকে পালিয়ে জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট বা আইএসে যোগ দিতে সিরিয়ায় পাড়ি জমিয়েছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত শামীমা বেগম। তারপর ঘটে গেছে অনেক ঘটনা। তিনি দেশে ফেরার জন্যে আবেদন জানিয়েছিলেন ব্রিটিশ সরকারের কাছে কিন্তু সেটা খারিজ করে দেয়। বার বার আকুতি জানানো পরও ব্রিটেনে ফিরতে পারছেন না শামিমা। তাকে যুক্তরাজ্যে ফেরার সুযোগ দেয়া হবে না বলে সম্প্রতি রায় দিয়েছে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট।
অপরদিকে যুক্তরাজ্যে ফিরতে যেন মরিয়া হয়ে উঠেছেন শামীমা। সে কারণেই হয়তো নিজের পোশাকেও বদল এনছেন। তাকে সম্প্রতি বোরকা ছেড়ে পশ্চিমা পোশাকে দেখা গেছে। তিনি সিরিয়ার যে ক্যাম্পে আছেন সেখানকার কিছু ছবি সম্প্রতি সামনে এসেছে। সেখানেই দেখা গেছে তার পোশাক এবং চলাফেরা একেবারেই বদলে গেছে।
ফ্যাশনেবল সানগ্লাস, চুলের ভিন্ন স্টাইল আর পশ্চিমা পোশাকে তাকে যেন চেনাই যাচ্ছিল না। ব্রিটেনে ফিরে যাওয়ার যুদ্ধে তিনি নিজেকেও আগের অবস্থানে ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
উত্তর-পূর্ব সিরিয়াযর একটি রোজ ক্যাম্প থেকে এক সাপ্তাহিক ছুটির দিনে তার বেশ কয়েকটি ছবি তোলা হয়। সেসব ছবিতে তাকে পুরোদস্তুর পশ্চিমা নারীদের মতো দেখা গেছে।
২১ বছর বয়সী শামীমা যুক্তরাজ্যে ফেরার আইনি লড়াইয়ে আছেন। এর মাঝেই নতুন রূপে নিজেকে হাজির করলেন ক্যামেরার সামনে। শামীমার সম্মতিতেই ছবিগুলো ধারণ করা হয়। তবে, ছবি তুললেও কোনো মন্তব্য করতে রাজী হননি শামীমা। আর তাই অতীত নিয়ে এখন কী ভাবছেন গণমাধ্যমের পক্ষে তা জানা সম্ভব হয়নি। তবে, শামীমার নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন শামীমার আইনজীবীরা।
বর্তমানে, হিজাব ও ইসলামী পোশাক ত্যাগ করা অন্যান্য নারীদের সাথে ক্যাম্পে অবস্থান করছেন তিনি।
একটা সময় এগুলোই ছিল তার প্রতিদিনকার পোশাক। এমনকি তিনি যেদিন সিরিয়ার উদ্দেশে পালিয়ে যান সেদিনও তাকে পশ্চিমা পোশাকেই শেষবারের মতো বিমানবন্দরে দেখা গিয়েছিল।
শামীমার আইএসে যোগদান
শামীমার পিতা যুক্তরাজ্যপ্রবাসী আহমেদ আলী সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার আশারকান্দি ইউনিয়নের দাওরাই গ্রামের বাসিন্দা। একই গ্রামের আসমা বেগমকে বিয়ে করে যুক্তরাজ্যে বসবাস করছিলেন। সেখানে আসমা বেগম এবং আহমদ আলী দম্পতির চার মেয়ে। এর মধ্যে শামীমা বেগম সবার বড়। একপর্যায়ে স্ত্রীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় ১৯৯০ সালে আহমদ আলী দেশে চলে আসেন। সেখানে আবার বিয়ে করেন। বর্তমানে দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে তিনি গ্রামের বাড়িতেই থাকেন। মাঝেমধ্যে অল্প কিছুদিনের জন্য যুক্তরাজ্যে গেলেও অধিকাংশ সময় দেশে থাকেন।
মাত্র ১৫ বছর বয়সে বাংলাদেশী অধ্যুষিত পূর্ব লন্ডনের বেথনাল গ্রীন এলাকা থেকে দুই বান্ধবী খাদিজা সুলতানা ও আমিরা আবাসি-সহ আইএসে যোগ দিতে সিরিয়ায় পালিয়ে গিয়েছিলেন শামীমা বেগম। তারা তাদের বাবা-মাকে বলেছিলেন, তারা একসাথে কোথাও বেড়াতে যাচ্ছেন। তুরস্কে নামার পর তারা সীমান্ত পেরিয়ে সিরিয়ায় ঢোকেন। তখন সিরিয়া ও ইরাকের বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করে রয়েছে আইএস।
ইসলামিকে স্টেটের স্বঘোষিত ‘খেলাফতের’ রাজধানী রাক্কায় এসে তারা প্রথম একটি বাড়িতে ওঠেন। সেখানে তাদের সাথে ছিল আরো কয়েকজন মেয়ে— যারা আইএস যোদ্ধদের বধূ হবার জন্য দেশ ছেড়ে এসেছিল।
শামীমা বলেন, “আমি একটা আবেদনপত্র দেই যে আমি ইংরেজিভাষী একজন যোদ্ধাকে বিয়ে করতে চাই—যার বয়েস ২০ থেকে ২৫ বছর বয়েসের মধ্যে।”
দশ দিন পর তার সাথে ২৭ বছর বয়স্ক একজন ডাচ লোকের বিয়ে হয় – যে ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। তাদের তিনটি সন্তান হয়— কিন্তু তাদের সবারই অল্প বয়সে মৃত্যু হয়।
২০১৯ সালের প্রথম দিকে লন্ডনের দৈনিক দি টাইমসের একজন সাংবাদিক সিরিয়ার একটি শরণার্থী শিবিরে শামীমা বেগমের খোঁজ পান। ঐ সাংবাদিকের মাধ্যমে শামীমা বেগম ব্রিটিশ সরকারের কাছে আবেদন করেছিলেন যে তাকে যেন ব্রিটেনে ফেরত আসতে দেওয়া হয়। সে অনুমতি না দিয়ে সরকার তার নাগরিকত্ব বাতিল করে।
যুক্তরাজ্যে ফিরতে চান শামীমা
শামীমা ২০১৯ সালে যুক্তরাজ্যে ফিরতে চান। তবে দেশটির সরকার রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে তার নাগরিকত্ব বাতিল করে। এরপর বিষয়টি আদালতে গড়ায়। পরে গত বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি শামীমার ব্রিটিশ নাগরিকত্ব বাতিল করার সিদ্ধান্তকে বৈধ বলে রায় দিয়েছিলেন যুক্তরাজ্যের একটি আদালত। রায়ে আদালত বলেছিলেন, নাগরিকত্ব বাতিলের ফলে শামীমা বেগম রাষ্ট্রহীন হয়ে যাননি। বংশগতভাবে তিনি ‘বাংলাদেশের নাগরিক’। তিনি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দাবি করতে পারেন।
ব্রিটিশ নাগরিকত্ব বাতিল হওয়া আইএস জঙ্গি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত শামীমা বেগমকে সিরিয়া থেকে যুক্তরাজ্যে ফেরার অনুমতি দেননি দেশটির সুপ্রিম কোর্ট। নাগরিকত্ব বাতিলের ওই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করতে তাকে দেশে ফেরার সুযোগ দেওয়া হবে কি না, সে বিষয়ে চলতি বছরের গত মাসে আদেশ দেন সুপ্রিম কোর্ট।
রায়ে বলা হয়, শামীমা বেগম যুক্তরাজ্যের নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারেন। তাই তার নাগরিকত্ব বাতিলে সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানাতে তাকে দেশে ফেরার অনুমতি দেওয়া উচিত হবে না।
বাংলাদেশে আসা নিয়ে প্রতিবন্ধকতা
সেসময় শামীমা বেগমের মা বাংলাদেশী— এ কারণে তিনি বাংলাদেশে আশ্রয় চাইতে পারেন এমন কথা বলা হয়েছিল।
কিন্তু বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন জানিয়েছিলেন, শামীমা বেগম কখনোই বাংলাদেশের নাগরিক ছিলেন না এবং তাকে বাংলাদেশে আসতে দেয়া হবে না।
শামীমা বেগমের বিষয়ে বাংলাদেশের কিছুই করার নেই বলে জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছিলেন, ‘শামীমা সে দেশের (যুক্তরাজ্যের) নাগরিক। তিনি কখনো বাংলাদেশের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেননি। কাজেই তাকে নিয়ে বাংলাদেশের কিছু করার নেই।’
এবিষয়ে শামীমার পিতা আহমেদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, শামীমা বাংলাদেশের নাগরিক নয়, তাই তাকে বাংলাদেশের আনার আবেদন করার কোনো সুযোগ নেই। যুক্তরাজ্যের আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে সুযোগ থাকলে আবারও আপিল করে পুনর্বিবেচনার আবেদন করা যেতে পারে।
শামীমার চিন্তা-ভাবনা
শামীমা যা করেছেন, তা নিয়ে এখন পর্যন্ত খুব কমই অনুশোচনা প্রকাশ করেছেন। তিনি এমনকি এমনও বলেছেন যে ময়লার ঝুড়িতে রাখা মানুষের কাটা মাথা দেখেও তার কোন ভাবান্তর হয়নি।
বিবিসিকে তিনি জানিয়েছেন, “যুদ্ধের ভিডিও”— যার মধ্যে ছিলো শিরোশ্ছেদের মতো ঘটনা— দেখে তিনি আইএস-এ যোগ দিতে মূলত অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। আর ছিল পরিবারগুলোকে আইএস-এর দেয়া “চমৎকার জীবন”-এর ভিডিও।
মধ্যপ্রাচ্যে বিবিসির সংবাদদাতা কোয়েন্টিন সামারভিল বলছেন যে “সাক্ষাৎকারের পুরোটা সময় শামীমা বেগম ইসলামিক স্টেটের দর্শনের পক্ষাবলম্বন করে গেছেন”।
তিনি আরও বলেন, “আইএস-এর দ্বারা ইয়াজিদী নারীদের দাসত্ব, হত্যা ও ধর্ষণের বিষয়ে যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, তখন তার উত্তর ছিল ‘শিয়ারাও ইরাকে একই কাজ করেছিল’।
আইএস যে হামলার দায়িত্ব স্বীকার করেছে, ২০১৭ সালের ম্যানচেস্টার অ্যারেনায়, সেই হামলায় ২২ জনের মৃত্যুর বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে শামীমা বেগম উত্তর দেন যে তিনি মনে করেন “নিরাপরাধ মানুষ মারার বিষয়টি ভুল”।
কিন্তু এও মনে করেন যে ওই ঘটনা ছিল “আইএস এলাকায় নারী ও শিশুদের হত্যার ঘটনার” এক ধরণের “প্রতিশোধ”।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬০০
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি।
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ